শহীদুল ইসলাম
প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২৫ ১২:৩৯ এএম
ফাইল ছবি
খাগড়াছড়িতে ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে ডাকা সড়ক অবরোধ অব্যাহত রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার জেলার চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি ও ঢাকা-খাগড়াছড়ি সড়কে অবরোধ শিথিল করা হলেও দূরপাল্লার বাস চলাচল শুরু হয়নি। অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতেও অল্পসংখ্যক ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করছে। ১৪৪ ধারা বহাল রয়েছে জেলার সদর ও গুইমারা উপজেলায়।
গতকাল খাগড়াছড়ি পৌরশহরের শাপলা চত্বর এলাকায় দেখা যায়, মোড়ে মোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন। অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ, সড়কে মানুষের চলাচলও তেমন নেই। একাধিক ব্যক্তি এক সঙ্গেই দেখলেই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল রয়েছে। সোমবার থেকে এখন পর্যন্ত নতুন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। খাগড়াছড়িতে যে সহিংসতা, সংঘর্ষ ঘটনায় মামলা হবে। নিহত ব্যক্তিদের পরিবার মামলায় অনাগ্রহী হলে পুলিশ মামলা করবে।
এদিকে, খাগড়াছড়িতে জুম্ম ছাত্র-জনতার ডাকা অবরোধ তুলে নিলেই ১৪৪ ধারাও প্রত্যাহার করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল খন্দকার। একই সঙ্গে জেলার গুইমারার রামেসু বাজারে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে তিনি এ কথাগুলো বলেন।
জেলা প্রশাসক বলেন, খাগড়াছড়ির চলমান পরিস্থিতি আলোচনার টেবিলে বসে সমাধান করতে চাই। অবরোধ আহ্বানকারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। জুম্ম ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে যে ৮টি দাবি দিয়েছে তার মধ্যে সাতটি অ্যাড্রেস করা হয়েছে। সহিংসতার ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। সদস্যদের নাম পরে জানানো হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করতে চাই। তবে অবরোধ প্রত্যাহার করতে হবে। ১৪৪ ধারা তুলে নেওয়ার সঙ্গে অবরোধের বিষয়টি সম্পর্কিত।’
এর আগে শনিবার অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এরপর সদর উপজেলা, পৌরসভা ও গুইমারা উপজেলায় পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ৯টায় প্রাইভেট পড়ে ফেরার পথে এক কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ওই দিন রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় একটি খেত থেকে তাকে উদ্ধার করেন স্বজনেরা। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শয়ন শীল নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাকে ছয় দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত।
এই ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে জুম্ম ছাত্র-জনতা এই অবরোধের ডাক দেয়। অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে রোববার বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে খাগড়াছড়ির গুইমারার রামেসু বাজার। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে অবরোধকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলিতে তিনজন নিহত হন এবং সেনাবাহিনীর মেজরসহ আহত হন অন্তত ২০ জন। নিহত তিনজনের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের কাছে গত সোমবার রাতে হস্তান্তর করা হয়। নিহতরা হলেন- গুইমারা উপজেলার সিন্দুকছড়ি ইউনিয়নের দেবলছড়ি চেয়ারম্যান পাড়ার আথুই মারমা (২১), হাফছড়ি ইউনিয়ন সাং চেং গুলি পাড়ার আথ্রাউ মারমা (২২) ও রামেসু বাজার বটতলা এলাকার তৈইচিং মারমা (২০)।
খাগড়াছড়ি সিভিল সার্জন ছাবের আহম্মেদ বলেন, এ ঘটনায় আহত ১৪ জনকে সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৩ জন হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন এবং একজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।
সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে এই ঘটনার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বিশ্লেষকরা বলেন, আগস্টে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতাগ্রহণ করে। একমাস পর সেপ্টেম্বরেই পাহাড়ে সহিংসতা হয়। খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রী কুজেন্দ্রলাল ত্রিপুরা এবং তার ঘনিষ্ঠ লোকজন, যারা ওখানে দায়িত্বে ছিলেন তারা পাশের দেশে গা ঢাকা দিয়েছেন।
আমাদের পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বিভিন্ন সময় ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছিল। তারা যখন পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) পর দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগকে পাশে পেয়ে গেল, তখন কিন্তু তাদের কাছে সবকিছু সহজলভ্য হয়ে গেল। তাই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যে কথা বলেছেন, তা কিন্তু ওখানকার প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। এখন সবচেয়ে গুরুতপূর্ণ বিষয় হলো- পাহাড়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। পাহাড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো না হলে ওখানে মানবাধিকার থাকে না, কেননা একজন মানুষ যদি মুভ না করতে পারে, তার প্রয়োজনীয় কাজ না করতে পারে তাহলে তো সেখানে কোনো নাগরিক অধিকার থাকে না।
বিশ্লেষকরা আরো বলেন, পাহাড়ের অস্থিতিশীলতার ক্রিয়াশীল আছে তারা হলো ইউপিডিএফ, যারা জেএসএসএর শাখা ভেঙে এই রুলটা প্লে করছে। পাহাড়ে তিনটি দাঙ্গার মৌসুম, একটা হচ্ছে মার্চ-এপ্রিলের দিকে, একটা আগস্ট- সেপ্টেম্বরের দিকে, আরেকটা নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘসময় বন্ধ থাকলে সমতলে যারা পড়াশোনা করছে, তারা কিন্তু পাহাড়ে ফিরে গিয়ে তাদের জ্ঞান, প্রশিক্ষণ সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। এবং সেখানে বিভিন্ন ইস্যু বানানোর চেষ্টা করে। প্রতিবছর একই সময়ে কিন্তু এমনটাই হয়। গতবছর কিন্তু আগস্ট-সেপ্টেম্বরের একই সময়ে এমন ঘটনা ঘটেছিল। মার্চ-এপ্রিলে পাহাড়ে একটি বড় উৎসব হয়, তাই প্রতিটা অকেশনেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
এ বিষয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মাদ সাজ্জাদ হোসেন সিদ্দিকী বলেন, পাহাড়ে সেনাবাহিনি ও প্রশাসনের প্রতি ওখানকার সাধারণ মানুষের যে আস্থার জায়গা তৈরি হওয়ার সেটি গড়ে ওঠেনি। পাহাড়িদের যখন তখন যেখানে সেখানে প্রশাসনের দ্বারা তল্লাশির ফলে সাধারণদের মধ্যে একটা বিরক্তি তৈরি হয়েছে, প্রশাসন যদি তল্লাশির ফল সঠিকভাবে তথ্য প্রকাশ করতো তাহলে আস্থা বাড়তো, এছাড়া সহিংসতার আরেক কারণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়া। সেখানে অনেক বিরোধীরা শান্তি চুক্তি চাইবে না।
সাজ্জাদ হোসেন সিদ্দিকী বলেন, আমাদের পাহাড়ে সহিংসতার অরেকটা কারণ হলো সমতল। সমতলে শান্তি না আনতে পারলে, গণতন্ত্র না আনতে পারলে, আইনের শাসন না আনতে পারলে পাহাড়ে ওইভাবে শান্তি আনা যাবে না। সমতলের ইফেক্ট ওখানে গিয়ে পড়ে। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে পাহাড়ের সমস্যা সমাধানের সঠিক পথ তৈরি করা হয়নি। এছাড়া এই মুহূর্তে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত-মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেগেটিভ তাই পাহাড় নিয়ে তাদের ইন্ধন উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
অন্যদিকে, মঙ্গলবার খাগড়াছড়িতে অবরোধের ডাক দেওয়া সংগঠন ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র প্রতিনিধিত্ব করা ব্যক্তিরা ইউপিডিএফ এর সঙ্গে যুক্ত বলে দাবি করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা। গত সোমবার রাতে রাঙ্গামাটি শহরে শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে মণ্ডপ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের কাছে এ দাবি করেন তিনি।
সুপ্রদীপ চাকমা বলেন, জুম্ম ছাত্র-জনতা নামে যে গ্রুপটা হয়েছে, তাদের সঙ্গে আমি আজ কথা বলেছি। ছয়জন এসেছিলেন তারা, ছয়জনই ইউপিডিএফের। কারণ, খাগড়াছড়ি এলাকায় ইউপিডিএফ ছাড়া কোনো কিছু নাই। আমি একে একে তাদের জিজ্ঞাসা করেছি, তাঁরা বলেছেন, আমরা ছয়জনই ইউপিডিএফ।
সুপ্রদীপ চাকমা বলেন, কোনো অপরাধ নয় এটা, মতাদর্শ থাকতেই পারে। আমি ওদের বলেছিলাম, দেখুন গত কয়েক দিনে আপনারা যা যা করলেন, আমার মনে হয় না এটি ম্যাচিউরড ওয়েতে হয়েছে, ম্যাচিউরিটির কমতি এখানে আছে। তারা (পাহাড়িরা) সব সময় স্লোগান দেন, সেনা হটাও। এই দুনিয়াতে কিছু বাস্তবতা আছে। যে বাস্তবতার বাইরে আমরা এত সহজে যেতে পারব না। এমনও দিন আসবে, আমরা তাদের জোর করে ধরে রাখলেও রাখতে পারব না।
তিনি বলেন, পূজা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে করতে হয়। তারা যাতে ভালোভাবে এটা উদযাপন করতে না পারে, এটা ছিল কিছু লোকের উদ্দেশ্য। সেটিই তারা করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হয়নি।
ভোরের আকাশ/এসএইচ