নির্বাচনের ভিত্তিই জুলাই সনদ
চূড়ান্ত খসড়া জুলাই সনদ পর্যালোচনা করে মতামত দিয়েছে বিএনপি, এনসিপিসহ ২৬ দল। কিন্তু সংলাপ ও মতামত জমা দেওয়ার দিনক্ষণ একাধিকার বাড়ানোর পরও ঐকমত্যে পৌঁছতে পারছে না রাজনৈতিক দলগুলো। জুলাই সনদকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধানের দাবিতে অটল রয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। আর সনদের আইনিভিত্তি এবং নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) চায় জামায়াত। জামায়াত ও এনসিপির এমন দাবিসমূহের প্রতি কোনোভাবেই সমর্থন দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে বিএনপি। এভাবে রাজনৈতিক ও সংবিধান সংকটে পড়েছে জুলাই সনদ। জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বিত চূড়ান্ত খসড়ায় বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ ২৬টি দল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে মতামত জমা দিয়েছে।মতামত জমাদানের পর দলগুলোর অবস্থান পর্যালোচান করে দেখা গেছে, জুলাই জাতীয় সনদকে সংবিধানের ওপর প্রাধান্য দেওয়ার পক্ষপাতী নয় বিএনপি। সনদ সম্পর্কে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না-এ অঙ্গীকারেও একমত নয় বিএনপি। দলটি চায়, যেসব সাংবিধানিক সংস্কারে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো নির্বাচনের আগে নয়; আগামী সংসদে বাস্তবায়ন করা হবে।অঙ্গীকারনামার দ্বিতীয় দফায় বলা হয়েছে, সংবিধান ও আইনের ওপর প্রাধান্য থাকবে সনদের। সনদ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না আদালতে। বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার কালক্ষেপণ না করে নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন করবে সরকার। বিএনপি এই তিন অঙ্গীকারের বিরোধী। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ৩৫ পৃষ্ঠার মতামত দিয়েছে বিএনপি। সংস্কার প্রস্তাব এবং অঙ্গীকারনামার বিষয়ে দলীয় মতামত জানিয়েছে। সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানের ওপরে কোনো কিছুকে প্রাধান্য দেওয়া যায় না। জুলাই সনদ রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল। সমঝোতার দলিল সংবিধানের ওপর প্রাধান্য পেতে পারে না।অঙ্গীকারের চতুর্থ দফায় বলা হয়েছে, সনদের প্রতিটি বিধান, প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ গণ্য হবে। তাই সনদের বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। বিএনপি এতে আপত্তি জানিয়েছে।সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘কোনো কোনো বিষয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না, তা সংবিধানে বলা আছে। অনুচ্ছেদ ৭৯ অনুযায়ী সংসদের কার্যক্রম এবং ১২৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচনী আইন ও নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যায় না। এর বাইরে কোনো কিছু সম্পর্কে যদি আদালতে প্রশ্ন তোলার পথ বন্ধ হয়, তবে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হবে।’এদিকে, জুলাই সনদের আইনিভিত্তি এবং সনদের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে এরই মধ্যে মাঠে নেমেছে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন। একই দাবি জানাচ্ছে এনসিপিও। সনদ সম্পর্কে দেওয়া মতামতে বিএনপি বলেছে, সংবিধান-সংক্রান্ত সংস্কার-পরবর্তী সংসদে হতে হবে।গত শনিবার সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি’র সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেছেন, ‘ঐকমত্য কমিশনে একমত হওয়া বিষয়গুলোর টেকসই বাস্তবায়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে।’আখতার হোসেন বলেন, ‘যেসব বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হয়েছি, তার টেক্সট কীভাবে প্রস্তুত হবে তাও এখনও চূড়ান্ত হয়নি। গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে যারা প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন, তারাই সে টেক্সট তৈরি করবেন। আমরা দেখি যতগুলো জায়গায় পরিবর্তন করতে হবে, তা বর্তমান সংবিধানে ৬০ থেকে ৭০ বা তারও বেশি পরিবর্তন করতে হবে। যা সংবিধান পুনর্লিখনেরই সমান।’তিনি বলেন, ‘গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করার বিষয়টিকে অনেকে কেন ভিন্নভাবে দেখেন, সেটা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। আমরা মনে করি বাংলাদেশে জুলাই সনদের অঙ্গীকারগুলো সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়ন করতে হলে, দেশের রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখতে হবে। বাংলাদেশ যেন আর কখনও ফ্যাসিবাদের দিকে না যায়, সে বিষয়ে সোচ্চার থাকতে হবে। হাসিনার রেখে যাওয়া সংবিধানের উপাদান যেন আর ফিরে না আসে, সেই আকাক্সক্ষার জায়গা থেকেই সবাইকে এক হতে হবে।’আর পিআর পদ্ধতিতে ভোট চেয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক শেষে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ এ কথা জানান।তিনি বলেন, নির্বাচনে সন্ত্রাস-অনিয়ম বন্ধ করতে হলে পিআর পদ্ধতিতে ভোট করতে হবে। সবাই সবকিছু না-ও চাইতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারও অনেকে চায়নি। জনগণ চাইলে অবশ্যই পিআর পদ্ধতি মানতে হবে। এই দাবি নিয়ে মাঠে থাকবে জামায়াত। পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও নেবে।ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেছেন, সনদে মতামত দিতে তারাও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলছেন। আইনি স্বীকৃতি ও প্রাধান্য না থাকলে সনদ অর্থহীন হয়ে যাবে।সময় বাড়িয়েও মতামত মেলেনি ৬ দলেরমতামত পাঠায়নি নাগরিক ঐক্য, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও ইসলামী ঐক্যজোট। জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়ার বিষয়ে মতামত জানাতে দুই দিন সময় বাড়িয়েও ছয় দলের কাছ থেকে সাড়া পায়নি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন বলছে, তারা ৩০টি দলের কাছে মতামত চেয়েছিল। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে ২৬টি দল মতামত জমা দিয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে ২০ আগস্টের মধ্যে মতামত পাঠানোর কথা ছিল দলগুলোর, পরে তা ২২ আগস্ট বিকাল ৩টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়। দ্বিতীয় দফার বৈঠক শেষে গত ১৬ আগস্ট সনদের চূড়ান্ত সমন্বিত খসড়ার কপি ৩০টি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠায় ঐকমত্য কমিশন।কমিশনের সঙ্গে আইনজ্ঞদের বৈঠকজুলাই সনদ-২০২৫ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিএনপির দাবি, আগামী সংসদে নির্বাচিত সরকার সনদ বাস্তবায়ন করবে। অন্যদিকে, জামায়াত ও এনসিপি সংসদ নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়নের দাবি তুলেছে। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে।গত রোবাবর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা সনদ বাস্তবায়নে দুটি কার্যকর পদ্ধতির প্রস্তাব দেন-গণভোট আয়োজন অথবা বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি। সনদের বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি নিয়ে বৈঠকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এবং চার বিশেষজ্ঞ অংশ নেন।বিশেষজ্ঞ প্যানেলে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ ড. শরিফ ভূঁইয়া ও ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক। কমিশনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।সূত্রে জানা গেছে, প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠকে জুলাই সনদের আইনি বাধ্যবাধকতা নিশ্চিতে গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ গ্রহণের পরামর্শ এসেছে আইন বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে।এর আগে, গত ১০ আগস্ট জাতীয় সংসদে এলডি হলে আইন বিশেষজ্ঞরা সনদ বাস্তবায়নে বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে অধ্যাদেশ জারির পরামর্শও দিয়েছিলেন। কিন্তুগত রোববারের বৈঠকে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন সম্ভব নয় মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।বৈঠক সূত্র বলছে, আইনি দিক বিবেচনা করে অধ্যাদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদের বাস্তবায়নের চিন্তা থেকে সরে এসেছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে সংবিধানে নিষেধাজ্ঞা আছে।বৈঠকে আইন বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে দুটি কার্যকর পদ্ধতি রয়েছে। তার মধ্যে প্রথম হচ্ছে, গণভোট। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি।বৈঠকে অংশ নেওয়া কমিশনের সংশ্লিষ্ট একজন জানান, এগুলো নির্ভর করছে জাতীয় সংসদের ওপর। পরবর্তী সংসদ চাইলে তা বাতিল করে দিতে পারে কিংবা আদালতও চাইলে বাতিল করে দিতে পারে।একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, গণভোটে গেলে জনগণের সরাসরি ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ থাকবে এবং এতে রাজনৈতিক চাপ তৈরি হবে। চাইলে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই ব্যালটে গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে। তবে তিনি গণভোটের অনিশ্চয়তাও উল্লেখ করেন।অন্য এক সদস্য বলেন, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের ক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া যাবে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও দীর্ঘ আন্দোলনে মানুষের ত্যাগ-রক্তের বিনিময়ে যে পরিবর্তন এসেছে, তা গুরুত্ব পেতে হবে। আদালতে এটিও টিকবে।বৈঠকে অংশ নেওয়া আরেকজন বিশেষজ্ঞের মতামত, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটে গেলে জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয় থাকবে। তখন একটা চাপ থাকবে। শেষ পর্যন্ত গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গে হতে পারে। সেইক্ষেত্রে ব্যালটে নির্বাচনী প্রতীকের পাশাপাশি জুলাই সনদের বিষয়টি থাকতে পারে। সেই আলোচনা বৈঠকে হয়েছে। পাশাপাশি গণভোটে কিছু অনিশ্চয়তার কথা এসেছে। সবকিছু মিলিয়ে কোনো পন্থা কিংবা পদ্ধতি যাওয়া কতটুকু উত্তম হবে তা নিয়ে নানান পরামর্শ আসলেও এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আজকে (রোববার) জুলাই সদস বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা আইনজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। সেখানে নানা ধরনের পরামর্শ এসেছে। তবে, এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।’তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্থায়ী সমাধান কেবল রাজনৈতিক ঐকমত্যের মাধ্যমেই সম্ভব। এর উদাহরণ হিসেবে তারা একাদশ সংবিধান সংশোধনের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে দলগুলোর সম্মতিতে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পরে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হন, যা আদালতে কখনো চ্যালেঞ্জ হয়নি।এবার জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো শেষ পর্যন্ত ঐকমত্য না হলেও জাতীর কপালে দুঃখ আছে বলেও মন্তব্য করেন কমিশনের একজন সদস্য।জাতীয় সনদের বাস্তবায়নের উপায় হিসেবে গণভোটসহ বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে বলে জানান কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, সেখানে গণভোট একটি বিকল্প ছিল। এ ছাড়া একাধিক বিকল্প নিয়ে আমরা বিবেচনা করছি।কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আইন মন্ত্রণালয় ঐকমত্য কমিশনকে জানিয়েছে, জুলাই সনদের কোন কোন প্রস্তাব দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য তা চিহ্নিত করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ব্যারিস্টার তানিম হোসেন শাওনকে ছয় মাসের জন্য বিশেষ পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।ভোরের আকাশ/এসএইচ