প্রশাসন নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে
মাজাহারুল ইসলাম
প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৫ ১২:৩৮ এএম
ছবি: সংগৃহীত
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে জাতিকে ইতিহাসের সেরা একটি নির্বাচন উপহার দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা সরকারের এমন মনোভাবকে সাদুবাদ জানিয়েছেন।
কিন্তু সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতারা প্রশাসনে থাকা কর্মকর্তাদের নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করছেন। কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগের দোসরারা প্রশাসনে ঘাপটি মেরে আছেন, তাদের দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
আবার কেউ বলছেন, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বিএনপি ও জামায়াত প্রতিযোগিতা করে প্রশাসনে নিজেদের ঘনিষ্টদের পদায়ন করেছেন। সুতরাং তাদের নেতৃত্বে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। প্রশাসনে থাকা বিতর্কিত কর্মকর্তা এবং দেশে বিদ্যমান আওয়ামী প্রশাসন দিয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপক্ষে নির্বাচন করা চ্যালেঞ্জিং মনে করছেন দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও।
তাদের মতে, বিগত ১৬ বছর আওয়ামী সরকারের মেয়াদকালে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু ভোট করা ঝুঁকিপূর্ণ। জাতিকে একটি ইতিহাসের সেরা নির্বাচন উপহার দেওয়া কথা বললেও অন্তর্বর্তী সরকার সেই অনুযায়ী চোখে পড়ার মতো প্রশাসনে কোন পরিবর্তন করেনি। পাশাপাশি নিরপেক্ষ ভোট আয়োজনের লক্ষ্যে সারাদেশের প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো হয়নি। তবে ভোট অনুষ্ঠানের পূর্বে এই বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহম্মদ ইউনূস নজরে নিবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তারা।
জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতে, গত ১৫ বছরে প্রায় সবই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিছুসংখ্যক চাকরি পেয়েছেন, যারা কোনোমতেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। তারা নানা কায়দা-কানুন করে চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন। কিছুসংখ্যক বড় অংকের টাকার বিনিময়ে চাকরি পেয়েছেন। ভিন্নমতের ব্যক্তিদের চাকরি হয়নি। আওয়ামী লীগের বাইরে যেন কেউ যাতে চাকরি না পায় সেজন্য দফায় দফায় তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়েছে।
বিশেষ করে ক্যাডার সার্ভিস ও কিছু নন-ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগ দেওয়ার আগে দুটি সংস্থাকে দিয়ে প্রার্থীর তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। এরপরও সন্দেহ হলে জেলা প্রশাসন পুনরায় তদন্ত করেছে। সাধারণ চাকরিপ্রার্থীদের বলতে হয়েছে তারা আওয়ামী লীগ সমর্থক। আর লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষায় যত ভালো করুক না কেন জামায়াত ও বিএনপি নেতাকর্মীদের জন্য চাকরি পাওয়া ছিল খুবই কঠিন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সচিবালয়সহ দেশের বিভিন্ন দপ্তরের পলাতক স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সময়ে দলীয় কোটায় প্রমোশন পেয়ে কর্মরত রয়েছেন বিতর্কিত কর্মকর্তারা। প্রশাসনে বিভিন্ন স্তরে রয়েছে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তা। তার মধ্যে সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে নিয়োগ পেয়েছে প্রায় সাত লাখ। নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সব সংস্থা এখনো আওয়ামী নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কাজেই প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা এই সব আওয়ামী দোসর দ্বারা ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট সম্পন্ন করা খুব কঠিন।
অপর একটি সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে জনপ্রশাসনে বঞ্চিত ৭৬৪ জনকে পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পদোন্নতিপ্রাপ্তদের মধ্যে আছেন সচিব পদে ১১৯ জন, গ্রেড-১ (সচিবের সমান বেতন গ্রেড) পদে ৪১ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮ জন, যুগ্ম সচিব পদে ৭২ জন এবং উপসচিব পদে ৪ জন কর্মকর্তা। যারা অবসরে গেছেন, তারা ‘ভূতাপেক্ষভাবে’ পদোন্নতি পাবেন।
২০০৯ সাল থেকে গত বছরের ৪ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বঞ্চিত দাবি করে ১ হাজার ৫৪০ কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। এর মধ্যে মারা যাওয়া কর্মকর্তাদের পক্ষে তাদের পরিবারের সদস্যদের করা ১৯টি আবেদনও ছিল। এ সংক্রান্ত গঠিত একটি কমিটির সুপারিশে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, গত বছর ৫ আগস্টের পরই অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সুর পাল্টিয়ে নিজেকে বঞ্চিত সেজে কিছু সুবিধাভোগী, বিতর্কিত ও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তাও পদোন্নতি পেয়েছেন। পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও রয়েছেন, যার বিরুদ্ধে অপরাধে জড়ানোর অভিযোগে বিভাগীয় মামলা হয়েছিল। তাদের কেউ কেউ আবার নিজেকে বিএনপির অথবা জামায়াতের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা দাবি করে টিকে রয়েছে। কেউ আবার এনসিপির দোহাই দিয়ে প্রশাসনে বহাল তবিয়াতে রয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মো. মাহবুবুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের থাকা বিতর্কিত কর্মকর্তা এবং দেশে বিদ্যমান প্রশাসন দিয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপক্ষে নির্বাচন করা চ্যালেঞ্জিং।
তিনি বলেন, বিগত ১৬ বছর আওয়ামী সরকারের মেয়াদকালে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলেও নতুন যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের দ্বারা স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু ভোট করা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
অধ্যাপক কাজী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, জাতিকে একটি ইতিহাসের সেরা নির্বাচন উপহার দেওয়া কথা বললেও অন্তর্বর্তী সরকার সেই অনুযায়ী চোখে পড়ার মতো প্রশাসনে কোন পরিবর্তন করেনি। পাশাপাশি নিরপেক্ষ ভোট আয়োজনের লক্ষ্যে সারাদেশের প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে তবে সুষ্ঠু ভোটের অনুষ্ঠানের পূর্বে এই বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকার নজরে নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রশাসনে এখনো আওয়ামী লীগের দোসররা বহাল তবিয়তে কাজ করছে। তারা নতুন করে ষড়যন্ত্র ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, এসব আওয়ামী দোসরদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে এর দায় পড়বে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় সাবেক চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক ভোরের আকাশকে বলেন, প্রশাসনে এখনো স্বৈরাচারের দোসররা বসে আছে। এদের রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না।
তিনি বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থেই বর্তমান প্রশাসন ব্যবস্থাকেও নিরপেক্ষ করতে হবে। প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা স্বৈরাচারের দোসরা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টায় রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সাবেক এই চিফ হুইপ বলেন, বর্তমান প্রশাসনে যেসব স্বৈরাচারের দোসরা এখনো বসে আছে। এদেরকে সরানোর জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
বিএনপি চেয়ারপারসনের এই উপদেষ্টা আরও বলেন, ভারত ও আওয়ামী লীগ মিলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে চায়। রাজনৈতিক স্থতিশীল না হলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে না। কাজেই অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ ভোটের লক্ষ্যে সবাইকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানান তিনি।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী ভোরের আকাশকে বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হবে। কিন্তু আওয়ামী আমলের প্রশাসন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। তাই প্রশাসন থেকে আওয়ামী ক্যাডারদের অপসারণ করতে হবে।
তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মাঠ পর্যায়ে নিরপেক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার বিশেষ মহল প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে একটি ধর্মভিত্তিক দলের অনুগতদের বসাচ্ছে। এটা দিয়ে কিন্তু অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। জনগণ প্রত্যক্ষ করছে, আমরাও প্রত্যক্ষ করছি। কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে এসব বিশেষ রাজনৈতিক দলের মনোভাবাপন্ন প্রশাসক এবং আমলাদের বসানো হচ্ছে। তারা কখনোই নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে দেবে না।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় স্বৈরাচারের দোসররা আছে। ফ্যাসিবাদের সময় নিয়োগকৃত সকল আওয়ামী দোসরদের ফরেন মিনিস্ট্রি থেকে অপরসারণ করার দাবি জানান তিনি।
গণঅধিকার পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফারুক হাসান ভোরের আকাশকে বলেছেন, নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব থাকা সব সংস্থা এখনো আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে। তিনি দাবি করেন, পুলিশের শতকরা ৮০ ভাগ সদস্য এবং প্রশাসনের ৭০ ভাগ লোক আওয়ামী লীগের সমর্থক।
ফারুক হাসান বলেন, ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচন অবশ্যই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হবে এবং সেরকম নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করতে হবে। প্রশাসনকে পুনর্গঠন করতে হবে। প্রার্থীদের নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে প্রচারণার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা সরকারকে দিতে হবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ