কেন্দ্রীয় কমিটি বাদে সব কমিটির কার্যক্রম স্থগিত
মাজাহারুল ইসলাম
প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২৫ ০৯:০৬ এএম
সংগৃহীত ছবি
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের মসনদ উড়িয়ে দিয়ে জাতির আস্থায় আসা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নেতৃত্ব বড় প্রশ্নের মুখে পড়েছে। চাঁদাবাজিসহ নানামুখী কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ ও ইমেজ সংকটের একপর্যায়ে গতকাল কেন্দ্রীয় কমিটির বাদে সারাদেশের সকল কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। এ ঘটনায় রাজনৈতিক মহল নতুন করে নড়েচড়ে বসেছে।
ফ্যাসিস্টবিরোধী জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-জনতা নিয়ে গড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরুতেই দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল সীমাহীন। তবে দিন দিন গড়ানোর স্রোতে মানুষের সেই প্রত্যাশায় ভাটার টান লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। তরুণ নেতৃত্বে গড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা, সমন্বয়হীনতা, কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও সামনে আসে।
গত শনিবার রাতে রাজধানীর গুলশানে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয় পাঁচজন। চাঁদাবাজির ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আবদুর রাজ্জাকসহ (রিয়াদসহ) চারজনকে সাত দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। রিমান্ডপ্রাপ্ত অপর তিন আসামি হলেন সাকদাউন সিয়াম, সাদমান সাদাব ও ইব্রাহিম হোসেন। এ পরিস্থিতিতে গতকাল রোববার কেন্দ্রীয় কমিটিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সব কমিটি বাতিল করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সংগঠনের সভাপতি রিফাত রশিদ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়া সারাদেশের সব কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সারাদেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানার ব্যবহার করে নামে-বেনামে অনেক ধরনের অপকর্ম করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিভিন্ন রাজনৈতিক শেল্টারে বা তারা বিপথগামী হয়ে চাঁদাবাজি, দুর্নীতিতে জড়িয়েছে, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই আমরা কেন্দ্রীয় কমিটি বাদে সব কমিটির কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করছি। এর পর থেকে বৈষম্যবিরোধীর ব্যানার ব্যবহার করে কোনো ধরনের অপকর্ম করা হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন রিফাত রশিদ।
তিনি আরও বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আগামীতে কিভাবে পরিচালিত হবে সে বিষয়ে শিগগিরই সিদ্ধান্ত জানানো হবে। রাজধানীর গুলশানে একজন সাবেক সংসদ সদস্যের বাসায় চাঁদাবাজি করতে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন নেতা; গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের এক নেতাসহ পাঁচজন গ্রেপ্তার হওয়ার পরদিন এই সিদ্ধান্ত জানাল সংগঠনটি।
এদিকে, পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর গুলশানে চঁদাাবাজির সময় হাতেনাতে ধরা পড়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ পাঁচ নেতা। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা একজন সাবেক সংসদ সদস্যের কাছে সমন্বয়ক পরিচয়ে প্রথম দফায় ১০ লাখ টাকা চাঁদা নেয়ার পর দ্বিতীয় দফায় আরও ৫০ লাখ টাকা অর্থ নিতে গেলে শনিবার সন্ধ্যায় গুলশানের ৮৩ নম্বর সড়কের একটি বাসা থেকে তাদের আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় সংগঠন দুটির পক্ষ থেকে অভিযুক্ত পাঁচ নেতাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
অপরদিকে, ঘটনাটিকে ঘিরে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সংগঠনের সাবেক নেত্রী ফাতেমা উমামা। তিনি শনিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশের ভানকে হাস্যকর বলে মন্তব্য করেন। তার মতে, ঘটনার শেকড় অনেক গভীরে, আর বিস্ময় প্রকাশের ভঙ্গিমা আসলে সত্যিকারের পরিস্থিতি ঢাকার চেষ্টা।
নিজের ফেসবুক পোস্টে উমামা লেখেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত পাঁচজনের চাঁদাবাজির খবর শুনে আমার পরিচিত অনেকেই এতটাই ‘বিস্মিত’ হয়েছেন যে মনে হচ্ছে, এই ঘটনায় আমিই সবচেয়ে কম অবাক হয়েছি। এই ছেলেগুলোকে তো বহুদিন ধরে নেতাদের প্রটোকল দিতে দেখেছি। এমনকি সচিবালয় থেকে শুরু করে মিছিল-মিটিং, সংঘর্ষেও ক্ষেত্রেও তারা সামনে থেকে কাজ করেছে। সমন্বয়কদের ডানহাত-বামহাত হিসেবে এদের পরিচিতি ছিল। গুলশান-বনানী গ্যাং কালচারের সঙ্গে যুক্ত থাকার অসংখ্য অভ্যন্তরীণ অভিযোগ আগে থেকেই ছিল এদের বিরুদ্ধে। উমামা ওই পোস্টে আটক হওয়া যুককদের একটি ছবি যুক্ত করে একজনকে উদ্দেশ করে বলেন, ছবিতে থাকা রিয়াদ নামের এই ছেলেটি গত ডিসেম্বরে রূপায়ন টাওয়ারে আমার সামনে চরম উশৃঙ্খল আচরণ করেছিল। আমরা কয়েকজন মেয়ে তাকে শান্ত করতে গেলে সে উল্টো আমাদের ওপর চড়াও হয়।
পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, তার বিরুদ্ধে আগেও হুমকি, মারধর ও চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল। আমি খুব একটা অবাক হইনি, কারণ তখনই বুঝে গিয়েছিলাম, বেষম্যবিরোধী মঞ্চে এরকম মানুষের অবাধ আনাগোনা চলছে। রূপায়ন টাওয়ারে এদের প্রবেশ ছিল অবাধ, কেউ দুর্নীতি বা অসততার অভিযোগ তুললে কোনো জবাব আসত না, শুধু নিস্তব্ধতা। আমি নিজে দেখেছি, এসব লোক কীভাবে অবলীলায় সংগঠনের ভেতরে প্রবেশাধিকার পেয়ে যেত। এখন এতদিন পর এই প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকালে ভাষা হারিয়ে ফেলি যেভাবে পেরেছে, প্ল্যাটফর্মটিকে নষ্ট করেছে। চাঁদাবাজির খবর প্রকাশের পর চারদিকে যে ‘বিস্ময়’ দেখা যাচ্ছে, তা নিয়ে তীব্র কটাক্ষ করেন উমামা।
তিনি বলেন, ‘ইশ! মানুষ কতটাই না নিষ্পাপ! সদ্যজাত শিশুর মতো আজ তারা ‘আবিষ্কার’ করেছেন এই ছেলেগুলো চাঁদাবাজি করছিল! কিন্তু দুঃখের বিষয়, এটিই প্রথম ঘটনা নয়, এই প্রথম তারা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে মাত্র।
একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে, এদের শিকড় অনেক গভীরে। শনিবার সন্ধ্যায় সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে আটক ৫ জন হল মো. সিয়াম, সাদমান সাদাব, মো. আমিনুল ইসলাম, ইব্রাহীম হোসেন ও আব্দুর রাজ্জাক রিয়াদ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যতটা প্রত্যাশা নিয়ে গঠন করা হয়েছে তরুণদের এ দল, ততটাই হতাশা উপহার দিয়েছে তারা। পরে একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন দলটির নেতাকর্মীরা। এনসিপির জ্যেষ্ঠ মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন ‘চাঁদাবাজ’ নেতাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। নিজ দল থেকে শোকজও করা হয় তাকে। এর আগে মোংলা সমুদ্রবন্দর ইস্যুতে জড়িয়ে সমালোচিত হন তিনি।
এ দিকে সারা দেশের কমিটি বাতিলকে ইতিবাচক ভাবে দেখছেন রাজনৈতিক বোদ্ধা ও বিশ্লেষকগণ। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মো. শাহ আলম দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, এটা ভাল একটি উদহরণ হয়েছে। একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের প্লাটফর্ম একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠে তারা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। তারা কোনভাবেই ষড়যন্ত্রের বাইরে নয়। কিন্ত প্রত্যক্ষ বা জনসম্মুখে আসা ঘটনাকে অস্বীকর করা যাবে না।
ভোরের আকাশ/এসএইচ