ভোরের আকাশ ডেস্ক
প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১০:৫৩ এএম
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের সঙ্গে একটি বিশেষায়িত প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে জাপান। চলতি বছরের মধ্যেই এ চুক্তি সইয়ের প্রাথমিক উদ্যোগ চলছে।
কূটনৈতিক সূত্রের মতে, চুক্তিটি বাস্তবায়িত হলে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং যৌথ গবেষণার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার নতুন অধ্যায় সূচিত হবে।
ড. ইউনূসের টোকিও সফরের পর আলোচনা অগ্রসর
গত মে মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস টোকিও সফর করেন। সেখানে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। দুই নেতার আলোচনায় প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব পায়। বৈঠকের ধারাবাহিকতায় নীতিগতভাবে বাংলাদেশ ও জাপান প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ও সমরাস্ত্র বিনিময়–সংক্রান্ত চুক্তি সইয়ে সম্মত হয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
২০২৩ সালের এপ্রিলে দুই দেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতাবিষয়ক সম্মতিপত্রে সই করেছিল। সে সময় থেকেই বিস্তারিত প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল।
চুক্তিতে কী কী থাকছে
জাপানের প্রতিরক্ষা নীতি অনুসারে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রস্তাবিত সমঝোতা তিনটি মূল উপাদানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হচ্ছে—
১. প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম হস্তান্তর: নৌ টহলযান, যোগাযোগব্যবস্থা, নজরদারির প্রযুক্তি ও অপ্রাণঘাতী সামরিক সরঞ্জাম।
২. যৌথ গবেষণা: সাইবার নিরাপত্তা, স্যাটেলাইট প্রযুক্তি, উপকূলীয় নজরদারি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহযোগিতা। ৩. কঠোর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা: সরবরাহকৃত সমরাস্ত্র তৃতীয় কোনো দেশে হস্তান্তর করা যাবে না এবং ব্যবহারের ক্ষেত্র নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এসব উপাদান বাংলাদেশকে সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও সাইবার প্রতিরক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ করে দেবে।
চীন–জাপান প্রতিযোগিতা ও বাংলাদেশের ভারসাম্য
নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য এ চুক্তি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক হলেও এর ভূরাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। কারণ, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে চীনের কাছ থেকে সমরাস্ত্র সংগ্রহ করে আসছে। জাপানের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতা বাড়লে চীন কিছুটা অস্বস্তি বোধ করতে পারে। তাই ঢাকাকে বড় শক্তিগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে এগোতে হবে।
জাপানের নতুন প্রতিরক্ষা নীতি ও ব্যবসায়িক আগ্রহ
জাপান সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানির ক্ষেত্রে আইন শিথিল করার পর এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে তাদের প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান বাজার খুঁজছে। জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি ২০২২ সালে ঢাকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্ভাব্য সহযোগিতার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। সে সময় মিৎসুবিশি ইলেকট্রনিকসের প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করে বিমানবাহিনীর রাডার ও আকাশ প্রতিরক্ষাবিষয়ক প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছিল।
অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন
সূত্র মতে, জাপান প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তার ভিত্তিতে সমরাস্ত্র বিক্রির প্রস্তাবও বিবেচনা করছে। এর আগে শেখ হাসিনার টোকিও সফরের প্রস্তুতিকালে এ বিষয়টি আলোচনায় আসে, যদিও সফরটি স্থগিত হয়েছিল।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ. ন. ম. মুনীরুজ্জামান মনে করেন, “এই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ শুধু সমরাস্ত্র নয়, প্রযুক্তিগত সহায়তাও পাবে। এটি সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু এতে বাধ্যতামূলক কোনো রাজনৈতিক শর্ত নেই, তাই বাংলাদেশ এ থেকে অনেকটাই উপকৃত হবে।”
অন্যান্য দেশের সঙ্গে জাপানের চুক্তি
২০১৩ সালে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি সইয়ের মধ্য দিয়ে জাপান এ উদ্যোগ শুরু করে। এ পর্যন্ত ভারত, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও মঙ্গোলিয়াসহ ১২টি দেশের সঙ্গে জাপান প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি বিনিময়ের চুক্তি করেছে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১১টি দেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষাবিষয়ক ২০টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছে। সর্বশেষ এ বছরের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে মালয়েশিয়ার সঙ্গে একটি এমওইউ সই হয়।
বাংলাদেশের জন্য লাভ ও চ্যালেঞ্জ
প্রস্তাবিত বাংলাদেশ–জাপান প্রতিরক্ষা চুক্তি একদিকে সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিক প্রযুক্তি ও সরঞ্জামে সমৃদ্ধ করবে, অন্যদিকে সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও সাইবার প্রতিরক্ষায় নতুন সক্ষমতা তৈরি করবে। তবে একই সঙ্গে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জও থাকবে।
সব মিলিয়ে এ চুক্তি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কূটনীতিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে বলে মনে করছেন কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞরা। সূত্র: প্রথম আলো
ভোরের আকাশ/মো.আ.