কর্মীদের জীবন নিয়ে উদাসীন কর্তৃপক্ষ

জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবস আজ

কর্মীদের জীবন নিয়ে উদাসীন কর্তৃপক্ষ

নিখিল মানখিন

প্রকাশ : ৫ ঘন্টা আগে

আপডেট : ৫ ঘন্টা আগে

কর্মীদের জীবন নিয়ে উদাসীন কর্তৃপক্ষ

কর্মীদের জীবন নিয়ে উদাসীন কর্তৃপক্ষ

দু’দিনের ছুটি শেষে অফিসে গিয়ে চাকরিচ্যূত হওয়ার খবর পেলেন রাজধানীর মগবাজার এলাকার দিলু রোডের দিগন্ত ভবনের নিরাপত্তা প্রহরী মো. কাশেম আলী। কারণে-অকারণে মালিকের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় মালিবাগ রেল লাইনের রডের সামগ্রী নির্মাণকর্মী মো. শাহীন। জটিলরোগে আক্রান্ত ইউসূফ আলীর ন্যূনতম চিকিৎসা ব্যয় বহন করলো না তার অফিস। এভাবে কেবল কাশেম আলী, শাহীন ও ইউসূফ আলী নন, দেশের সর্বত্র কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন অগণিত শ্রমিক। রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার একটি পোশাক কারখানায় ছয় বছর ধরে কাজ করছেন শেফালী বেগম।

গতকাল রোববার সকাল সাড়ে সাতটায় কাজে যাওয়ার পথে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি ভোরের আকাশকে জানান,  মাসিক বেতন ১৫ হাজার টাকা।  কারখানার পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর। কাজের নিরাপত্তা নেই। গালাগালি শুনতে হয়। স্বাস্থ্যসেবার খরচ বহনতো দূরের কথা, অসুস্থতার কারণে ছুটির আবেদন করলেই চাকরির অবস্থা বারটা বেজে যায় বলে জানান শেফালী বেগম।

রাজধানীর হাজারীবাগ মধুবাজার এলাকার একটি বাসায় এক গৃহকর্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। গত ২২ এপ্রিল বেলা সোয়া ৩টার দিকে মধুবাজার, ১০-এ নম্বর (নতুন) রোডের ২২২/এ বাসায় এই ঘটনা ঘটে। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে আসলে চিকিৎসক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মৃত ঘোষণা করেন। মৃত গৃহকর্মীর নাম আকলিমা (১২) বলে জানা গেছে।

চিকিৎসকের বরাত দিয়ে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ মো. ফারুক। তিনি জানান, মৃতদেহটি মর্গে রাখা হয়েছে। ঘটনাটি রহস্যজনক। সংশ্লিষ্ট থানায় অবগত করা হয়েছে বলে জানান মো. ফারুক।

রাজধানীর গুলশান-২ এলাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে অফিস সহকারীর কাজ করতেন গারো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী যুবক শিরীল সাংমা। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, অফিস সহকারী হিসেবে তিন বছর কাজ করেছি। কিডনি জটিলতা দেখা দিলে ১০ দিনের ছুটি আবেদন করেছিলাম। ছুটির কথা শুনেই খুবই বাজে আচরণ করেন প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার। পরিস্থিতি আমাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করেছে বলে জানান শিরীল সাংমা।

রাজধানীর মিরপুরে একটি বায়িং হাউসে মার্চেন্ডাইজার হিসেবে দুই বছর চাকরি করেছেন ফার্মগেটের তেজকুনিপাড়াবাসী জেমস গমেজ। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, অফিসে কাজ করার মতো পরিবেশ ছিল না। গ্রুপিং তীব্রতর হয়ে উঠে। একজন আরেকজনের পেছনে লেগেই থাকতো। অফিস কর্তাকে অনেকবার অবহিত করেছি, লাভ হয়নি। তাই চাকরি ছাড়তে হয়েছে বলে জানান জেমস গমেজ। এভাবে দেশের সর্বত্র পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা এখনো সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে কেউ স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগেন। নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয় অনেকে। ফলে  তাদের উৎপাদনক্ষমতা অনেক হ্রাস পায়। এতে অজান্তেই ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় মালিকদের।

২০২৪ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৭০৭ ও নির্যাতনে ১১৩ শ্রমিক নিহত : বিলসের জরিপ : ২০২৪ সালে ৮২০ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২৯২ জন। নিহত শ্রমিকদের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭০৭ জন। আর কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন ১১৩ জন। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে- দেয়াল বা ছাদ ধসে পড়া, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া, অগ্নিকাণ্ড, সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, বজ্রপাত, বিষাক্ত গ্যাস, নৌদুর্ঘটনা, উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাওয়া, পড়ন্ত বস্তুর আঘাত, বিস্ফোরণ ইত্যাদি। ২০২৪ সালে কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হন ২২৯ জন শ্রমিক। এর মধ্যে ১১৩ জন নিহত, ১০০ জন আহত ও ১৫ জন নিখোঁজ হয়েছেন। একজন আত্মহত্যা করেছেন। নির্যাতিত শ্রমিকদের শ্রমিকদের মধ্যে ১৯৩ জন পুরুষ এবং ৩৬ জন নারী। ২০২৩ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৭৪২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় এবং আহত হন ৪৮৯ জন শ্রমিক। নিহত শ্রমিকদের মধ্যে ৭৩৯ জন পুরুষ এবং ৩ জন নারী শ্রমিক ছিলেন। অন্যদিকে গত বছর ৩০১ জন শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে ২৭৩ জন পুরুষ এবং ২৮ জন নারী শ্রমিক।

শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ : শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয় আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একক ও সেক্টরভিত্তিক জাতীয় মানদণ্ড প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সরকার, মালিক, শ্রমিক ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করার সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে শ্রম সংস্কার কমিশন গত সোমবার তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ প্রতিবেদন হস্তান্তর করে তারা। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা, আপদ চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া এবং পরিবেশগত বিষয় অন্তর্ভুক্তিকরণে সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।

সুপারিশে বলা হয়েছে, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একক ও সেক্টরভিত্তিক জাতীয় মানদণ্ড প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সরকার, মালিক, শ্রমিক ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা। প্রতিটি কারখানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নীতি ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম চালুর পাশাপাশি নিয়মিত মূল্যায়ন ও প্রতিবেদন প্রদানের ওপর গুরুত্ব দেওয়া। রাসায়নিক ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশগত ঝুঁকি, এবং বিপজ্জনক কাজের হালনাগাদ তালিকা চেকলিস্টে অন্তর্ভুক্ত করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা।’ রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা ও পরিদর্শনের জন্য সরকার নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নির্ধারণ এবং পরিবেশ সুরক্ষায় একটি গাইডলাইন তৈরি করার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি, সেক্টরভিত্তিক মানদণ্ড বাস্তবায়নে এসওপি তৈরি করার কথাও বলা হয়েছে সুপারিশে।

সুপারিশে আরো বলা হয়েছে, ‘শ্রম আইনে পেশাগত রোগ-ব্যাধির তালিকা আধুনিক প্রযুক্তি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রেক্ষাপটে হালনাগাদ করে কোভিডসহ নতুন সংক্রামক রোগ অন্তর্ভুক্ত করা। মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য, অতিরিক্ত শ্রমঘণ্টাজনিত রোগ এবং নারী শ্রমিকদের কাউন্সেলিং সুবিধা আইনে সংযোজন করা। রোগ শনাক্ত ও প্রতিবেদন প্রক্রিয়া সহজতর করা।’

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিআইএলএস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে ১০ সদস্যের একটি শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করে। কমিশন শ্রম বিষয়ে অংশীজন ও বিভিন্ন সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মতবিনিময় করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলেন : সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার ভোরের আকাশকে বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও অবকাঠামোগত নিরাপত্তার উন্নতি ঘটলেও শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি রয়েছে। শ্রমিকদের পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিতে কারখানার মালিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার ওপর জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’

বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরে নাজমা আক্তার বলেন, শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রতিটি কারখানায় আধুনিক ও কার্যকর ব্যবস্থা থাকা দরকার। এজন্য প্রয়োজন নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও মেডিকেল সুবিধা নিশ্চিত করা, কাজের পরিবেশে পর্যাপ্ত আলো ও বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা, আগুন, ধুলা, শব্দ ও রাসায়নিক থেকে সুরক্ষার জন্য নিরাপত্তা সরঞ্জাম দেওয়া, বিশ্রাম ও মাতৃত্বকালীন ছুটির যথাযথ প্রয়োগ, সুরক্ষিত স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশিক্ষণ।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার বলেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশ কর্মপরিবেশ নিরাপদ করতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। নির্শ্চিত করতে হবে স্বাস্থ্যসেবা। কিন্তু এই অগ্রগতি অর্থবহ করতে হলে এটিকে অবশ্যই টেকসই করে তুলতে হবে। শ্রমিক সুরক্ষায় ধারাবাহিক বিনিয়োগ, স্বচ্ছ নজরদারি ও কঠোর জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র রিসার্চ ডিরেক্টর খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘নিরাপত্তা অগ্রগতি টেকসই করার জন্য এটি উপযুক্ত সময়। অন্যদিকে, শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়গুলোকে টেকসই তার অংশ হিসেবে নিতে হবে। শ্রমিকরা শিল্পের অংশ। তাদের যথাযথ অধিকার পাওয়া উচিত।’

বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মক্ষেত্র দাবি করে বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহিল রাকিব বলেন, ‘বাংলাদেশের আরএমজি সেক্টর বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ শিল্প। বাংলাদেশের নির্মাতারা স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পুরস্কার পায়। আমরা এ অগ্রগতি ধরে রাখতে সম্মিলিতভাবে কাজ করছি, যাতে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি।’

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, ‘শ্রমিক উৎপাদনশীলতার নামে শ্রমিকদের জীবনধারণযোগ্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এটা সঠিক শিল্পের জন্য ভালো নয়। আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এটি ১২ বছর আগের তুলনায় অনেক ভালো। তবে আরও উন্নতির সুযোগ আছে এবং এজন্য কারখানার মালিকদের উচিত তাদের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ দেওয়া।’

ভোরের আকাশ/এসএইচ

  • শেয়ার করুন-

সংশ্লিষ্ট

কোনো নিরীহ লোককে মামলা দিয়ে হয়রানি করা যাবে না: আইজিপি

কোনো নিরীহ লোককে মামলা দিয়ে হয়রানি করা যাবে না: আইজিপি

জুলাই আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন ইরেশ যাকের: সংস্কৃতি উপদেষ্টা

জুলাই আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন ইরেশ যাকের: সংস্কৃতি উপদেষ্টা

কর্মীদের জীবন নিয়ে উদাসীন কর্তৃপক্ষ

কর্মীদের জীবন নিয়ে উদাসীন কর্তৃপক্ষ

হাসিনাকে ‌‘চুপ’ রাখতে পারবেন না বলে জানান মোদী

হাসিনাকে ‌‘চুপ’ রাখতে পারবেন না বলে জানান মোদী

মন্তব্য করুন