গণভোট
মাজাহারুল ইসলাম
প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৫ ১২:২৭ এএম
                                        ছবি: সংগৃহীত
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি, গণভোট ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন এবং সনদের সুপারিশমালায় অধিকাংশ দলের ‘ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্ট’ বাদ দেওয়ার প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্য পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে চরম বিরোধ দেখা দিয়েছে। এই সংকটের জন্য সরকারকে দায়ী করেছে কোনও কোনও দল। প্রতারণারও অভিযোগ তোলা হয়েছে। নাম প্রকাশ করা না হলেও সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধেও অভিযোগ তোলা হয়েছে। এতে বিব্রত ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সরকার।
গণভোট প্রসঙ্গে রাজনীতির মাঠে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তা নিরসনে গণভোটের দিনক্ষণ ঠিক করার দায়িত্ব এখন দলগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এমনকি, দ্রুততম সময়ে, সম্ভব হলে এক সপ্তাহের মধ্যে দলগুলো নিজ উদ্যোগে আলোচনা করে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনের লক্ষ্যে বল এখন দলগুলোর কোর্টে- এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
তাদের ভাবনায়, দলগুলো নিজের মধ্য পারস্পারিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সরকার নিজ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কালক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই, সেটা বিবেচনায় রেখে ফ্যসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের ঐক্যদলগুলোকে গণতন্ত্রের স্বার্থে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া উচিত- এটাই প্রত্যাশা করছেন বিশিষ্টজনরা।
নির্বাচন পেছানোর ক্ষেত্রে বিএনপি ছাড় দেবে না, মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তবে গণভোট আগে, না নির্বাচনের দিন, এই দুই পক্ষেই অকাট্য যুক্তিও রয়েছে। হ্যাঁ-না মতামতের জটিল বিষয় বুঝতে জনগণকে সময় দেওয়া প্রয়োজন। তবে রাজনৈতিক দলগুলোকে ইগো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে- বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
গণভোট সংক্রান্ত রাজনৈতিক মতভেদের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে উপদেষ্টা পরিষদ-এ প্রসঙ্গে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, গণভোটের সময়সূচি ও বিষয়বস্তু নির্ধারণের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আর কোনো সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই। তাই দলগুলোকে স্ব-উদ্যোগে আলোচনায় বসার আহ্বান জানানো হয়েছে। যদি তারা ঐক্যবদ্ধ নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়, সরকার তার মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
তিনি বলেন, গণভোট প্রসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত জমা দিতে বলা হয়েছে। আমরা কোনো আল্টিমেটাম দেইনি, আহ্বান জানিয়েছি। আমরা অপেক্ষা করব, এরপর সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে।
ড. আসিফ নজরুল আরও বলেন, সরকার আর কোনো আলোচনার আয়োজন করবে না। গত ১৫ বছরে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নিজের উদ্যোগে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তারা অত্যন্ত প্রতিকূল সময়ে একসঙ্গে আন্দোলন করেছে, একসঙ্গে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আশা করি তারা স্ব-উদ্যোগে আমাদের একটি ঐক্যবদ্ধ নির্দেশনা দেবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে না পারে, অবশ্যই সরকার সরকারের মতো সিদ্ধান্ত নেবে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে সরকার যে আহ্বান জানিয়েছন- এটি ইতিবাচক দেখছেন বিএনপি। তিনি বলেন, জুলাই সনদে আমরা যে অংশে সই করেছি, তার দায়দায়িত্ব আমরা নেব। কিন্তু যেটা আমরা সই করিনি, সেটার দায় আমরা নেব না।
তিনি বলেন, আমরা সনদে সই করার সময় বলেছিলাম, যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে, সেগুলো সই হবে। যেসব বিষয়ে একমত হবে না, সেগুলো নোট অব ডিসেন্ট হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকবে। এখন দেখা যাচ্ছে, সেই নোট অব ডিসেন্টের কোনো উল্লেখই নেই। আমাদের বক্তব্যগুলো বেমালুম বাদ দেওয়া হয়েছে, বরং নতুন কিছু বিষয় যোগ করা হয়েছে- এটা জনগণের সঙ্গে নিঃসন্দেহে প্রতারণামূলক কাজ। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের কোনো সুযোগ নেই বললেন তিনি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, দেশের জনগণের জুলাই সনদের দরকার নেই। জনগণের প্রয়োজন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। একটি সংসদ প্রয়োজন, যারা গণতন্ত্র বাস্তবায়ন করবে। এই জুলাই সনদ মূলত উপদেষ্টাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য কাজে লাগবে, জনগণের স্বার্থে নয়।
ঐকমত্য কমিশন জোর করে সনদে ঢুকিয়ে দিয়েছে মন্তব্য করে মেজর হাফিজ বলেন, নির্বাচন হওয়ার স্বার্থে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিএনপি অনেক কিছু মেনে নিয়েছে। সব দল যেসব বিষয়ে একমত হবে, তা নিয়ে সনদ হবে। আমরা ডিসেন্ট দেখতে চাই না। এখন প্রয়োজন সুষ্ঠু নির্বাচন এবং ক্ষমতায় এলে বিএনপি যৌক্তিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, তাদের ভুলিয়ে দিতে এ অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে বলেও মন্তব্য করেনি তিনি।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, ঐকমত্য কমিশন অনৈক্যের একটা দলিল জাতির কাছে হাজির করেছে। জাতীয় নির্বাচনের শাশ্বত পথে প্রবেশ না করা পর্যন্ত কোনো কিছুর সমাধান আসবে না।
এ প্রসঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ নিয়ে মতভেদ কাটাতে উপদেষ্টা পরিষদ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটিকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু একটা বিষয় যোগ করতে চাই, কারণ হচ্ছে উপদেষ্টা পরিষদ যদি এটা মনে করে যে তাদের আর কোনো দায়িত্ব নেই, তারা কিছুই করবে না, দলগুলোই মিলে করবে, তাহলে এখানে একটা রেফারির অভাব হতে পারে। তো সে জন্য আমি বলছি, আমরাও চেষ্টা করব, তবে সরকার উদ্যোগী না হলে রেফারির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে- এমন আশঙ্কাও জানিয়েছেন তিনি।
সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, উচ্চকক্ষে পিআরের ব্যাপারে আট দলের সবাই, জনগণ ও সরকার একমত। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে এ চাওয়া পূরণ হবে না। প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানে অন্যরা সাড়া দিলে আমরাও আলোচনা বসতে রাজি। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারকে রেফারির ভূমিকা পালন করতে হবে।
এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীম বলেন, জুলাই সনদ আইনি ভিত্তি না পেলে পরবর্তী নির্বাচন বৈধতা পাবে না। একই দিনে গণভোট ও নির্বাচন হলে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন হুমকির মুখে পড়বে। একই দিনে গণভোট ও নির্বাচনের ইতিহাস নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আফিস সাহান বলেন, আপনি ৪৮টা প্রস্তাবের একটি প্যাকেজ জনগণকে দিচ্ছেন। জনগণকে তো বুঝতে হবে আমি কিসের ওপর ভোট দিচ্ছি। আমি হ্যাঁ ভোট দিলে কি হবে আর না ভোট দিলে কি হবে। এটা যদি আমি না বুঝি তাহলে তো ভোট দেয়ার কোনো অর্থ হয় না। এটা তো সিম্পল একটা এক্সারসাইজ হচ্ছে। এই কমপ্লিকেটেড বিষয় বুঝার জন্য জনগণকে সময় দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর জনগণের কাছে যেতে হবে, বলতে হবে এটা হচ্ছে ঘটনা। এর মাঝখানে সরকারের প্রস্তুতি ও নিতে হবে। এটা কি এক মাসের মধ্যে সম্ভব? আপনি যদি নভেম্বরের মধ্যেই এটা করেন তাহলে এর কোনো পারফেক্ট রেজাল্ট হবে না বরং রাজনৈতিক টুল হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ