মো. রেজাউর রহিম
প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৫ ১২:০৫ এএম
ছবি- সংগৃহীত
অনেক বছর পর সারাদেশে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন এবং গণভোটের ‘নির্বাচনী হাওয়া’ বইতে শুরু করেছে। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষিত আগামী ফেব্রুয়ারিতে একইদিনে ‘জাতীয় নির্বাচন’ ও ‘গণভোট’ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এখনও পুরোপুরি একমত না হতে পারলেও দেশের প্রায় সবদলই এখন আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই মূলত তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আর প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো- বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, তারুণ্যনির্ভর জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ প্রধান রাজনৈতিদক দলগুলো তাদের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করার কাজও পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং গণভোটের ভোটগ্রহণের প্রস্তুতির কাজ সারছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আর নির্বাচনী আমেজে অনেক ভোটার তাদের পছন্দমতো জায়গায় ‘ভোটার স্থানান্তর’ও করছেন। গত বছরে ছয় লাখ ৬৫ হাজার ৫০০-এর বেশি ভোটার এলাকা পরিবর্তন করেছে। যা গত এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ, অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে দুইগুণ মানুষ তাদের ভোটার এলাকা পরিবর্তন করেছে করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া, দেশে ‘পোস্টাল ভোট নিবন্ধন’ ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত ভোটার এলাকা পরিবর্তন করার জন্য নির্বাচন কমিশনে মোট আবেদনের সংখ্যা ছিল সাত লাখের ওপরে। এর মধ্যে কমিশন এ পর্যন্ত ছয় লাখ ৬৫ হাজার ৫০০-এর বেশি ভোটারের এলাকা পরিবর্তনের বিষয়টি অনুমোদন দিয়েছে। আর বাকি আবেদনগুলোর কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
গত বছরে ভোটার এলাকা পরিবর্তন করেছে প্রায় তিন লাখ ৭১ জন। এ বিষয়ে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সাবেক প্রধান ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ভোরের আকাশ’কে বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর ভোটার স্থানান্তর দ্বিগুণের চেয়ে বেশি হয়েছে। এটাকে নেতিবাচকভাবে নেওয়ার কোনো কারণ নাই। এটা সত্যিই হয়েছে এবং এটা হওয়ার একটা বড় কারণ হতে পারে- মানুষ ‘আশাবাদী’ যে এবার তারা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে। তাই তারা যেখানে ভোট দিলে তাদের ভোটের প্রভাবটা বেশি হবে সেখানেই তারা ভোটার হওয়ার চেষ্টা করছেন- এমন হতে পারে।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অতীতে তো আমাদের ভোটার তালিকা সঠিক ছিল না। এক এলাকা থেকে অনেক সময় অন্য এলাকায় গিয়ে ভোটার হয়েছে। আবার কারো প্রভাবে কোনো জায়গায় গিয়ে ভোটারও হয়েছেন। এগুলো হয়তো সঠিকভাবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এবার হয়তো এগুলো শুদ্ধভাবে করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এবার ভোটাররা বিভিন্ন এলাকায় স্থানান্তর হচ্ছে এটা অনেকটাই রাজনৈতিক মোটিভও হতে পারে। ভোটাররা তাদের ভোটটা এমন জায়গায় দেবে যেখানে তাদের ভোটের প্রভাব বেশি পড়বে। এটিও একটি কারণ ভোটার স্থানান্তরের একটি কারণ হতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সূত্র জানায়, স্বাভাবিকভাবে এত ভোটার স্থানান্তরের এত আবেদন আসে না। অন্য বছরের তুলনায় এ বছর আবেদনের সংখ্যা বেশি। এর একটি কারণ হতে পারে এ বছর তিন দফায় ভোটার হালনাগাদ কাজ হয়েছে। কারণ যে যে বছর ভোটার হালনাগাদ করা হয় ওই বছর ভোটার স্থানান্তর বেশি হয়। আরেকটি কারণ হলো বিগত তিন নির্বাচনে অনেকে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি, এছাড়া অনেকে ‘রাজনৈতিক কারণে’ নিজ এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় ভোটার হয়েছেন। এবারের নির্বাচনটা একটা ভিন্ন পরিস্থিতিতে হতে যাচ্ছে। সবাই ভোট দিতে চায়, এজন্য হয়তো ভোটাররা নিজে এলাকায় গিয়ে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে চান। এ কারণেও এ সংখ্যাটা বৃদ্ধি পেতে পারে।
এদিকে, গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিন হবে কি-না, প্রস্তাবিত গণভোটে কি কি প্রশ্নে জনগণ তাদের মতামত জাানাবে এবং নির্বাচন কমিশন (ইসি) একই দিনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন একইসঙ্গে সম্পন্ন করার সক্ষমতা রাখে কি না, এসব বিষয় নিয়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ অবস্থায় জাতীয় নির্বাচন এবং গণভোট নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ এর বিষয়টিকে ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার’ এর ভিত্তিতে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
ভোটারদের এলাকা স্থানান্তরের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক এএসএম হুমায়ুন কবীর ভোরের আকাশ’কে জানান, নাগরিকরা কমিশনের কাছে কাছে ভোটার স্থানান্তরের জন্য আবেদন করেছেন। আমরা কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে তা অনুমোদন করছি। এছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবার ভোটাধিকার নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব।
জানা গেছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত ভোটার স্থানান্তরের আবেদন এসেছে সাত লাখ এক হাজার ৩৩৭ জনের। এর মধ্যে অনুমোদন হয়েছে ছয় লাখ ৬৫ হাজার ৫৬৫ জনের আবেদন। ইসির ১০টি প্রশাসনিক অঞ্চলের মধ্যে ঢাকা অঞ্চলে এখন পর্যন্ত ভোটার স্থানান্তর হয়েছে ৮৬ হাজার ৮২৫ জন। ফরিদপুর অঞ্চলে হয়েছেন ৩৯ হাজার ৯৫ জন, খুলনা অঞ্চলে ভোটার এলাকা পরিবর্তন করেছেন ৮১ হাজার ৭২৫ জন। ময়মনসিংহ অঞ্চলে হয়েছেন ৭৮ হাজার ৮০৫ জন, রংপুর আঞ্চলে ভোটার স্থানান্তর হয়েছেন ৬৩ হাজার ৮৯৭ জন, সবচেয়ে কম ভোটার এলাকা পরিবর্তন করেছেন সিলেট অঞ্চলে ২৭ হাজার ৫৭৬ জনের, রাজশাহী অঞ্চলে পরিবর্তন করেছেন ৭২ হাজার ৮১৫ জনের, ৮৫ হাজার ৭২০ জন ভোটার এলাকা পরিবর্তন করেছেন বরিশাল অঞ্চলে। চট্টগ্রামে ভোটার এলাকা পরিবর্তন করেছেন ৩০ হাজার ৮৫ জন ভোটার ও সবচেয়ে বেশি ভোটার স্থানান্তর হয়েছে এক লাখ পাঁচ হাজার ৫৪৩ জন। কিছু আবেদন এখনো যাচাই-বাছাই চলছে, যা অনুমোদন হলে এ সংখ্যা আরও কিছুটা বৃদ্ধি পাবে।
চার বছরের ভোটার স্থানান্তরের পরিসংখ্যান
জানা গেছে, বিগত চার বছরে ভোটার স্থানান্তর হয়েছে ২১ লাখ ১৫ হাজার ৪৫৮ জন। এর মধ্যে ২০২৪ সালে হয়েছেন ৩ লাখ ৭০ হাজার ৯১৭ জন, যা চলতি বছরের প্রায় অর্ধেক। ২০২৩ সালে হয়েছেন চার লাখ ৬১ হাজার ৫৫৯ জন। ২০২২ সালে ভোটার স্থানান্তর হয়েছেন সাত লাখ ১৭ হাজার ২০৮ (ভোটার হালনাগাদের বছর)। পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার ৭৭৪ জন ভোটার এলাকা পরিবর্তন করেছেন ২০২১ সালে।
উল্লেখ্য, সবশেষে ভোটার হালনাগাদ অনুযায়ী দেশে ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৮৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ছয় কোটি ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ৯০৭। মহিলা ভোটার ছয় কোটি ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ৪২। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার এক হাজার ২৩৪। আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন এবং গণভোট আয়োজনের বাধা দূর করতে গণভোট অধ্যাদেশও অনুমোদন দিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়।
‘পোস্টাল ভোট নিবন্ধন’ ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং গণভোটে প্রবাসী বাংলাদেশিরা নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগের উদ্দেশ্য ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপে নিবন্ধন অভ্যাহত রেখেছে। ‘পোস্টাল ভোট নিবন্ধন’ ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, গত ১৯ নভেম্বর থেকে পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকা অঞ্চলে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যা আগামী ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত চলমান থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াসহ ১৬টি দেশেও একই সময় পর্যন্ত নিবন্ধন কার্যক্রম চলবে।
যে সকল দেশে নিবন্ধন চলছে
দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, মিশর, মোজাম্বিক, লিবিয়া, মরিশাস, হংকং, ব্রাজিল, উগান্ডা, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, লাইবেরিয়া, বতসোয়ানা, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, তানজানিয়া, সোমালিয়া, ঘানা, গিনি, মরক্কো, দক্ষিণ সুদান, চিলি, সিয়েরা লিওন, ইকুয়েডর, তাইওয়ান, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, গাম্বিয়া, পেরু, জিম্বাবুয়ে ও যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশ থেকে মোট নিবন্ধন করেছেন (২৫ নভেম্বর) দুপুর ১২টা পর্যন্ত) ৩০ হাজার ৫৬৫ জন প্রবাসী। সৌদি আরবের প্রবাসীরা ৪ থেকে ৮ ডিসেম্বর, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশিরা ৯ ডিসেম্বর থেকে ১৩ ডিসেম্বর, মধ্য প্রাচ্যের সৌদি আরব বাদে অন্য দেশগুলো প্রবাসীরা ১৪ ডিসেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে নিবন্ধন করতে পারবেন। এছাড়া বাংলাদেশে বসবাসরতরা (ভোটের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি, সরকারি চাকরিজীবী, কয়েদি ও অন্যান্য দেশে বসবাসরত ভোটাররা) ১৯ ডিসেম্বর থেকে ২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে নিবন্ধন করতে পারবেন।
ইসি সূত্র জানায়, অ্যাপে নিবন্ধনকারীদের ঠিকানায় পোস্টাল ব্যালট ডাকযোগে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ভোটাররা ভোট দিয়ে ফিরতি খামে তা আবার রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠাবেন।
ভোরের আকাশ/এসএইচ