কেন বারবার বিতর্কে সমন্বয়করা
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের মসনদ উড়িয়ে দিয়ে জাতির আস্থায় আসা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃত্বের সমন্বয়করা ক্ষমতা প্রদর্শন, তদবিরবাজ, চাঁদাবাজি, দখলবাজসহ নানা বির্তকে জড়িয়ে পড়েছে। ফ্যাসিস্টবিরোধী জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের প্রতি শুরুতেই দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল সীমাহীন। তবে দিন দিন নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের সেই প্রত্যাশায় ভাটার টান লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। তরুণ নেতৃত্বে গড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা, সমন্বয়হীনতা, কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও সামনে আসে। চাঁদাবাজিসহ নানামুখী কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ ও ইমেজ সংকটের একপর্যায়ে গত কয়েক দিন আগে কেন্দ্রীয় কমিটির বাদে সারাদেশের সকল কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। কমিটির কার্যক্রম স্থগিত হলেও চাঁদাবাজি ও দখলবাজি চালিয়ে যাচ্ছে সমন্বয় পরিচয়ে।গত ২৯ জুলাই মহসিন রেজা, রিমন খান, রায়হান আহমেদসহ একটি দল রাজধানীর মতিঝিলের একটি বাণিজ্যিক ভবন দখলের চেষ্টা করেন। ভবন কর্তৃপক্ষ পুলিশের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে মতিঝিল থানা পুলিশ গেলে ক্ষিপ্ত হন সমন্বয়করা। কেন সেখানে পুলিশ পাঠানো হলো সে কৈফিয়ত চাইতে পরদিন ৩০ জুলাই থানায় যান সমন্বয়করা। তারা মব সৃষ্টি করে পুলিশের ওপর হামলার চেষ্টা করলে তিন সমন্বয়ককে আটক করা হয়।এ বিষয়ে ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, মতিঝিল বাণিজ্যিক ওই ভবনে কয়েকটি ব্যাংকের অফিস রয়েছে। একটা পত্রিকা অফিসও রয়েছে। ভবন কর্তৃপক্ষ পুলিশের সহায়তা চাইলে পুলিশ সেখানে যায়। পুলিশ কেন সেখানে গিয়েছে সে কৈফিয়ত চাইতে থানায় আসেন সমন্বয়করা। তারা পুলিশকে ভয়ভীতি দেখান এবং হৈ-হুল্লোর সৃষ্টি করেন। পরে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে তিনজনকে আটক করে এবং তারাসহ অজ্ঞাত বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে মামলা করা হয়।এদিকে, বৃহস্পতিবার ৩১ জুলাই বিকালে ঝালকাঠি এলজিইডি অফিসে আওয়ামী লীগের এক ঠিকাদারের তদবির করতে গিয়ে জনতার হাতে আটক হয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিলুপ্ত কমিটির দুই নেতা। পরে পুলিশ তাদের আটক করে সদর থানায় নিলে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যস্থতায় মুচলেকা দিয়ে তারা মুক্তি পান। ওই দুই নেতা হলেন, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্যসচিব সিরাজুল ইসলাম ও বরিশাল গ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মেহেদী হাসান।গত ২৬ জুলাই শনিবার রাতে রাজধানীর গুলশানে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয় পাঁচজন। চাঁদাবাজির ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আবদুর রাজ্জাকসহ (রিয়াদসহ) চারজনকে সাত দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। রিমান্ডপ্রাপ্ত অপর তিন আসামি হলেন সাকদাউন সিয়াম, সাদমান সাদাব ও ইব্রাহিম হোসেন। এ পরিস্থিতিতে গতকাল রোববার কেন্দ্রীয় কমিটিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সব কমিটি বাতিল করা হয়েছে।বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় শুক্রবার (১ আগস্ট) রাতে নিজেদের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট দিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শরীয়তপুর জেলা সমন্বয় কমিটির দুই নেতা পদত্যাগ করেছেন। এ দুজন হলেন- জেলা সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ডামুড্যা উপজেলা কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী তারিকুল ইসলাম এবং জেলা কমিটির সদস্য পলাশ খান। তারা ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগের কথা জানিয়েছেন। যদিও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে লিখিত পদত্যাগপত্র জমা দেননি। এক বছরের ব্যবধানে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ঘিরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। সাম্প্রতিক সময়ে নানান বিতর্কে তরুণ নেতৃত্বের ইমেজ ধরে রাখাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।গত বছরের সেপ্টেম্বরে সাভারে সমন্বয়ক পরিচয়ধারী এক যুবককে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দের পর মামলা দায়ের করা হয়েছে। তিনি দলবল নিয়ে একটি বাড়িতে তল্লাশির জন্য গিয়ে চাঁদা দাবি করেছিলেন। অনেক ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি বা অবৈধ আর্থিক লেনদেনসহ নানা অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া অভিযোগ উঠছে খোদ অন্তর্বতীকালীন সরকারের ছাত্র উপদেষ্টা ও সমন্বয়কদের বিরুদ্ধেও। নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার ও বিতর্কের অবসান না ঘটালে অচিরেই দেশের মানুষের কাছে তারা গ্রহণযোগ্যতা হারাতে পারেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।এ প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি রিফাত রশিদ বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানার ব্যবহার করে নামে-বেনামে অনেক ধরনের অপকর্ম করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিভিন্ন রাজনৈতিক শেল্টারে বা তারা বিপথগামী হয়ে চাঁদাবাজি, দুর্নীতিতে জড়িয়েছে, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই আমরা কেন্দ্রীয় কমিটি বাদে সব কমিটির কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করছি। এরপর থেকে বৈষম্যবিরোধীর ব্যানার ব্যবহার করে কোনো ধরনের অপকর্ম করা হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন রিফাত রশিদ।তিনি আরও জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আগামীতে কিভাবে পরিচালিত হবে সে বিষয়ে শিগগিরই সিদ্ধান্ত জানানো হবে। রাজধানীর গুলশানে একজন সাবেক সংসদ সদস্যের বাসায় চাঁদাবাজি করতে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন নেতা; গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের এক নেতাসহ পাঁচজন গ্রেপ্তার হওয়ার পরদিন এই সিদ্ধান্ত জানাল সংগঠনটি।অপরদিকে, ঘটনাটিকে ঘিরে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সংগঠনের সাবেক নেত্রী ফাতেমা উমামা। তিনি ২৬ জুলাই শনিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশের ভানকে হাস্যকর বলে মন্তব্য করেন। তার মতে, ঘটনার শেকড় অনেক গভীরে, আর বিস্ময় প্রকাশের ভঙ্গিমা আসলে সত্যিকারের পরিস্থিতি ঢাকার চেষ্টা।নিজের ফেসবুক পোস্টে উমামা লেখেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত পাঁচজনের চাঁদাবাজির খবর শুনে আমার পরিচিত অনেকেই এতটাই ‘বিস্মিত’ হয়েছেন যে মনে হচ্ছে, এই ঘটনায় আমিই সবচেয়ে কম অবাক হয়েছি। এই ছেলেগুলোকে তো বহুদিন ধরে নেতাদের প্রটোকল দিতে দেখেছি। এমনকি সচিবালয় থেকে শুরু করে মিছিল-মিটিং, সংঘর্ষেও ক্ষেত্রেও তারা সামনে থেকে কাজ করেছে। সমন্বয়কদের ডানহাত-বামহাত হিসেবে এদের পরিচিতি ছিল। গুলশান-বনানী গ্যাং কালচারের সঙ্গে যুক্ত থাকার অসংখ্য অভ্যন্তরীণ অভিযোগ আগে থেকেই ছিল এদের বিরুদ্ধে।উমামা ওই পোস্টে আটক হওয়া যুককদের একটি ছবি যুক্ত করে একজনকে উদ্দেশ করে বলেন, ছবিতে থাকা রিয়াদ নামের এই ছেলেটি গত ডিসেম্বরে রূপায়ন টাওয়ারে আমার সামনে চরম উশৃঙ্খল আচরণ করেছিল। আমরা কয়েকজন মেয়ে তাকে শান্ত করতে গেলে সে উল্টো আমাদের ওপর চড়াও হয়।পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, তার বিরুদ্ধে আগেও হুমকি, মারধর ও চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল। আমি খুব একটা অবাক হইনি, কারণ তখনই বুঝে গিয়েছিলাম, বেষম্যবিরোধী মঞ্চে এরকম মানুষের অবাধ আনাগোনা চলছে। রূপায়ন টাওয়ারে এদের প্রবেশ ছিল অবাধ, কেউ দুর্নীতি বা অসততার অভিযোগ তুললে কোনো জবাব আসত না, শুধু নিস্তব্ধতা। আমি নিজে দেখেছি, এসব লোক কীভাবে অবলীলায় সংগঠনের ভেতরে প্রবেশাধিকার পেয়ে যেত। এখন এতদিন পর এই প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকালে ভাষা হারিয়ে ফেলি যেভাবে পেরেছে, প্ল্যাটফর্মটিকে নষ্ট করেছে। চাঁদাবাজির খবর প্রকাশের পর চারদিকে যে ‘বিস্ময়’ দেখা যাচ্ছে, তা নিয়ে তীব্র কটাক্ষ করেন উমামা।তিনি বলেন, ‘ইশ! মানুষ কতটাই না নিষ্পাপ! সদ্যজাত শিশুর মতো আজ তারা ‘আবিষ্কার’ করেছেন এই ছেলেগুলো চাঁদাবাজি করছিল! কিন্তু দুঃখের বিষয়, এটিই প্রথম ঘটনা নয়, এই প্রথম তারা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে মাত্র। একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে, এদের শিকড় অনেক গভীরে। শনিবার সন্ধ্যায় সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে আটক ৫ জন হল মো. সিয়াম, সাদমান সাদাব, মো. আমিনুল ইসলাম, ইব্রাহীম হোসেন ও আব্দুর রাজ্জাক রিয়াদ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যতটা প্রত্যাশা নিয়ে গঠন করা হয়েছে তরুণদের এ দল, ততটাই হতাশা উপহার দিয়েছে তারা। পরে একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন দলটির নেতাকর্মীরা। এনসিপির জ্যেষ্ঠ মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন ‘চাঁদাবাজ’ নেতাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। নিজ দল থেকে শোকজও করা হয় তাকে। এর আগে মোংলা সমুদ্রবন্দর ইস্যুতে জড়িয়ে সমালোচিত হন তিনি।গত ২৭ জুলাই রাজধানীর হাজারীবাগে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) এক সদস্যের বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভনে ‘ধর্ষণের’ অভিযোগ করেছেন এক নারী। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী নারীর পক্ষে হাজারীবাগ থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ বাদী হয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে। প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে মামলা নেওয়া হবে।সম্প্রতি প্রতি জুলাই অভ্যুত্থানকে ‘মানি মেকিং মেশিনে’ পরিণত করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। আলোচিত নেত্রী নীলা ইস্রাফিল এনসিপিতে অপরাধীর বিচার হয় না এমন অভিযোগ এনে দলটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে পদত্যাগ করতে দেখা গেছে এনসিপির অনেক নেতাকে। যাদের অনেকেই বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে প্রকাশ্যেই বক্তব্য রেখেছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের বছর না পেরোতেই এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলেছেন, সমন্বয়কেরা বৈষম্যবিরোধী কথা বললেও নিজেরাই বৈষম্য করছে। তাদের কিছুসংখ্যক নেতা চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি ও তদবির বাণিজ্যে জড়িত হয়ে পুরো আন্দোলনের নেতাদের ইমেজ নষ্ট করছেন। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার গুলশানে সাবেক এক এমপির বাসায় সমন্বয়ক পরিচয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়।এ ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর থেকে দেশের রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে সামাজিক মাধ্যমে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের এই সংগঠন। সমালোচনার মুখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়া সব কমিটি স্থগিত ঘোষণা করা হয়। চলমান এই সমালোচনায় রীতিমতো ‘ঘি ঢালা’র পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সংগঠনটির সাবেক মুখপাত্র ও কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক উমামা ফাতেমার কয়েকটি ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে। তিনি বলেন, জুলাইকে ‘মানি মেকিং মেশিনে’ পরিণত করা হয়েছে। দীর্ঘ এক ফেসবুক লাইভে সংগঠনটির সাবেক এই নেত্রী বলেন, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা সবাই গিয়েছি। ৫ আগস্টের পরদিন সকালবেলা থেকেই দেখি, সমন্বয়ক পরিচয়ে নাকি একেকজন একেক জায়গায় গিয়ে দখল করছে! আমি একরকম অবাক হয়ে যাই যে গতকাল পর্যন্ত তো সমন্বয়ক পরিচয়টা দিতেই চাইছিল না আর আজকে থেকে শুনছি সবাই সমন্বয়ক এই পরিচয়ে চাঁদাবাজি-দখল চলছে। ...আমার মনে হচ্ছিল, এখন কি রক্ষীবাহিনীর মতো সমন্বয়ক বাহিনী তৈরি হচ্ছে!’এ ছাড়া এনসিপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দলটির আলোচিত নেত্রী নীলা ইসরাফিল অভিযোগ করেন, এনসিপিতে অপরাধীর বিচার হয় না।ফেসবুক পোস্টে নীলা ইসরাফিল বলেন, তিনি এনসিপিকে ‘নীতিহীন’ এবং ‘প্রত্যাখ্যাত’ দল হিসেবে উল্লেখ করেন। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কয়েকজন নেতা গত কয়েক মাসে নানা ঘটনায় আলোচনায় এসেছেন। যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে গত এপ্রিলে দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ঢাকার ধানমন্ডির একটি বাড়িতে সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে মব হামলার পর আটককৃতদের থানা থেকে ছাড়িয়ে এনে আলোচনায় এসেছিলেন এনসিপির আরেকজন নেতা আব্দুল হান্নান মাসুদ। তাকেও গত মে মাসে ওই ঘটনার পর দল থেকে শোকজ করা হয়েছিল। এর আগে গত বছরের আগস্টের পর থেকে সারা দেশেই সমন্বয়ক পরিচয়ে ক্ষমতা প্রদর্শন, চাঁদাবাজি, তদবিরসহ নানা অভিযোগ আসতে থাকে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সাভারে সমন্বয়ক পরিচয়ধারী এক যুবককে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দের পর মামলা দায়ের করা হয়েছে। তিনি দলবল নিয়ে একটি বাড়িতে তল্লাশির জন্য গিয়ে চাঁদা দাবি করেছিলেন। গত বছরের ডিসেম্বরের প্রতারণা, চাঁদাবাজি ও মানহানির অভিযোগে করা এক মামলায় ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কথিত সমন্বয়ককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষের কাছে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন। এই প্ল্যাটফর্মের রংপুরের এক নেতার গত মার্চ মাসে ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ভিডিও ও অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হয়। চলতি বছরের এপ্রিলে খুলনা নগরীতে একটি বাড়িতে ঢুকে গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবি ও সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে চার শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে জনতা।ছাত্রনেতাদের নানান অভিযোগের বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক হাসান ইনাম জানান, জুলাই আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নানা ধরনের মানুষ একসঙ্গে হয়েছে এবং তখন অল্প সময়ের মধ্যে তাদের সবাইকে চেনা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ঠিকাদারি লাইসেন্সে ইস্যুতে আলোচনায় আসার পর ছাত্র প্রতিনিধি ও অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার বাবা ইয়াকুব আলী ভূঁইয়ার ‘ভুলের জন্য’ ক্ষমা চান। তবে আবারও আলোচনায় এই তরুণ উপদেষ্টা বাবার ঘটনা।সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, ইয়াকুব আলী ভূঁইয়া ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে এলাকাছাড়া করেছেন তিন পরিবারকে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কুমিল্লার মুরদনগরের বাসিন্দা রিক্তা আক্তার, শিখা রানী, মোহাম্মদ আলীসহ স্থানীয় ভুক্তভোগীদের অভিযোগ দলীয় পরিচয় ও ক্ষমতার ছত্রছায়ায় আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।এ ছাড়া প্রতিবেদনে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর একই এলাকার আকুবপুর ইয়াকুব আলী ভূঁইয়া পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ে ঘটে আরও একটি ঘটনাও উঠে আসে। এ ঘটনার ভুক্তভোগী ওই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক শিখা রানীর অভিযোগ, ওই দিন তাকে স্কুলের একটি কক্ষে আটকে রেখে প্রথমে পদত্যাগের জন্য চাপ দেওয়া হয়। রাজি না হলে একপর্যায়ে তার ওপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। পরে তাকে স্কুল থেকে বের করে ঘোরানো হয় গ্রামের প্রধান সড়কগুলোয়, যার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেই ভিডিওতে শিখা রানীকে হেনস্তাকারীদের দলে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বাবা ওই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক বিল্লাল হোসাইনকেও দেখা যায়।এদিকে, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে কুমিল্লার মুরাদনগরে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে সাংবাদিকসহ অন্তত ১৫ জন আহত হন। এদিকে আলোচনায় এসেছে ছাত্রশিবিরের নেতা সাদিক কায়েমের সাম্প্রতিক এক টকশোর একটি বক্তব্যকে ঘিরে।সেখানে তিনি জানান, জুলাই অভ্যুত্থান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গঠন প্রক্রিয়ায় ছাত্রশিবির সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল। গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রশিবিরের নির্দেশেই কাজ করেছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। যদিও সাদিক কায়েমের এই দাবিকে ‘মিথ্যাচার’ বলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) নাহিদ ইসলাম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক দীর্ঘ পোস্টে বলেন, শিবির নেতা সাদিক কায়েম সম্প্রতি একটা টকশোতে বলেছেন, ছাত্রশক্তির গঠন প্রক্রিয়ায় শিবির যুক্ত ছিল, শিবিরের ইনস্ট্রাকশনে আমরা কাজ করতাম।এটা মিথ্যাচার। ‘গুরুবার আড্ডা’ পাঠচক্রের সঙ্গে জড়িত একটা অংশ এবং ঢাবি ছাত্র অধিকার থেকে পদত্যাগ করা একটা অংশ মিলে ছাত্রশক্তি গঠিত হয়। সঙ্গে জাবির একটা স্ট্যাডি সার্কেলও যুক্ত হয়। একটা নতুন ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুবার আড্ডা পাঠচক্রে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা হয়েছে। আমরা ক্যাম্পাসে আট বছর রাজনীতি করছি। ফলে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব সংগঠন ও নেতৃত্বকে আমরা চিনতাম এবং সব পক্ষের সঙ্গেই আমাদের যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিল। সে কারণে ঢাবি শিবিরের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। যোগাযোগ, সম্পর্ক বা কখনো সহযোগিতা করা মানে এই না যে তারা আমাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল। দ্বিতীয়ত, সাদিক কায়েম বৈষম্যেবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সমন্বয়ক ছিল না। কিন্তু ৫ আগস্ট থেকে এই পরিচয় সে ব্যবহার করেছে।সমাজ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির অনেকেই চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, ঘুষ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনৈতিক ও সমালোচিত প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন। তাদের সাংগঠনিক ব্যবস্থার প্রভাব দৃশ্যমান নয়। পূর্ব বোঝাপড়া করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিলে তা কোনো পরিবর্তনও আনবে না। কঠোর আইনগত ব্যবস্থা না নিলে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে অপরাধ প্রবণতা বাড়বে বলে মনে করি।এ প্রসঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান শনিবার সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে বলেন, বেষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মটা এখন বৈষম্য সৃষ্টির প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। এটার পবিত্রতা রক্ষায় প্ল্যাটফর্মটির কার্যক্রম স্থায়ীভাবে স্থগিত রাখা দরকার। এই প্ল্যাটফর্মের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে সত্য। কিন্তু ১ বছরে সমন্বয়ক ও ছাত্র প্রতিনিধির পরিচয়ে যেভাবে চাঁদাবাজি, তদবির বাণিজ্য, প্রমোশন ও রদবদল ইত্যাদি হয়েছে, এই প্ল্যাটফর্মের বর্তমান সুনাম ‘মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের’ মত।গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী এই প্ল্যাটফর্মের এমন অপমৃত্যু কারও প্রত্যাশিত ছিল না উল্লেখ করে রাশেদ খান বলেন, এই প্ল্যাটফর্ম বা সমন্বয়ক পদ ইত্যাদির প্রতি মানুষের যতো নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ পাবে, আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের ততো ঘৃণা প্রশমিত ও জুলাই নিয়ে আগ্রহ-প্রত্যাশা মলিন হবে। কিন্তু মনে হচ্ছে প্ল্যাটফর্মটিকে বিতর্কের মধ্যে রাখা কারও কারও উদ্দেশ্য। সেই বিতর্কের ফাঁদে যদি স্বয়ং রাজনীতিক, ছাত্র সংগঠক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা পা দেয়, তা হবে দুঃখজনক বলেও উল্লেখ করেন তিনি।এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার ৩১ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেন, ভুয়া সমন্বয়কদের উত্থান নতুন এক সংকট তৈরি করছে। এখনই প্রতিরোধ না করলে ভবিষ্যতে তা ভয়াবহ রূপ নেবে। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর ‘সিক্সটিন ডিভিশন’ নামে একটি বাহিনী আবির্ভূত হয়েছিল। এখনো তেমন একটি নতুন সংকট মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে- ভুয়া সমন্বয়ক।তিনি আরও বলেন, সরকার পাল্টায়, সরকার চলে যায়। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়কে এতটা জায়গা দিয়েছি যে, এখন সামাল দেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, অভুত্থানের পরপরই এনসিপি গঠিত হয়। নতুন দলটি ঘিরে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের আশার বলয় তৈরি হয়। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অবস্থায় দেশের মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়ে দেশকে একটি নতুন বন্দোবস্তের দিকে ধাবিত করার কথা ছিল। দলটি প্রতিষ্ঠার সময় অন্যতম লক্ষ্যই ছিল চলমান ব্যবস্থার সংস্কার করা এবং সংস্কারের বার্তা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া। নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে নেতাকর্মীদের কার্যকলাপ মনিটরিং করা সম্ভব নয়। তবে, দলের পদ দেওয়ার সময় অবশ্যই যাচাইবাছাই করে যোগ্য ব্যক্তিদের হাতে দায়িত্ব দেওয়া উচিত। তা না হলে যে জন-প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করছে, সেখানে তারা পৌঁছাতে পারবে না।তিনি বলেন, দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ খুবই জটিল। সেখান থেকে এনসিপিও মুক্ত নয়। ফলে, তারাও অনেক চাপের মধ্যে পড়েছে। একই সঙ্গে, এনসিপির মধ্যে যে সমস্যাগুলো দৃশ্যমান হয়েছে, সেগুলো কাটিয়ে উঠতে না পারলে তাদের নতুন বন্দোবস্ত বাধার মুখে পড়বে বলে ধারণা করি।ভোরের আকাশ/এসএইচ