ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ ও ডা. মো. স্বাক্ষর রহমান
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:৪৩ পিএম
ছবি- সংগৃহীত
টাইফয়েড জ্বর একটি পরিচিত নাম, কিন্তু এখনো বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা। প্রতি বছর অসংখ্য শিশু ও কিশোর এই রোগে আক্রান্ত হয়, এবং অনেক ক্ষেত্রেই জটিলতা বা মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়ে। অথচ একটি সহজ, নিরাপদ ও কার্যকর টিকা এই ভয়ংকর রোগ থেকে সুরক্ষা দিতে পারে। টাইফয়েড জ্বর Salmonella Typhi নামক ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ছড়ায়, যা সাধারণত দূষিত পানি, খাবার বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে শরীরে প্রবেশ করে। আক্রান্ত ব্যক্তির মল বা মূত্রের সংস্পর্শে এসে ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগের সাধারণ উপসর্গগুলো হলো দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, মাথাব্যথা ও দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা ও পেটের ব্যথা, কখনো কোষ্ঠকাঠিন্য, আবার কখনো ডায়রিয়া, কিছু ক্ষেত্রে চামড়ায় ছোট লালচে দাগ। চিকিৎসা না হলে এটি অন্ত্র ফুটো, রক্তক্ষরণ, এমনকি মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
WHO-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৯০ লাখ মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হন, এবং তাদের মধ্যে এক লাখেরও বেশি মৃত্যুবরণ করেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে টাইফয়েড জ্বরের জন্য বাংলাদেশ অন্যতম উচ্চঝুঁকিপূর্ণ। ভালো খবর হলো, টাইফয়েড প্রতিরোধে এখন নিরাপদ ও কার্যকর টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (TCV) পাওয়া যাচ্ছে। এটি একবার নেওয়াই দীর্ঘমেয়াদে সুরক্ষা দেয়। বাংলাদেশ সরকার ২০২৫ সালের ১২ অক্টোবর থেকে সারাদেশে টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন শুরু করছে, যা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (EPI)-এর আওতায় পরিচালিত হবে।
ক্যাম্পেইনে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত প্রাক-প্রাথমিক হতে ৯ম শ্রেণী/সমমান পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীকে স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বহির্ভূত ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের বিদ্যমান ইপিআই টিকাদান কেন্দ্রে টাইফয়েড টিকা প্রদান করা হবে। এর আওতায় সারাদেশে প্রায় ৫ কোটি শিশুকে বিনামূল্যে এক ডোজ টিসিভি টিকা প্রদান করা হবে। এই টিকা সম্পূর্ণ নিরাপদ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুমোদিত, শিশুদের শরীরে দীর্ঘস্থায়ী রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে এবং বিনামূল্যে সরকারি টিকাদান কেন্দ্র, স্কুল ও কমিউনিটি ক্লিনিকে দেওয়া হবে।
এখনও টিকা সম্পর্কে অনেকের মধ্যে কিছু ভুল ধারণা বা ভয় এখনও রয়ে গেছে। কেউ কেউ মনে করেন টিকা দিলে জ্বর হবে বা শিশু অসুস্থ হয়ে পড়বে। আসলে এগুলো শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া মাত্র-হালকা জ্বর বা ব্যথা এক-দুই দিনের মধ্যেই সেরে যায়। কেউ কেউ টিকার মান নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন, কিন্তু এই ভয় সম্পূর্ণ অমূলক। টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (TCV) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত এবং নিরাপত্তার সব মানদণ্ডে উত্তীর্ণ।
বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, টিকা নেওয়া শিশুরা টাইফয়েডে আক্রান্ত হলেও তাদের রোগের তীব্রতা অনেক কম হয় এবং জটিলতার ঝুঁকি হ্রাস পায়। তাই ভয় না পেয়ে সঠিক তথ্য জানা এবং তা অন্যদের জানানোই এখন জরুরি। টাইফয়েড প্রতিরোধে টিকাদান শুধু সরকারের নয়, সমাজের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব। অভিভাবকদের উচিত তাদের সন্তানকে টিকা দেওয়ার দিন নির্ধারিত স্ব স্ব স্কুল বা টিকাদান ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের নির্দেশনা অনুসরণ করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে স্কুল, মাদ্রাসা ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো এই টিকাদান কর্মসূচি সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
শিক্ষক ও প্রশাসন যদি শিক্ষার্থীদের এবং তাদের অভিভাবকদের সচেতন করেন, তবে টিকা কাভারেজ দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি সমাজের নেতৃবৃন্দ, ইমাম, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কমিউনিটি সংগঠনগুলোও জনসচেতনতা তৈরিতে অংশ নিতে পারেন। এই টিকা সহজলভ্য এবং সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পাওয়া যাবে। সরকারি টিকাদান কেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক, স্কুলভিত্তিক টিকাদান ক্যাম্প এবং শহর ও গ্রামীণ এলাকার নির্ধারিত অস্থায়ী বুথে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীরা এই টিকা প্রদান করবেন। প্রতিটি টিকাদান স্থানে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে।
টাইফয়েড প্রতিরোধে টিকার পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাও অপরিহার্য। সবসময় ফুটানো বা বিশুদ্ধ পানি পান করা, হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা, খাবার ঢেকে রাখা এবং রাস্তার খাবার এড়িয়ে চলা-এসব সাধারণ অভ্যাসই আমাদের পরিবারকে টাইফয়েডের মতো রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে।
অপরদিকে, স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নতি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঠিকতা টাইফয়েডসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। টাইফয়েড টিকা শুধু একটি ইনজেকশন নয়-এটি একটি সুরক্ষা, একটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিরাপদ রাখার অঙ্গীকার। ভয় নয়, সচেতনতা ও তথ্যই পারে আমাদের ও আমাদের সন্তানদের সুরক্ষিত রাখতে।
লেখকঃ ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ ও ডা. মো. স্বাক্ষর রহমান
জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ চেয়ার, গ্যাভি সিএসও স্টিয়ারিং কমিটি