মো. রেজাউর রহিম
প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০২৫ ১২:৪৯ এএম
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪ এর জুলাই আন্দোলন ও ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ বিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণের মূল প্রত্যাশা হচ্ছে- দেশে যেন আর নতুন করে কোন রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক শক্তি স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদী শক্তিতে রুপান্তরিত না হতে পারে। স্বৈরাচার-ফ্যাসিবাদবিরোধী সকল রাজনৈতিক শক্তির প্রত্যাশাও একই রকম। আর এ আকাঙ্ক্ষাকে সন্মান জানিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রণয়ন করেছে জুলাই সনদ। তবে বিপত্তি সৃষ্টি হয়েছে জুলাই সনদের বাস্তবায়নের বিষয়টি নিয়ে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে এক এক রাজনৈতিক দলের এক এক রকম মত। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে মতানৈক্য।
ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার এই মতানৈক্য দূর করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ‘জুলাই সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নে জুলাই আদেশ জারি করার সুপারিশ করতে যাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য এই আদেশের ওপর দেশব্যাপী গণভোটের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এই গণভোটে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জনগণের সিদ্বান্তকেই সরকার চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচনা করবে। এছাড়া ‘জুলাই আদেশ’ সংবিধানের সমতুল্য মর্যাদাও পেতে পারে বলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়সহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ‘জুলাই সনদ-২০২৫’ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার মতভেদ দূর করতে জনগণের মতামত নেওয়ার জন্যই সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছে। আর যেহেতু এখনও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং কয়েকটি রাজনৈতিক দল জুলাই সনদের বাস্তবায়নের বিষয় নিয়ে মতভেদের কারণে সনদে স্বাক্ষর করেনি, এ জন্য দেশের ভোটারদের মতামত নেওয়ার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, এ গণভোটে দেশের ভোটারদের একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। প্রশ্নটি থাকবে- ‘আপনি কি জুলাই আদেশ সমর্থন করেন’? আর ভোটাররা ব্যালটে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ উত্তর দেবেন। গণভোটে অনুমোদন পেলে এ আদেশই হবে ‘জুলাই জাতীয় সনদের’ আইনি ভিত্তি।
সূত্র জানায়, শিগগির এ বিষয়ে আদেশ জারি করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি বর্তমানে সরকারের নির্বাহী বিভাগের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। আর জুলাই সনদ প্রণয়নের কাজে জড়িত কমিশনের কাছে বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে এ বিষয়ে একটি খসড়া প্রস্তাবনাও জমা দিয়েছেন।
এদিকে গত বুধবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ। বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এমএ মতিন, মঈনুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শরীফ ভুঁইয়া, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক ও তানিম হোসেইন শাওন। এ বৈঠকে আলোচনার ভিত্তিতে কমিশন শিগগির পর্যালোচনা বৈঠক করবেন এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পুনরায় বৈঠক করে চূড়ান্ত মতামত পেশ করবে। আর সেসব মতামতের ভিত্তিতেই শিগগির প্রধান উপদেষ্টার কাছে চূড়ান্ত সুপারিশ জমা দেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, ‘জুলাই আদেশ’ সংবিধানের সমতুল্য মর্যাদাও পেতে পারে। আর এর আনুষ্ঠানিক নাম হবে ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ’। আর ‘গণভোট’ এর মাধ্যমেই এই আদেশের বৈধতা প্রতিষ্ঠিত হবে। আর ‘গণভোটে’ পাস হলে আদেশ কার্যকর হওয়ার পরই শুরু হবে সংস্কার ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া।
জানা গেছে, এ আদেশ বাস্তবায়ন হলে আগামী জাতীয় সংসদের দায়িত্ব হবে মূলত দুটি, একটি হচ্ছে- জাতীয় সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করে সংস্কার বাস্তবায়ন করা। আর অন্যটি হলো- সংবিধান সংশোধনের পর নিয়মিত আইনসভা হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করা।
জানা গেছে, কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, একজন ব্যক্তির তিনটি পদে না থাকা (নির্বাহী বিভাগের প্রধান, সংসদ নেতা ও দলের প্রধান) এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের নতুন নীতিমালা-এসব বিষয়ই আদেশে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রথমে সাংবিধানিক আদেশ জারি করে গণভোট আয়োজন করা। আর যেহেতু বর্তমান সংবিধান সংসদকে মৌলিক পরিবর্তনের ক্ষমতা দেয় না, তাই গণভোটের মাধ্যমে সংসদকে সেই ক্ষমতা প্রদান করা। এছাড়া গণভোটে অনুমোদিত হলে সংসদের প্রথম অধিবেশন হবে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’, যা জুলাই সনদের আলোকে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে। এরপর সংসদ তার স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরে যাবে। তবে গণভোটের তারিখ এখনও নির্ধারিত হয়নি। সরকার ও নির্বাচন কমিশন যৌথভাবে গণভোটের তারিখ নির্ধারণ করবে।
এদিকে ইতোমধ্যে জুলাই সনদে ২৫টি রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করেছে। গত ১৭ অক্টোবর বিএনপি, জামায়াতসহ ২৪টি দল স্বাক্ষর করে, পরদিন স্বাক্ষর করে গণফোরাম। তবে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখনো সই করেনি। এনসিপির বক্তব্য, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের লিখিত কপি এবং গণভোটের প্রশ্নটি আগে জনগণের কাছে প্রকাশ করতে হবে, তারপর দলটি স্বাক্ষরের বিষয়টির সিদ্ধান্ত নেবে।
অন্যদিকে, গণভোটের সময়সূচি নিয়েও দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। বিএনপি চায় জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে ভিন্ন ব্যালটে হোক। জামায়াত ও এনসিপি চায়- আগে গণভোট, পরে জাতীয় নির্বাচন। এ নিয়ে জামায়াতসহ আটটি দল মাঠপর্যায়ে আন্দোলনও চালিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে গত বুধবার ঐকমত্য কমিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সভায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিভিন্ন প্রস্তাব পর্যালোচনা করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রাপ্ত পরামর্শ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে। এসব বিষয়ে কমিশন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে এবং শিগগির বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পুনরায় বৈঠকের মাধ্যমে এ বিষয়ে চূড়ান্ত মতামত নেবে।
ঐকমত্য কমিশনের এ বৈঠকে কমিশনের সদস্যদের মধ্যে বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া ও সফর রাজ হোসেন উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ