নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৫ ১০:৩৯ পিএম
আ.লীগের মধুপান শেষে বিএনএম নেতারা কোথায়?
এম. সাইফুল ইসলাম : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘কিংস পাটি’ হিসেবে আর্বিভূত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বা বিএনএম এর গুলশানের বিলাস-বহুল কার্যালয়টিও এখন বন্ধ। নেতাদেরও দেখা মেলে না। দলের নেই কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। ফলে নেতারা এখন কোথায় তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে রয়েছে নানা আলোচনা। জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আর্শিবাদপুষ্ট দলটির কতিপয় নেতা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আনুকূল্য পেতে দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছেন। অনেকেই ‘লেবাস’ পাল্টিয়ে বা পরিচয় গোপন করে বর্তমান সরকারের নানা মহলে যোগাযোগ রক্ষা করে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে, বিএনএম এর শুরুর দিকে উদ্যেক্তাদের দাবি, তৎকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সংগঠনটি আওয়ামী লীগ ‘ছিনতাই’ করে নিজেদের ‘পারপাস’ রক্ষার জন্য ব্যবহার শুরু করলে তারা বের হয়ে আসেন। নির্বাচনের আগে যারা এটির সঙ্গে ছিল তারা শুধুমাত্র আর্থিক ফায়দা নেওয়ার জন্যই ছিলেন।
তবে দলটির চেয়ারম্যান সাবেক আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতা শাহ মো. আবু জাফর বলছেন, গত নির্বাচনে (দ্বাদশ জাতীয় সংসদ) যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের ব্যাপারে বর্তমান সরকার নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছেন। তাই তারা সরকারের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছেন। তবে নিজেদের রাজনৈতিক কাজের অংশ হিসেবে নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, বিএনএম নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত একটি রাজনৈতিক দল। আর বর্তমান সরকার সকল নিবন্ধিত দলকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করবে বলেও প্রত্যাশা করছি। অন্যথায় রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠবে না। এছাড়া বিএনএম কোনো কিংস পার্টি নয় বলেও দাবি তার। আর অফিস বন্ধ নয়, পরিবর্তন করা হয়েছে বলেও দাবি তার।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে- ২০২৩ সালের ১০ আগস্ট নিবন্ধন লাভ করে বিএনএম। দলটির প্রতীক নোঙ্গর। মাঠ পর্যায়ে তেমন কোনো ভিত্তি না থাকা সত্বেও বিএনএমকে তখন নিবন্ধন দেয়া হয়। নিবন্ধন পেয়েই হঠাৎ করেই দলটি গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তৎপরতা শুরু করে। যেকারণে শুরু থেকেই দলটি ‘কিংস পার্টি’ নামে পরিচিতি পায়।
বিএনএম গঠিত হয় ২০২১ সালের ৭ জুলাই। গঠনের দুই বছরের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায় দলটি। বিএনএম এর নেতৃত্বে ছিলেন বিএনপির সাবেক দুই নেতা। কার্যত বিএনপিকে বিভক্ত করতেই এই উদ্যোগ। তবে, দলটিতে শুরুর থেকেই সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের সংখ্যাধিক্য ছিল। বিএনএমের শুরুর সময়কার আহ্বায়ক অধ্যাপক আব্দুর রহমান বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য। তিনি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরগুনা-১ আসনে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সপ্তম সংসদ নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও হেরে যান। বেশ অনেক দিন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় আব্দুর রহমান একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনও ছিলেন। দলের সদস্যসচিব মেজর (অব.) মো. হানিফ বিএনপির নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য। মেজর (অব.) মো. হানিফ ২০২১ সালের ২৮ জুন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন। হঠাৎ হানিফের দল ছাড়ার ঘটনাকে ইঙ্গিতপূর্ণ বলেছিলেন বিএনপির নেতারা। দল ছাড়ার ১০ দিনের মাথায় নতুন দল বিএনএম গড়ে তোলেন হানিফ। হানিফের সংসদীয় এলাকা সিরাজগঞ্জ-২। তিনি সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক।
হঠাৎ করেই গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দলটি ব্যাপক আলোচনায় আসে। রাজধানীর মহাখালীতে স্বল্প পরিসরের একটি কার্যালয় থাকলেও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই দলীয় কার্যালয় পরিবর্তন করা হয়। ওই বছরের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে গুলশান-২ নম্বর গোলচত্বরের কাছে প্রায় আড়াই হাজার বর্গফুটের বিলাস-বহুল কার্যালয়ে কার্যক্রম শুরু করে বিএনএম। সেই কার্যালয় থেকেই দলের মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও প্রার্থী বাছাই করা হয়। মূলত বিএনপির সাবেক এবং নিষ্ক্রিয় নেতাদের নিয়ে নির্বাচনি কার্যক্রমে তৎপর ছিল দলটি। অবস্থা এমন ছিল যে তখনকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ‘স্বার্থ রক্ষা’ করতেই মাঠে নামে বিএনএম। নেতৃত্বেও আসে পরিবর্তন। ২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। ২০১ সদস্য বিশিষ্ট নতুন এই কমিটিতে চেয়ারম্যান পদ শূন্য রেখে ভাইস চেয়ারম্যান করা হয় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ফরিদপুরের শাহ মো. আবু জাফরকে। চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকায় তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। নতুন মহাসচিব ও মুখপাত্র হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. মো. শাহজাহান। দলটির টার্গেটে পরিণত হন বিএনপির সাবেক কয়েকজন সংসদ সদস্য ও নিষ্ক্রিয় নেতারা। যদিও তাতে খুব একটা সাড়া পাননি তারা। সেময় বিএনপির অভিযোগ ছিল, বিএনপিকে ভাঙতেই বিএনএমকে কাজে লাগাচ্ছে সরকার। জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের বিএনএম-এ যোগদানের খবরও রটে তখন। এছাড়া বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বিএনএম এর চেয়ারম্যান হচ্ছেন এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে সে খবরকে গুজব বলে আখ্যা দেন।
সেসময় বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকে সরকার দলীয় নেতাদের সঙ্গে বসিয়ে বাগিয়ে আনতে কাজ করতেন দলটির সঙ্গে যুক্ত বিশেষ বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন কর্মকর্তা। তার মধ্যে ড. কামরুল আহসান ছিলেন অন্যতম। তিনি বিএনএম এর বর্তমান কো-চেয়ারম্যান বলে জানিয়েছেন দলটির চেয়ারম্যান শাহ মো. আবু জাফর। কয়েকদিন আগেও ড. কামরুল আহসান বিএনএম এর ইফতার মাহফিলে ছিলেন বলে জানান চেয়ারম্যান। যদিও ড. কামরুল তিনি নিজেকে মূখ্য সমন্বয়ক হিসেবে পরিচয় দিতেন। গত সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনএম এর নেতাদের সঙ্গে ড. কামরুলের বৈঠকের একাধিক ভিডিও রয়েছে দৈনিক ভোরের আকাশ এর হাতে। এছাড়াও বিগত সরকারের একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে দেশ ও বিদেশে কামরুলের সঙ্গে বৈঠকের ভিডিও রয়েছে। বিশেষ করে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতা ও বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারকারী পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান নাফিস সরাফতের সঙ্গে দুবাইয়ে বৈঠকের ভিডিও রয়েছে। এছাড়া প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমেদের সঙ্গে কাতারে বৈঠক করেছেন কামরুল আহসান। তিনি নিজেকে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বন্ধু পরিচয় দিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নানান পরিচয়ে হটাৎ করেই কামরুল নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে মেলে ধরেছিলেন বিএনএমতে। বিএনএম নির্বাচনের আগে গুলশানের যে অফিসটি ব্যবহার করেছে সেটি কামরুলের নিজের অফিস বলেও জানা গেছে।
২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৮২টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল বিএনএম। যার সবকয়টিতে শোচনীয় পরাজয় হয় দলটির প্রার্থীদের। একটি মাত্র আসনে জামানত হারাতে হয়নি দলটির প্রার্থীর। ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগেরও কোন সহানুভূতি বা আনকূল্য না পেয়ে ভোটের পরপরই দলটির গুলশানের সেই জাঁকজামকপূর্ণ কার্যালয়ও বন্ধ হয়ে যায়। নিজেদের মধ্যে নেতৃত্বেও নিয়ে শুরু হয় নানা দ্বন্দ্ব। সরেজমিন গুলশানের সেই অফিসে গিয়ে দেখা গেছে সেখানে বিএনমএম অফিসের অস্তিত্ব নেই। নির্বাচনের পর দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মো. আবু জাফর এবং মহাসচিব ড. মো. শাহজাহান অনেকটাই রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রমে তাদেরকে দেখা যায় না।
২০২৪ সালের ১৩ জুন ব্যক্তিগত কারণে ড. মো. শাহজাহান মহাসচিবের পর থেকে পদত্যাগ করলে ড. আব্দুর রহমান নতুন মহাসচিবের দায়িত্ব পান। এছাড়া শাহ মো. আবু জাফর ভারপ্রাপ্ত থেকে দলের পূর্ণাঙ্গ চেয়ারম্যান হন। ওই বছরের ২৯ জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিএনএমের এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। এর কয়েকদিন পর অর্থ্যাৎ ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনএম এর কী অবস্থা সে প্রশ্ন অনেকের মাঝে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে- রাজনৈতিক দল হিসেবে কোনো কর্মকাণ্ডে নেই বিএনএম। দলটির কেউ কেউ এখন বর্তমান সরকারের আনুকূল্যে যেতে চেষ্টা করছেন। গত সংসদ নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই দলটির নেতা বনে যাওয়া ড. কামরুল আহসান এখন নিয়মিতই সরকারের দুই একজন উপদেষ্টার কার্যালয়ে যাওয়া আসা করছেন। সেসব উপদেষ্টার সঙ্গে তার ব্যাপক সখ্যতা বলেও তিনি বিভিন্ন মহলে জাহির করার চেষ্টা করছেন। অথচ তিনি এখন বিএনএম-এর পরিচয় অস্বীকার করছেন। বরং ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর তিনি এবং ভিন্নভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করেছে। নিজের ফেসবুকে কখনো বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে স্মৃতিচারণ আবার কখনো রংপুরের শহীদ আবু সাঈদের ভাইয়ের সঙ্গে তোলা ছবি শেয়ার করছেন।
এ ব্যাপারে ড. কামরুল আহসান দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন আমি কোনদিন বিএনএম-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। অথচ দলটির বর্তমান চেয়ারম্যান শাহ মো. আবু জাফর তাকে কো-চেয়ারম্যান হিসেবে দাবি করেছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, তারা আমাকে সামনে আনার চেষ্টা করেছেন। আমি সামনে আসিনি। এমনকি গত নির্বাচনে আমাকে ভোট করারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিএনএম এর নেতারা। দলটির তৎকালীন মহাসচিব ড. শাহজাহানসহ একাধিক নেতার সঙ্গে দলীয় ফোরামে বৈঠকের ভিডিও আছে এমন কথা বলতে তিনি বলেন, এটি পারসোনাল। তৎকালীন আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের পাশাপাশি ও ব্যবসায়ী নাফিস সরাফতের সঙ্গে বিদেশে সফরে ভিডিওর বিষয়ে তিনি বলেছেন, আমি ব্যবসায়ী। দেশের জন্য কাজ করি। অনেক সময় দেশের জন্য ফান্ড আনতে কাজ করতে গিয়ে তাদের সঙ্গে বৈঠক করতে হয়েছে। ৫ আগস্টের পর বেগম খালেদা জিয়া ও শহীদ আবু সাঈদের ভাইকে নিয়ে পোষ্ট দেওয়ার বিষয়ে কামরুল বলেন, আমি ম্যাডাম খালেদা জিয়ার সিকিউরিটি টিমে কো-অর্ডিনেটর ছিলাম। আমি আগেও তাকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছি। তবে, আমি কোন দলের সদস্যও না।
এদিকে, বিএনএম গঠনের শুরুর থেকেই যে কয়েকজন উদ্যোক্তা ছিলেন তাদের অন্যতম একজন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিষ্টার এম. সারোয়ার হোসেন। তিনি দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, আমি ও মেজর (অব.) মো. হানিফসহ কয়েকজন মিলে একটা ভালো উদ্দেশ্যে এই সংগঠনটি করতে চেয়েছিলাম। আমাদেরকে একজন বিএনপি নেতা মাঠে নামিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি সরে দাঁড়ান। যখন দেখলাম এটি ছিনতাই হয়ে গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার এটিকে কব্জায় নিয়ে ব্যবহার করছে তখন আমি বের হয়ে আসি। এ সংগঠনে শেষ পর্যন্ত যারা ছিল তারা সরকারের পারপাস রক্ষায় কাজ করেছেন। মূল উদ্যেক্তাদের বাদ দিয়ে মো. শাহজাহান মহাসচিব ও কামরুল আহসান মুখ্য সমন্বয়ক বনে গিয়ে সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি। নির্বাচনে আগে যারা এটির সঙ্গে ছিল, তারা দ্বাদশ নির্বাচনে কারা কি অবস্থায় গিয়েছিল তা সবার জানা। তাদের দেশের মানুষ ভালো চোখে দেখে না। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের আগ পর্যন্ত যারা এখানে ছিলেন তাদের উদ্দেশ্যেই ছিল টাকা কামানো।