জাতিসংঘে বিশেষ ‘রোহিঙ্গা অধিবেশন’ আজ
মো. রেজাউর রহিম
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১২:৪৫ এএম
ছবি: সংগৃহীত
নিজেদের ঘাড় থেকে আশ্রিত ১৩ লাখ ‘রোহিঙ্গার বোঝা’ নামাতে মরিয়া বাংলাদেশ। বাংলাদেশে আশ্রিত বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিজ দেশে প্রত্যাবসনে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রতিফলন হিসেবে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জেনারেল অ্যাসেম্বলি হলে আজ মঙ্গলবার ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর পরিস্থিতি’ নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসহ অংশীজন, দাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের পাশাপাশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরাও অংশ নেবেন।
জাতিসংঘ অধিবেশনে অংশগ্রহণরত প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস উচ্চ পর্যায়ের এই বিশেষ ‘রোহিঙ্গা অধিবেশন’-এ বক্তব্য রাখবেন। তিনি তার বক্তব্যে রোহিঙ্গা সংকটের একটি টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি সহযোগতা ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাবেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে। আর এই অধিবেশনে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিও থাকবেন। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘের উদ্যোগে সাধারণ পরিষদে এ ধরনের একটি উচ্চ পর্যায়ের অধিবেশন আয়োজন এই প্রথম।
সূত্র জানায়, গত বছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রধান উপদেষ্টা প্রথমবারের মতো সব অংশীদারের অংশগ্রহণে জাতিসংঘের উদ্যোগে এমন একটি উচ্চ পর্যায়ের সভা আয়োজনের প্রস্তাব করেন। প্রধান উপদেষ্টার ওই প্রস্তাব বিশ্বব্যাপী দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সর্বসম্মতিক্রমে একটি রেজুলেশনের মাধ্যমে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতির নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের এবারের সভাটি আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আর এই উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক থেকে যেন রোহিঙ্গা সংকট দ্রুত সমাধানে একটি কার্যকর কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, সেজন্য আন্তর্জাতিক অংশীদার ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গত ২৪-২৬ আগস্ট কক্সবাজারে প্রথমবারের মতো অংশীদারদের জন্য একটি সংলাপের আয়োজনও করা হয়।
জানা গেছে, অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরবেন। এছাড়া কক্সবাজারে রোহিঙ্গাবিষয়ক সম্মেলনে সংকট সমাধানে যে সাতটি প্রস্তাব তুলে ধরেছিলেন, সেটিও পুনরায় বিশ্বনেতাদের সামনে তুলে ধরবেন তিনি। এই বৈঠক থেকে রোহিঙ্গা-সংকট সমাধানের একটা রাস্তা তৈরি হবে বলে আশা করছে সরকার।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আজ জাতিসংঘে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক আহ্বান করেছেন সাধারণ পরিষদের সভাপতি। ওই সভার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজনৈতিক সহযোগিতা একত্রিত করা, রোহিঙ্গা সংকটের দিকে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি ফেরানো, পুরো সংকট নিয়ে পর্যালোচনা ও সংকটের মূল কারণ খুঁজে বের করা। একইসঙ্গে সভায় এ অঞ্চলের মানবিক সংকট, সংকটের একটি টেকসই, দীর্ঘমেয়াদি ও উদ্ভাবনী পরিকল্পনা খুঁজে বের করার চেষ্টাও করা হবে। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বেচ্ছায় নিরাপদ, টেকসই এবং মর্যাদাপূর্ণ নিজ বাসভূমে প্রত্যাবাসনে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করার বিষয়েও আলোচনা হবে।
পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে একটা দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী পদক্ষেপ প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা।
এ সমস্যা সমাধানে জাতিসংঝের রোহিঙ্গা অধিবেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে আশা পকাশ করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশ যাতে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর চাপমুক্ত হতে পারে, সে বিষয়ে সহযোগিতা করতে হবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এই সমস্যা একা সমাধান করতে পারবে না। এজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশনে এ ব্যাপারে বড় অগ্রগতি হবে বলে আশা করছে সরকার।
উল্লেখ্য, মিয়ানমারের সামরিক জান্তার আদেশে দেশটির রাখাইন প্রদেশে ২০১৭ সাল থেকে হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন-লুটপাটের স্বীকার ও বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৩ লাখ মানুষ এখন বাংলাদেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে। আট বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করলেও তাদের নিজ বাসভুমে প্রত্যাবসন এখনও অনিশ্চিত। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশকে আর্থিক, সামজিক, পরিবেশ, নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আশ্রিত রেহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ অবস্থার অবসানে বাংলাদেশ সমন্বিত উদ্যোগ নিয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে রেহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানামুখী প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
অন্যদিকে, মিয়ানমারের সামরিক সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী চাতুরতা, গৃহযুদ্ধ এবং ‘আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলো’র খেলার বলি হয়ে গেছে ভাগ্যবিড়ম্বিত, দেশহারা মিয়ামারের জনগোষ্ঠীর বিপুলসংখ্যক মানুষ। আর এর বিষফল ভোগ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
একদিকে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিপুলসংখ্যক মানুষ বিদেশভূমের ক্যাম্পে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। আর এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে মানবিক দৃষ্টিতে নিজদেশে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশও দীর্ঘদিন ধরে নানা জটিল সমস্যার মুখে নিপতিত। বাস্তব অবস্থা হচ্ছে-রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিপুলসংখ্যক মানুষ এবং তাদের আশ্রয়দাতা বাংলাদেশ এখন অনেকটা বিশে^র তিন পরাশক্তি-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন এবং আঞ্চলিক শক্তি ভারতের ‘ভু-রাজনীতি’র খেলার শিকারে পরিণত হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রলায়সূত্র জানায়, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রিত ও নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১৩ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে।
ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, সীমান্ত পেরিয়ে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আরো প্রায় সোয়া লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। এরপর রোহিঙ্গারা সবচেয়ে বেশি এসেছেন ২০২৫ সালে। গত ৮ মাসে ৯৬টি নৌকায় প্রায় ৪ হাজার রোহিঙ্গা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, যা গত চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এদিকে, রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ কমে যাওয়ায় তৈরি হয়েছে নতুন সংকট।
ইউএনএইচসিআর বলছে, চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ১০ কোটি ৪৩ লাখ ডলার অর্থ সহায়তা এসেছে বাংলাদেশে। তবে এখনও ঘাটতি আছে ১৫ কোটি ১২ লাখ ডলার। রোহিঙ্গাদের জন্য প্রয়োজন মোট ২৫ কোটি ৫৫ লাখ ডলার।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, জাতিসংঘে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক আহ্বান করেছেন সাধারণ পরিষদের সভাপতি। ওই সভার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজনৈতিক সহযোগিতা একত্রিত করা, রোহিঙ্গা সংকটের দিকে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি ফেরানো, পুরো সংকট নিয়ে পর্যালোচনা ও সংকটের মূল কারণ খুঁজে বের করা।
একইসঙ্গে সভায় এ অঞ্চলের মানবিক সংকট, সংকটের একটি টেকসই, দীর্ঘমেয়াদি ও উদ্ভাবনী পরিকল্পনা খুঁজে বের করার চেষ্টাও করা হবে। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বেচ্ছায় নিরাপদ, টেকসই এবং মর্যাদাপূর্ণ নিজ বাসভূমে প্রত্যাবাসনে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করার বিষয়েও আলোচনা হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বে বক্তব্য রাখবেন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতি আনালেনা বেয়ারবক, জাতিসংঘের মহাসচিবের পক্ষে মহাসচিবের কার্যনির্বাহী কার্যালয়ের চিফ দ্য ক্যাবিনেট আর্ল কোর্টেনে রাত্রে, উইমেনস পিস নেটওয়ার্ক-মিয়ানমারের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ওয়াই ওয়াই নু, মিয়ানমার বিষয়ক আসিয়ান চেয়ারের বিশেষ দূত ওসমান হাশিম, জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত জুলি বিশপ, আরাকান ইয়ুথ পিস নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা রফিক হুসন, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাই কমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি, রিফিউজি উইমেন ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের নির্বাহী পরিচালক লাকি করিম, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার ভোলকার টার্ক এবং রোহিঙ্গা স্টুডেন্টস নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা মং সাওয়্যেদুল্লাহ।
এ ব্যাপারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, রোহিাঙ্গাদের নিজ দেশে সন্মনজনক প্রত্যাবসনে বাংলাদেশ তার দায়িত্বের চেয়েও বেশি করেছে। এখন অর্থায়ন, দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ব ভাগাভাগির মাধ্যমে বিশ্বকে পদক্ষেপ নিতে হবে বাংলাদেশ এ সমমস্যার আশু সমাধান প্রত্যাশা করছে। এজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ সমস্যা নিরসনে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাস্তব অবস্থা হচ্ছে-রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিপুলসংখ্যক মানুষ এবং তাদের আশ্রয়দাতা বাংলাদেশ এখন এই ইস্যুতে বিশে^র তিন পরাশক্তি-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন এবং আঞ্চলিক শক্তি ভারতের ‘ভু-রাজনীতি’র খেলার শিকার। আর বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের তাদের নিজদেশে প্রত্যাবসনের নানা প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলেও বিষয়টি এখনও সমাধানের পথ পায়নি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সমন্বিত উদ্যোগ ও আন্তরিকতা বেশি জরুরি। আর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এককভাবে এ সমস্যার সমাধান প্রায় অসম্ভব। বিষয়টি নিয়ে ভারতসহ পরাশক্তিগুলোর ‘ভু-রাজনীতি’র খেলা ছাড়াও মিয়ামনারের রাখাইন রাজ্যসহ দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের বিষয়ে জটিলতা দিন দিন আরো বাড়ছে।
এর পেছনে ‘ভূ-রাজনৈতিক’ জটিলতার পাশাপাশি নিজেদের স্বার্থে মিয়ানমারের প্রতি দুই বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ-ভারত ও চীনের রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত পক্ষপাতও। আমেরিকা-ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ (ইইউ) পশ্চিমা বিশ্ব যখন মিয়ানমারের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তখন চীন তাকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়ায়। ভারতও তাদের নিজেদের স্বার্থে এ সংকট নিরসনে বাংলাদেশকে প্রত্যাশিত সহায়তা করেনি। এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতীয় ঐকমত্যও অপরিহার্য।
আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও উন্নয়নের স্বার্থে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী ও টেকসই সমাধান জরুরি বলেও মনে করেন তারা। তাদের মতে, রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ায় বাংলাদেশের নিরাপত্তাজনিত সমস্যা হচ্ছে, দিন দিন আন্তসীমান্ত নিরাপত্তা পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটছে। রাখাইনের গৃহযুদ্ধে আরাকান আর্মির পক্ষে কুকি চীন আর্মি সদস্যদের অংশগ্রহণ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ করে বান্দরবান, রাাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার এলাকার জন্য বড় ধরনের নিরাপত্তা হুমকিও সৃষ্টি করেছে। এজন্য যত দ্রুত সম্ভব বিষয়টির আশু সুরাহা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠেীর তাদের নিজদেশে প্রত্যাবসন প্রসঙ্গে অন্তবর্তীকালীন সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রলায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক ই আজম ভোরের আকাশ’কে বলেন, রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে মর্যাদা ও নিরাপত্তার সঙ্গে প্রত্যাবসনের বিষয়টি নিয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার আন্তরিকভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে জাতিসংঘ এই ‘বিশেষ রোহিঙ্গা অধিবেশন’-এর আয়োজন করেছে।
তিনি বলেন, বিষয়টির স্থায়ী সমাধানে এবং মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন ত্বরান্বিত করতে জাতিসংঘের এই অধিবেশনে একটা স্থায়ী সমাধান হবে বলে আশা করছে সরকার।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ অধিবেশন আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন উল্লেখ করেন তিনি। জাতিসংঘের রোহিঙ্গা বিষয়ক এই বিশেষ অধিবেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিজ দেশে প্রত্যাবসনের সুযোগ পাবে বলে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, বিভিন্ন বাধা মোকাবিলা করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান সরকার রেহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন জোরালো কূটনৈতিক পদক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে।
তিনি বলেন, আমাদের সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা হচ্ছে-রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা। এজন্য আমরা ‘বিশ^ জনমত’ গড়ে তোলার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা গণহত্যা এবং মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উচ্ছেদের আট বছর ইতোমধ্যে পার হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল, লেবানন-ইসরায়েল, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধসহ সাম্প্রতিক ইরান-ইসরাইল এবং মার্কিন-চীন-ভারত শুল্ক-বাণিজ্য যুদ্ধসহ বৈশ্বিক অন্যান্য সংঘাতের ডামাডোলের পাশাপাশি বাংলাদেশে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবসন ইস্যু অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছিল।
তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস গত রমজান মাসে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে তাদের নিজদেশে প্রত্যাবসনে উদ্যোগও নিয়েছেন। ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকেই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ সমস্যা সমাধানে আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতকিছুর পরেও রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমিতে ফেরার বিষয়টি এখনও অনিশ্চিতই রয়ে গেছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর একদিকে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে কক্সবাজারসহ চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামাজিক পরিবেশ ও প্রতিবেশও এতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্নস্থানে। তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার এ সমস্যা সমাধানে অত্যন্ত তৎপর রয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা প্রত্যাবসন এবং এ সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘের মহাসচিবকে এ সমাধানে এ কাজে অন্তর্ভুক্ত করেন।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিভাবে গ্রহণযোগ্য সরকার ক্ষমতায় থাকায় দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা এ বিষয়টি সমাধানের দিকে নেওয়া সম্ভব। আর রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল ভাগ্যবিড়ম্বিত মুসলিম এই জনগোষ্ঠীর অনিশ্চিত, অনিরাপদ, আশাহীন জীবনের অবসান ঘটানোর পাশাপাশি তা বাংলাদেশের জন্য এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও গুরুত্বপুর্ণ।
এক্ষেত্রে নিজদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যাতে সহিংসতা ও নিপীড়ন-নির্যাতনমুক্ত থাকে এবং তাদের নিরাপত্তা, নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত হয়। পাশাপাশি জাতিসংঘের অধীনে রোহিঙ্গাদের নিজদেশে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা এবং কর্মসংস্থান ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দিতে হবে মিয়ানমারকে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন এবং জান-মালের নিরাপত্তায় বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ জরুরি। এজন্য জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে এ বিষয়ে মিয়ানমারকে রাজি করাতে এই বিশেষ অধিবেশন অতি গুরুত্বপুর্ণ।
জানা গেছে, সবমিলিয়ে এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো-পশ্চিমা বিশ্ব তথা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে স্বীকৃতি আদায়ের ব্যবস্থা করা। যথাযথ কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিষয়টি জাতিসংঘে প্রস্তাব আকারে তুলে এবং তা পাস করানোর মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব হতে পারে। আর জটিল এ বিষয়টি সমাধানে মিয়ানমারের রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা এবং দেশটিতে চলমান গৃহযুদ্ধ, আঞ্চলিক ভূ-কৌশলগত জটিলতা, নিরাপত্তাজনিত প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি দেশটির সরকারের বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ঢুকতে না দেওয়ার মানসিকতা থেকে মুক্ত করতে ব্যাপক ‘আন্তর্জাতিক চাপ’ এবং কূটনৈতিক জোরালো উদ্যোগ নিশ্চিত করতে হবে।
উল্লেখ্য, আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশের কক্সবাজার, চট্টগ্রাম এলাকায় ইতোমধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সমস্যার মুখে রয়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মাদক ও অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা চলছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী ঘিরে মিয়ানমারের কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠন সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে।
এছাড়া মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ‘আদার পিপল’ বা ‘বেঙ্গলি মুসলিম’ হিসেবেই চিহ্নিত করে থাকে। অথচ দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামেও রেহিঙ্গাদের রয়েছে বিশাল অবদান। ১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সেনাশাসন শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো রোহিঙ্গারাও নাগরিক হিসেবে বসবাস করছে। অথচ কালের পরিক্রমায় রোহিঙ্গারা এখন নিজ দেশেই পরবাসী এবং বিতাড়িত।
ভোরের আকাশ/এসএইচ