মো. রেজাউর রহিম
প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৫ ১২:৩০ এএম
ফাইল ছবি
বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানব পাচার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। শক্তিশালী আন্তর্জাতিক ও দেশীয় একটি চক্র বিভিন্ন প্রলোভনে পাচার করে চলেছে নারী-শিশু-পুরুষ। দিনের পর দিন চলছে এ অবস্থা, পাচার কমার কোনো লক্ষণ নেই, বরং দিন দিন বেড়েই চলছে। আর পাচার বন্ধেও নেই জোরালো পদক্ষেপ। ফলে মানব পাচারে শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যেই রয়েছে বাংলাদেশ। আর পাচারের শিকার হয়ে যাওয়া নারী-পুরুষের ভাগ্যে নেমে আসছে যৌনকর্মী বা দাস শ্রমিকের মতো অমানবিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করার মতো ঘটনা। এমনকি পাচারকৃতদের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এবং আফগানিস্তানে তালেবানদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধে লিপ্ত করার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনাও ঘটছে।
এছাড়া বিভিন্ন ঘটনায় পাচার হয়ে যাওয়া নারী-পুরুষকে জিম্মি ও নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায়ের মতো ঘটনাও ঘটছে। এমনকি পাচারকৃত অনেকের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের ‘নেতিবাচক ভাবমুর্তি’ তৈরি করেছে। এ অবস্থায় মানব পাচার রোধে কার্যকর ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে, প্রতিবছরই আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) হিসাবে মানব পাচার সূচকে শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যেই থাকছে বাংলাদেশের নাম। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরও তালিকার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। যা দেশের জন্য অত্যন্ত লজ্জা ও বেদনাদায়ক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, সরকারের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ ও বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ছাড়া কোনোভাবেই মানব পাচারের অভিশাপমুক্ত হওয়া বেশ কঠিন। আর মানব পাচার প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবে সেগুলোর বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। ফলে কোনোভাবেই কমছে না মানব পাচারের মতো ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড।
বিভিন্ন প্রলোভন, বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন জেলার নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণ-তরুণী-শিশুদের বেকারত্ব দূর করা ও ভালো কাজ এবং ভালো বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। এসব পাচারকারীদের প্রলোভনে পড়ে ইউরোপ বিশেষ করে ইতালি, গ্রিসসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে যাওয়ার পথে কয়েক হাজার বাংলাদেশির ভূমধ্যসাগরে সলিল সমাধি হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন দেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে অসংখ্য বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশের কারাগারে বন্দি জীবনযাপন করছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে অবৈধ মানব পাচার রোধে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর আন্তরিকভাবে কাজ করছে।
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (রাজনৈতিক-১ অধিশাখা) মু. জসীম উদ্দিন খান ভোরের আকাশকে জানান, মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা ও সহায়তায় গতমাসে ‘ডিজিটাল ন্যাশনাল রেফারেল মেকানিজম (এনআরএম) প্ল্যাটফর্ম’ উদ্বোধন করা হয়েছে। ডিজিটাল ‘এনআরএম’ ভুক্তভোগীদের আরও কার্যকরভাবে শনাক্তকরণ, অনুমোদিত সেবা প্রদানকারীদের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ, সেবার গুণগতমান নিয়ন্ত্রণ, তদারকি ও মনিটরিং ব্যবস্থার মাধ্যমে রেফারেলে গতি-স্বচ্ছতা আনয়ন এবং পাশাপাশি
জবাবদিহি নিশ্চিত করবে বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানব পাচারের সবচেয়ে বড় কারণ দেশে প্রয়োজনীয় ও কাক্সিক্ষত কর্মসংস্থানের অভাব তথা বিপুল পরিমাণের বেকারত্ব। শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে বিপুল পরিমাণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর বেকারত্বকে কাজে লাগাচ্ছে পাচারকারী চক্র। আর বেকার তরুণ-তরুণীরা ভালো কাজের প্রলোভনে পাচারকারীর চক্রের খপ্পরে পড়েন। ভালো বেতনে চাকরির আশায় তারা ভূমধ্যসাগর কিংবা স্থলপথে বিদেশে যেতে মৃত্যুর মুখোমুখিও হচ্ছেন।
আইওএমের হিসাবে, গত পাঁচ বছরে সমুদ্র ও স্থলপথে ইউরোপে পাচারের সময় ১৫ হাজার ৭৯৪ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষ নিহত ও নিখোঁজ হয়েছেন। আর নিখোজ বাংলাদেশিদের মধ্যে কতজন মারা গেছেন, তা জানা যায়নি। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর ধারণা, অবৈধভাবে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে যেতে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ বাংলাদেশি নিহত ও নিখোঁজ হন। আর পাচার প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও বাস্তবে কোনো জোরালো পদক্ষেপ নেই। ফলে দিন দিন বেড়েই চলেছে পাচার হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশকে কার্যকর কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আর বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিকভাবে অনেক সবল অবস্থানে থাকায় মানব পাচারে যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান কিংবা তিউনেশিয়ার কাছাকাছি থাকার বিষয়টিকে তারা দেশের ইমেজের জন্যও বেশ নেতিবাচক।
গত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, মানব পাচার কমছে না। বরং দিন দিন বেড়েই চলছে। পাচার বন্ধে আন্তর্জাতিক ও দেশি মানব পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন ব্যবহার করে সোচ্চার হতে হবে বলেও মনে করেন তারা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- ভারত, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, থাইল্যান্ড, ইউরোপের- ইতালি, গ্রিস, পর্তুগাল, সাইপ্রাস, স্পেন এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, ওমান, কাতার, ইরাক ও লিবিয়ায় মানব পাচার বেশি হচ্ছে। এছাড়া মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ায়ও পাচার হচ্ছে মানুষ। মূলত এসব দেশে উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বেকার ও চাকরিপ্রত্যাশী তরুণ-তরুণীদের পাচার করছে দালালরা। পাচারের শিকার বেশিরভাগই নারী-পুরুষ। তবে সম্প্রতি শিশুদেরও পাচার করা হচ্ছে। আর পাচারকৃত অনেকের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও বিক্রি করা হচ্ছে বলে সরকারের কাছে তথ্য রয়েছে।
জানা গেছে, দেশের ১৫ জেলা থেকে বেশি মানুষ পাচার হয়ে থাকে। জেলাগুলো হচ্ছেÑ মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুষ্টিয়া, কুমিল্লা, কক্সবাজার, চুয়াডাঙ্গা, নরসিংদী ও সাতক্ষীরা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে অবৈধ মানব পাচার রোধে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর আন্তরিকভাবে কাজ করছে।
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, পাচার বন্ধ করা খুবই কঠিন। কারণ যেসব লোক প্রতিবেশী দেশ ভারত, লিবিয়া কিংবা অন্য কোনো দেশ হয়ে ইউরোপে যাচ্ছে, তারা বৈধ ভিসা নিয়েই যাচ্ছেন। কারণ এসব মানুষ প্রথমে ওইসব দেশে যাচ্ছেন। পরে সেখান থেকে নৌ কিংবা সড়কপথে ইউরোপে ঢুকছেন। সুতরাং তাকে আটকানোর মতো কোনো পদ্ধতি এখনও সরকারের হাতে নেই। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিলে কারা এসব পাচারের সঙ্গে যুক্ত সেটি জানা সম্ভব বলে জানান তারা।
ব্র্যাকের গবেষণা’র তথ্য
পাচার হয়ে যাওয়াদের মধ্যে লিবিয়া থেকে ২০২৪ সালে দেশে ফেরত আসা ৫৫৭ জন বাংলাদেশির ওপর ব্র্যাকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব মানুষের যাত্রা, গন্তব্য, অর্থ, নিপীড়ন, উদ্ধার থেকে শুরু করে প্রত্যেকের অসহায় অবস্থা তুলে ধরা হয়। এ প্রতিবেদনে ইউরোপীয় সীমান্ত ও উপকূলরক্ষী বাহিনীগুলোর সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ফ্রন্টেক্সের তথ্য সন্নিবেশ করা হয়। তথ্য অনুযায়ী, অধিকাংশ বাংলাদেশিদের পাচারকারীরা সাধারণত ইউরোপ নেওয়ার জন্য লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর ব্যবহার করে, যা ‘সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট’ হিসেবে পরিচিত। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই পথে অন্তত ৭০ হাজার ৯০৬ জন বাংলাদেশি ইউরোপে ঢুকেছেন। তবে এভাবে প্রবেশ করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা।
ব্র্যাকের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এভাবে লিবিয়া যাওয়ার পথে ৬৩ শতাংশই বন্দি হয়েছেন, যাদের ৯৩ শতাংশই ক্যাম্পে বন্দি ছিলেন। বন্দিদের ৭৯ শতাংশই শিকার হন শারীরিক নির্যাতনের। এছাড়া লিবিয়ায় পেঁৗঁছানোর পর ৬৮ শতাংশই মুক্তভাবে চলাচলের স্বাধীনতা হারান। ৫৪ শতাংশই বলেছেন, তারা কখনো তিনবেলা খাবার পাননি। অন্তত ২২ শতাংশ দিনে মাত্র একবেলা খাবার পেয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে পাঠানোরে প্রলোভন দেখিয়ে যাদের লিবিয়া নেওয়া হয়, তাদের সবাইকে ভালো চাকরির প্রলোভন দেখালেও তারা চাকরি পায় না। উল্টো অধিকাংশকেই লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয় মোটা অংকের অর্থ। আর প্রাপ্তবয়স্ক পাচারকৃতদের জোরপূর্বক নির্মাণ ও কৃষি শ্রমে যুক্ত এবং জাহাজ ভাঙা শিল্প, যৌন নির্যাতন ও গৃহ শ্রমিকের মতো কাজেও সম্পৃক্ত করা হয়। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেকের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও বিক্রি করে দেয় পাচারকারীরা।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল ইসলাম হাসান ভোরের আকাশকে বলেন, বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন। তিনি বলেন, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর কিংবা গোপালগঞ্জসহ যেসব জেলার লোক বেশি সংখ্যায় অবৈধ পথে বিদেশে যান, এসব জেলায় খোঁজ-খবর করে পাচারকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব। এটি সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ। এজন্য সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর যে সংখ্যক মানুষ পাচার হচ্ছে, তা খুবই বিপজ্জনক। পাচারে বাংলাদেশ প্রায়ই শীর্ষ দেশের তালিকায় থাকে। এটি দেশের জন্য খুবই লজ্জাজনকও।
৫ বছরে পাচার ৬৮ হাজার
আইওএম’র হিসাবে গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচের দেশগুলোতে ৬৮ হাজার ৩৭০ জন বাংলাদেশি পাচার হয়েছে। চলতি বছর পাচারের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষে অবস্থান করছে। সংস্থাটির হিসাবে, ২০২৫ সালে সমুদ্র ও স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ১৫ হাজার ৯৫ জন পাচার হয়েছে। যদিও এটি চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ের তথ্য, বছরের বাকি তিন মাসের তথ্য এতে যোগ হলে পাচারের সংখ্যা আরও বাড়বে। বিশ্বে মানব পাচারের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মিশর। দেশটি থেকে ১১ হাজার ৬২২ জন পাচার হয়েছে। তৃতীয় অবস্থানে থাকা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তান থেকে পাচার হয়েছে ৯ হাজার ৪৪৬ জন। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে সুদান। দেশটি থেকে ৭ হাজার ২৫৪ জন, পঞ্চম ইরিত্রিয়া থেকে ৬ হাজার ৭৩১, ষষ্ঠ মালি থেকে ৬ হাজার ২৩৬, সপ্তম আলজেরিয়া থেকে ৫ হাজার ১৩৩ জন এবং অষ্টম অবস্থানে থাকা সোমালিয়া থেকে পাচার হয়েছে ৩ হাজার ৯৩৯ জন। এই তালিকায় পাকিস্তানের অবস্থান নবম। দেশটি থেকে ৩ হাজার ৬১০ জন পাচারের ঘটনা ঘটেছে। আর দশম অবস্থানে থাকা সিরিয়া থেকে পাচার হয়েছে ৩ হাজার ৩১৬ জন। বাংলাদেশ ২০২৪ সালের তালিকায় ছিল চতুর্থ অবস্থানে, ওই বছর পাচার হয়েছিল ১৫ হাজার ৩০৪ জন নারী-পুরুষ।
ভোরের আকাশ/এসএইচ