মো. রেজাউর রহিম
প্রকাশ : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১২:০৯ এএম
ফাইল ছবি
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পরিবর্তনের কাজ শুরু করছে সরকার। নির্বচনকে গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমুলক করতে নানামুখী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় সংস্কারের পাশাপাশি প্রশাসনে পরিবর্তন আনার কাজও শুরু করেছে অধ্যাপক ড. মুহামদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। মাঠ পর্যায়ে বেশ কয়েকজন ডিসি পরিবর্তন ও রদবদল করা হয়েছে।
এর মধ্যে গতকাল বোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানকে সচিবের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছে সরকার। এছাড়া বেশ কিছু জায়গায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পদের পরিবর্তন আনা হয়েছে। নির্বাচনের আগে আরও বেশ কিছু বড় ধরনের পরিবর্তন ও রদবদল করা হবে।
এছাড়া সাবেক আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী বিভিন্ন পদে এখনো কর্মরত বিপুলংখ্যক আমলা আগামী নির্বাচনকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ করতে নানা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে বলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে তথ্য রয়েছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে, চুক্তিতে নিয়োজিত মোখলেস উর রহমানকে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে বদলি করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। অন্যদিকে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) মো. রুহুল আমিনকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোহাম্মদ রফিকুল হক স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যের পদটি সচিব পদমর্যাদার। তবে এই দায়িত্বে মোখলেস উর রহমান সিনিয়র সচিব পদমর্যাদা ভোগ করবেন।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। গত বছরের ২৮ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে সরকার। এরপর ১৯৮২ সালের বিসিএস ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা মোখলেস উর রহমানকে অবসর থেকে ফিরিয়ে এনে দুই বছরের চুক্তিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাকে সরিয়ে দেওয়া হলো।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভোরের আকাশকে জানান, মোখলেস উর রহমান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের দায়িত্ব নেওয়ার পর বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি নিয়ে জনপ্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এছাড়া তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় ডিসি নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগও উঠেছিল।
সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশাসনিক পরিবর্তনে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ণমুক্ত, জনমুখী এবং নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়তে কাজ করছে। এছাড়া প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে আওয়ামী আমলে সুবিধাভোগী এবং বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করে তাদের পরিবর্তে সৎ, মেধাবী এবং নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে কয়েক দফা বহিষ্কার, চাকরিচ্যুতি, বদলি, পদায়ন এবং নতুন নিয়োগের কাজও সম্পন্ন করা হয়েছে। আর আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রশাসনে বাছাই করে ‘সৎ ও নিরপেক্ষ’ কর্মকর্তাদের নিয়োগের বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছে সরকার। এদিকে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকাণ্ড এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ করতে আওয়ামী-ফ্যাসিস্টপন্থি কিছু বর্তমান ও সাবেক আমলা এবং সুবিধাভোগী ষড়যন্ত্র করতে মাঠে নেমেছেন বলেও জানা গেছে।
১৯৯৬ সালের ‘জনতার মঞ্চ’র আদলে এসব কুশীলবরা সক্রিয় হয়ে ভিন্ন নামে মাঠে নেমেছে। তারা ইতোমধ্যে এরই অংশ ‘মঞ্চ ৭১’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করেছে এবং জনতার মঞ্চ অনুসরণ করেই আওয়ামী লীগকে প্রশাসনে ও রাজনীতিতে ফেরাতে চান। তবে এই সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লি¬ষ্টতার অভিযোগে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান, সাবেক সচিব ভূঁইয়া মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজনকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এছাড়া মাঠ প্রশাসনেও আরো পরিবর্তন আনা হবে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে আওয়ামী সরকারের ১৬ বছর প্রশাসনে সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তদের পরিবর্তন, অবসরে পাঠানো কিংবা অব্যাহতি দেওয়ার ফলে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে এক ধরনের আতংকও বিরাজ করছে।
এদিকে, আগামী বছরের ফেব্রুযারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে সরকার কেন্দ্রীয় ও মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর কাজ অব্যাহত রেখেছে। শিগগিরই আরো কয়েকটি জেলায় ডিসি এবং দেশের বিভিন্ন উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পদের পরিবর্তন আসছে বলে দায়িত্বশীল একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। এছাড়া জাতীয় নির্বাচনকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে ডিসিদের রাখা নাও হতে পারে বলে জানা গেছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ও মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করার পাশাপাশি ঢেলে সাজাতে শুদ্ধি অভিযানসহ নানা অভিযান চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে গত এক বছরে কেন্দ্রীয় প্রশাসনে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। মাঠ প্রশাসনেও কয়েক দফা পরিবর্তন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আওয়ামী সরকারের আমলের সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ প্রায় তিন শতাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামুলক অবসরসহ বিভিন্নভাবে অপসারণ করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে কয়েক দফায় জেলা প্রশাসক (ডিসি), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদেও রদবদল করা হয়েছে।
এছাড়া সচিব পদমর্যাদার প্রায় শতাধিক কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল এবং বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া নতুন করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও বন্ধ রাখা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের ষোল বছরে জনপ্রশাসন, পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োগ কিংবা পদায়নের ক্ষেত্রে যোগ্যতার চেয়ে দলীয় বিবেচনা বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। এজন্য দেশের স্বার্থে এবং আগামী নির্বাচনকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ করতে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে যোগ্য ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগের বিকল্প নেই।
চট্টগ্রামসহ তিন জেলায় নতুন ডিসি
এদিকে, মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনে পরিবর্তনের চলমান প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রাম, নওগাঁ ও নরসিংদী জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দিয়েছে সরকার। গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, নওগাঁর জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ আব্দুল আউয়ালকে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়েছে। অন্যদিকে, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের উপ-সচিব মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইনকে নরসিংদী এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপ-সচিব মনিরা হককে নওগাঁর ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত আরেকটি প্রজ্ঞাপনে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব, নরসিংদীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ হোসেন চৌধুরীকে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-সচিব করা হয়েছে।
এদিকে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির ১৪তম সভায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সদস্য- আসিফ নজরুল, অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, আদিলুর রহমান খান, আলী ইমাম মজুমদার, মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, শারমীন এস মুরশিদ, আফম. খালিদ হোসেন এবং সুপ্রদীপ চাকমা অংশ নেন।
এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধানগণ এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ