মো. রেজাউর রহিম
প্রকাশ : ২৩ অক্টোবর ২০২৫ ১২:৩৫ এএম
ছবি: সংগৃহীত
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুনের ঘটনায় আগুন বা যে কোনো দুর্যোগ প্রতিরোধে বছরের পর বছর অগ্নিনির্বাপণ ‘মহড়ায়’ খুব দক্ষতা দেখিয়ে বাহবা কুড়ালেও বাস্তবে বিষয়টি অনেকটা ‘শুভংকরের ফাঁকি’। বিমানবন্দরের গত শনিবারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ব্যর্থতার মুখে পড়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) নিজস্ব ফায়ার ইউনিট। মাত্র ২৮০ মিটার দূরত্বের আগুনও ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি বেবিচকের ফায়ার ইউনিট। আর শুরুতে এই আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এড়ানো যেতো প্রায় হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি। এছাড়া বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুনের ঘটনায় দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ফায়ার ইউনিটের সক্ষমতা ও কার্যক্রম এবং নাজুক অবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের অর্থনীতি এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুতপূর্ণ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিজেদের সক্ষমতা জানান দিতে রানওয়ের পাশে বছরে বেশ কয়েকবার ‘মহড়া’র আয়োজন করে বেবিচক। এ মহড়ায় অংশ নিয়ে নিজেদের নানান ‘কসরত’ দেখান বেবিচকের নিজস্ব ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা। মহড়া শেষে করতালির মাধ্যমে বেশ ‘সন্তুষ্টচিত্তে’ বাহবাও দেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বাস্তবে বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুনে যখন হাজার কোটি টাকার সম্পদ পুড়ছিল এবং বিমানবন্দর কার্যত বন্ধ ছিল, সে অবস্থায় তারা দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।
যদিও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা এবং বেবিচক চেয়ারম্যান শেখ বসির দাবি করেছেন, আগুন লাগার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছান বেবিচকের নিজস্ব ফায়ার কর্মীরা। তবে প্রশ্ন উঠেছে, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে যদি ঘটনাস্থলে ফায়ার কর্মীরা পৌঁছে থাকেন, তাহলে তারা আগুন দ্রুত কেন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেন না- এ প্রশ্ন উঠেছে। আর ৩০ সেকেন্ডে তো পুরো কার্গো ভিলেজে আগুন ছড়ানোর কথা নয়। আবার এটি বড় কোনো বিস্ফোরণের ঘটনাও নয়, যেটা মুহূর্তেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাহলে কি কোনো নাশকতা? এ প্রশ্নও আছে জনমনে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, বেবিচকের নিজস্ব ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের গাফিলতি ও অদক্ষতার কারণে ওই আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়নি। আবার বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে থাকা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সংশ্লিষ্টদেরও দায়ও কম নয়। কারণ, কার্গো ভিলেজের সামনের অ্যাপ্রোনে আমদানি করা শত শত টন মালামাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছিল বিমান। ফলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি কার্গো ভিলেজের কাছে দ্রুত পৌঁছতে পারেনি। যদিও পাইপ দিয়ে অনেক দূরের আগুনও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
উল্লেখ্য, গত শনিবার শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগে এবং আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে সবমিলিয়ে প্রায় ২৭ ঘণ্টা সময় লাগে। বিমানবন্দরের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট। সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি ও আনসার সদস্যরাও আগুন নির্বাপনে যোগ দেন। ভয়াবহ এই আগুনের কারণে কিছু আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল ও অন্য বিমানবন্দরে অবতরণও করাতে হয়েছে। আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে লাগা আগুনে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাসহ আমদানিকারকদের পণ্য সামগ্রীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে, বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং তথা উড়োজাহাজে পণ্য ওঠানো-নামানো এবং সরবরাহের কাজটি করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এরই অংশ হিসেবে তারা কার্গো ভিলেজের সামনে অ্যাপ্রোনে মালামালস্তূপ করে রাখে।
এর মধ্যে গত শনিবার দুপুর ২টায় কার্গো ভিলেজের ভেতরে আগুন লাগে। তখন বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের (এটিসি) মাধ্যমে বার্তা যায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ফায়ার স্টেশনে। নির্দেশনা পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যায় দুটি ইউনিট (প্রতিটি ইউনিটে ছয়জন করে সদস্য)। তবে অ্যাপ্রোনে অগোছালোভাবে রাখা পণ্যের স্তূপের কারণে তারা উৎসের কাছে গিয়ে আগুন নেভানোর সুযোগ পায়নি। আর দূর থেকে পানি ছিটিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানবন্দরের কয়েকজন ফায়ার কর্মী ভোরের আকাশকে জানান, বিমানবন্দরে মোট চারটি পানির গাড়ি আছে, এর মধ্যে একটি অকেজো। তাই যখন কার্গোতে আগুন লাগে, তখন বিমানবন্দরে ফ্লাইটও ওঠা-নামা করছিল। তাই দুটি গাড়ি নিয়ে তারা আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু যেখানে ফায়ারের গাড়ি রাখা হয়েছে, সেখান থেকে আগুনের উৎস পর্যন্ত পাইপ ঘুরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছিল না। অর্থাৎ, এত লম্বা পাইপ গাড়িতে ছিল না। তাই বাইরে থেকে ছড়িয়ে সঠিক জায়গায় পানি পৌঁছানো যায়নি।
এর মধ্যে বাতাসে আগুন চারপাশে ছড়াতে থাকে। আবার বিমানবন্দর চালু থাকায় বাকি একটি গাড়িও এখানে আনা সম্ভব হচ্ছিল না। নিয়ম অনুযায়ী, বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছাকাছি অন্তত দুটি ফায়ার গাড়ি সবসময় প্রস্তুত রাখতে হয় বলে জানান তারা।
জানা গেছে, আগুনের ঘটনায় কিছু সময় পর ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি বিমানবন্দরে প্রবেশের চেষ্টা করে। তবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কারণে তারা আগুন নেভাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি। আবার বিমান দ্রুত পণ্যগুলো সরিয়ে দিতে পারলে কাছাকাছি গিয়ে পানি ছিটানো যেতো। তাহলে আগুন এত ছড়িয়ে পড়তো না, এত ক্ষয়ক্ষতিও হতো না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিমানবন্দরের নিজস্ব ফায়ার স্টেশনের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে যাওয়ার ১০ মিনিট পরে যায় বিমানবাহিনীর ফায়ার ইউনিট।
এরপর সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলো আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়। আগুন নেভাতে ১৩টি ফায়ার স্টেশনের ৩৭টি ইউনিট এবং সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার সদস্যরা কাজ করে। প্রায় সাত ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। রাত ৯টার দিকে বিমানবন্দর চালু হয়। আর আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয় প্রায় ২৭ ঘণ্টা পর। বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম জানান, অগিনকাণ্ডের ঘটনায় বিমান একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে কারও গাফিলতি থাকলে তা তদন্তে উঠে আসবে।
অন্যদের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা বেবিচকের
এদিকে, বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ডের তিনদিন পর গত মঙ্গলবার বেবিচকের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পুরো বিষয় তুলে ধরেন বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক। তবে বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আমদানি কমপ্লেক্সে যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে তার কোনো দায় নেননি তিনি।
তিনি বলেন, কার্গো ভিলেজটি বেবিচকের হলেও এটির কার্যক্রম পরিচালনা করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, সিঅ্যান্ডএফ (ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং) এজেন্ট ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে সেখানে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে আছে বিমান। আর মালামালগুলো ক্লিয়ার করার দায়িত্ব সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের।
এছাড়া সেখানে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ রয়েছে, এগুলো ম্যানেজ করার দায়িত্ব তাদের। তবে তদন্তসম্পন্ন হওয়ার আগে কাউকে দায় দিতে চান না বলে উল্লেখ করেন তিনি। আর সংবাদ সম্মেলনে বেবিচক চেয়ারম্যান তাদের নিজস্ব ফায়ার স্টেশনের সক্ষমতা কতটুকু আছে সে বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন বারবার এড়িয়ে যান।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে প্রায় ১৪০টি ফায়ার এক্সটিংগুইশার ছিল। আমরা কাগজপত্রে প্রমাণ পেয়েছি, নিয়মিত ফায়ার সেফটি কার্যক্রম চলতো। শুধু জুন মাসেই প্রায় ২০০ জন কর্মীকে ফায়ার ড্রিল প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া প্রতি সপ্তাহে একদিন আমরা ফায়ার ড্রিল অনুশীলন করি। এটি সাধারণত বিমান সংক্রান্ত দুর্ঘটনা বা আগুনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য করা হয়। এর বাইরে প্রতিদিন আমাদের ফায়ার টিম বিভিন্ন সেকশনে গিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালায়।’
তদন্ত কমিটি গঠন
শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে ওইদিন রাতেই সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এই কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে (২৩ অক্টোবর) প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এই কমিটি অগ্নিকাণ্ডের কারণ, ক্ষয়ক্ষতি এবং কার কী দায়দায়িত্ব ছিল তা নির্ধারণ করবে।
অন্যদিকে ঘটনা তদন্তে গত সোমবার পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। পাঁচ সদস্যের এই তদন্ত কমিটির সভাপতি করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে। কমিটির সদস্যদের ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া রোববার বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করেছে। সবকটি কমিটি তাদের তদন্ত কাজ চালাচ্ছে বলে জানা গেছে।
শাহজালাল বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক মান অবনতির শঙ্কা
শাহজালাল বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইসিএও) সদস্য। এ সংস্থা বেসামরিক বিমান চলাচলে মান ও নিয়ম তৈরি এবং বাস্তবায়ন করে। এর মধ্যে রয়েছে বিমান চলাচল, নিরাপত্তা ও পরিবেশগত মান। এছাড়া দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে এবং আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলকে আরও নিরাপদ ও দক্ষ করতে কাজ করে সংস্থাটি। কানাডার মন্ট্রিলে এ সংস্থার সদর দপ্তর অবস্থিত।
এব্যাপারে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভোরের আকাশকে জানান, আইসিএও নিয়ম অনুযায়ী একটি আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দরে সব ধরনের আগুন নির্বাপণের কার্যকর ব্যবস্থা থাকা জরুরি। কিন্তু শাহজালাল বিমানবন্দরে সেটা নেই। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও চরম অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ধারাবাহিতকতা অব্যাহত থাকলে বিমানবন্দরটি আইসিএও’র গ্রেডে মান হারাবে।
তবে এ বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক বলেন, অগ্নিদুর্ঘটনার পর আমরা কী পদক্ষেপ নিয়েছি আইসিএও এটা দেখবে। আমাদের করণীয় নিয়ে হয়তো দিকনির্দেশনা দেবে। কিন্তু এর মাধ্যমে বিমানবন্দরটির গ্রেড বা মান কমবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ভোরের আকাশ/এসএইচ
