রিফাতুন্নবী রিফাত, গাইবান্ধা প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৬:৩৪ পিএম
ছবি-ভোরের আকাশ
যতই দিন যাচ্ছে ততই হারিয়ে যাচ্ছে নৌপথের জৌলুস।না আছে নদের সেই আগের মতো কলতান। উত্তর জনপদের বাণিজ্য আর যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল এই ব্রহ্মপুত্র নদ। সেই নদেই শোনাচ্ছে আজ হতাশার গল্প। দিনক্ষণ তাহলে কতই পরিবর্তন হচ্ছে।
গাইবান্ধার বালাশীঘাট থেকে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালুর স্বপ্নে ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় দুটি ফেরিঘাট টার্মিনাল। ২০২২ সালের ৯ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর চারটি লঞ্চ দিয়ে যাতায়াত শুরু হয়। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকদিন চলার পরই নাব্য সংকটে বন্ধ হয়ে যায় লঞ্চ চলাচল। তিন বছর কেটে গেলেও ফেরি বা লঞ্চ কোনো সার্ভিসই চালু হয়নি। এখন সেই আধুনিক টার্মিনাল দু’টি পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়।
জানা যায়, ১৯৩৮ সালে তিস্তামুখ ঘাট ও বাহাদুরাবাদ ঘাট চালু হয়। এই দুঘাটে ফেরি সার্ভিসের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর রেল যোগাযোগ চালু ছিল। ১৯৯০ সালে নদীর নাব্য সংকটের অজুহাতে তিস্তামুখ ঘাটটি স্থানান্তর করা হয় একই উপজেলার উজানে বালাশীতে। নতুন করে সেখানেও ব্যয় করা হয় প্রায় ৩০ কোটি টাকা। নির্মাণ করা হয় ত্রিমোহিনী রেলস্টেশন থেকে বালাশীঘাট পর্যন্ত নতুন প্রায় ৬ কিলোমিটার রেলপথ। সেখানেও কয়েক বছর চলার পর ব্রহ্মপুত্রে নাব্য হ্রাসের কারণে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে যমুনা বহুমুখী সেতু চালু হওয়ার পর ২০০০ সাল থেকে পুরোপুরি এ রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর যমুনা সেতুর ওপর যানবাহনের চাপ কমাতে ২০১৪ সালে বিকল্প নৌরুট তৈরির যুক্তি দেখিয়ে বালাশী ও বাহাদুরাবাদে ফেরিঘাট চালুর লক্ষ্যে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর একনেকের সভায় বালাশী-বাহাদুরাবাদ নৌরুটটি চালু করতে ‘বালাশী-বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের’ অনুমোদন দেওয়া হয়। সেসময় প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১২৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। পরে দুই দফায় প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে দাঁড়ায় ১৪৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
২০২১ সালের মধ্যে কিছু স্থাপনা নির্মাণ কাজ শেষ হলে হঠাৎ করে বিআইডব্লিউটিএ-এর কারিগরি কমিটি নাব্যতা সংকট ও ২৬ কিলোমিটার দূরত্বের কথা তুলে ধরে নৌ রুটটি চলাচলের অনুপযোগী বলে ঘোষণা করে। একই বছরের এপ্রিলে নৌ-রুটটির সমস্যা খুঁজে দেখতে বিআইডব্লিউটিএ একটি কমিটি গঠন করে। পরে কমিটির প্রতিবেদনে ভৌত কাজের গুণগতমান ও কাজের তদারকির অভাব, নাব্যতা সংকট-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ, প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতাসহ নানা দিক তুলে ধরে এই পথে ফেরি চলাচল অনুপযোগী বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়।
২০২১-২২ অর্থবছরের জুনে বৃহত্তর এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও নদীর মরফোলজিক্যাল অবস্থা না জেনেই দুই পাড়ে ঘাট নির্মাণ করায় বালাশী ঘাট ও বাহাদুরাবাদের দুই প্রান্তের ফেরিঘাট অন্যত্র স্থানান্তর করতেও প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে যেসব অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে, তা ভিন্ন কাজে ব্যবহারের সুপারিশও করে ওই কমিটি।
পরে ২০২২ সালের ৯ এপ্রিল নৌপথটি উদ্বোধন করে তৎকালীন নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। এসময় ফেরির বদলে লঞ্চ সার্ভিস উদ্বোধন করানো হয়। প্রথমে দুটি এবং পরে ছয়টি লঞ্চ চলাচলের ব্যবস্থা করা হলেও নাব্যতা সংকটে তাও কিছুদিন পর চলেনি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রকল্প বাস্তবায়নের পর উত্তরের আট জেলার মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিলেন আবারও সচল হবে পুরনো নৌপথ, সহজ হবে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ। কিন্তু বাস্তবে তিন বছরেও সার্ভিস চালু না হওয়ায় ক্ষোভে ফুঁসছেন তারা।
ফুলছড়ি উপজেলা প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি মজিবর রহমান বলেন, নাব্য সংকটের বিষয়টি আগে যাচাই না করে এভাবে কোটি কোটি টাকা খরচ করা দুঃখজনক। জনগণের টাকায় নির্মিত ঘাটগুলো এখন অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
গাইবান্ধা চেম্বার অব কমার্সের সহ-সভাপতি তৌহিদুর রহমান মিলন বলেন, এটি পরিকল্পনার স্পষ্ট ব্যর্থতা। যদি ফেরি চালানোই না যায়, তবে প্রকল্প নেওয়ার মানে কী? এমন প্রশ্ন তার।
সম্প্রতি গাইবান্ধার বালাশীঘাটের নৌ টার্মিনালে আসেন বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা। এসময় তিনি বলেন, নদীর নাব্য সংকটের কারণে ফেরি বা লঞ্চ চালানো সম্ভব নয়। বিকল্প ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে সরকার।
তিনি আরো বলেন, ছোট প্রকল্প হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা করা যায়নি। বাহাদুরাবাদ ঘাটকে আমরা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট হিসেবে ব্যবহার করার উদ্যোগ নিয়েছি। তেমনি বালাশীঘাটে হবে ইকোপার্ক ও হাইড্রোলজী অফিস ভাবছে বিআইডব্লিউটিএ।
সচেতন মহলের প্রশ্ন যদি নদীর নাব্য সংকট আগে থেকেই জানা থাকে, তবে কেন ফেরিঘাট নির্মাণে ১৪৫ কোটি টাকা খরচ হলো? উত্তরাঞ্চলের মানুষ এখনো অপেক্ষায়, হয়তো আবার কোনো একদিন ব্রহ্মপুত্রে চলবে ফেরি, জেগে উঠবে পুরোনো নৌপথের জৌলুস।
ভোরের আকাশ/জাআ