রাজনীতির মাঠে কী হবে
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি অপেক্ষায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের। আর জামায়াতে ইসলামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটে পিআর পদ্ধতির দাবি আদায়ে বিক্ষোভ-আন্দোলন নিয়ে রয়েছে রাজপথে। অপরদিকে, জুলাই সনদের আইনিভিত্তির দাবি আদায়ে রাজপথে আন্দোলনে হুমকি দিয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-জনতার গড়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলগুলোর বিভিন্ন ইস্যুতে ত্রিমুখী দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কি হবে রাজনীতির মাঠে!স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা হটাও রাজপথের আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ থাকলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনপূর্ব নানা ইস্যুতে সেই ঐক্যে বিভাজন দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের হিসাব-নিকাশ যত এগিয়ে আসছে, দলগুলোর বিরোধ ততই প্রকাশ্যে রূপ নিচ্ছে। রাজনীতির মাঠে অনৈক্যের সেই সুর ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। দীর্ঘদিন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভোটের অধিকারসহ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে যারা রাজপথে শামিল ছিলেন, তারাই কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হচ্ছেন- ভাবছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান, বিচার-সংস্কার ও নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে মতপার্থক্য স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশিন ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন ইতোমধ্য বলেছেন, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। সরকার ও ইসির কথায় সাধুবাদ জানিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ভোটমুখী হচ্ছিল। এরইমধ্যে গত ১৭ অক্টোবর জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু ওই সনদে স্বাক্ষর করেননি এনসিপি। এনসিপি বলছে, ভোটের আগে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। তা না হলে দলটি জুলাই সনদে স্বাক্ষর তো করবেন না বরং রাজপথে আন্দোলনের মধ্যদিয়ে তাদের দাবি আদায়ের হুমকি রয়েছে।একদিকে, গণভোট ও পিআর (সংখ্যানুপাতিক) পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলনে রয়েছে জামায়াত, খেলাফত মজলিস ও ইসলামী আন্দোলনসহ বেশকিছু ইসলামি দল। তারা বলছে, ২৭ অক্টোবরের মধ্যে দাবি মানা না হলে দেশব্যাপী বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে।অন্যদিকে, বিএনপি বলছে, দেশে বিরাজমান অস্থিতিশীল পরিবেশ ও রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই। কাজেই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে দেশে সরকার প্রতিষ্ঠা হলে দেশ স্থিতিশীল ও কল্যাণমুখী হবে। যত দ্রুত নির্বাচন হবে, তত দ্রুতই জনগণের জন্য মঙ্গলজনক বলেও মনে করছেন দলটির নেতারা। কারণ হিসেবে বলছেন, নির্বাচিত সরকার না থাকলে দেশ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনের আগে একটির পর একটি ইস্যুকে সামনে আনা হচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে জনমনে। রাজনীতির মাঠ পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে সরগরম রাখা হচ্ছে। পিআর নামক ভোটের এক বিষফোড়া নিয়ে মাঠে আন্দোলন করছে জামায়াতে ইসলামী। পাশাপাশি সংসদ নির্বাচনের আগেই গণভোট চাচ্ছে জামায়াত। নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হবে না এমন বক্তব্য দিচ্ছেন এনসিপি। বিএনপির দাবি সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট।বিএনপি পিআরের পদ্ধতির তীব্র বিরোধিতা করে বলছে, এটি রাজনৈতিক বিভাজন এবং অস্থিতিশীল সরকারের পথ প্রশস্ত করবে। এই পদ্ধতি নির্বাচনের আড়ালে দেশে পতিত স্বৈরাচারের পথ সুগম করে দিতে পারে।বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভোরের আকাশকে বলেন, বিএনপি কোনো ধরনের দরকষাকষি বা সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে যেতে চায় না। জনগণের ভালোবাসা ও মতামতের ভিত্তিতে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় বিএনপি।মির্জা ফখরুল বলেন, দেশে এখন নানা রকম চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু আমরা চাই রংধনুর সাত রঙের মতো সব ধর্ম-বর্ণের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে।তিনি আরও বলেন, বিগত ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট সরকার দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজ কাঠামোকে ভেঙে দিয়েছে। বিএনপি সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশকে নতুন করে গড়তে চায়, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নিয়ে। হিংসা-প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার করে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জাতীয় সংসদের সাবেক বিরোধীদলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক ভোরের আকাশকে বলেন, ফ্যাসিবাদ উৎখাতের আন্দোলনে যেসব দল একত্রিত ছিল, তাদের মধ্যে এখন বিভেদ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।তিনি বলেন, ষড়যন্ত্র চলছে, জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দেওয়ার কথা জানিয়েছেন ইসি, ঠিক সেই মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর নানা ইস্যু নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করছে। ফলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হচ্ছে। তবে এটি কাম্য নয়। বিএনপি গণতন্ত্রের পথে অবিচল থাকবে বললেন বিএনপির এই নেতা।সাবেক বিরোধীদলের চিফ হুইপ বলেন, বহু আকাক্সিক্ষত জুলাই সনদ স্বাক্ষর হয়েছে। এখন জুলাই সনদ এর আইনিভিত্তি দিতে জনসম্মতি আদায়ের গণভোট হতেই পারে। তবে সেটা অবশ্যই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন হতে পারে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, গণভোট ও পিআর পদ্ধতির দাবিতে বিক্ষোভ ও আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো ২০ অক্টোবর রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। ২৫ অক্টোবর বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করবে। ২৭ অক্টোবর জেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের ঘোষণা রয়েছে তাদের। তবে, ২৭ অক্টোবরের মধ্যে দাবি না মানলে গণআন্দোলনের ডাক দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন জামায়াত।এ প্রসঙ্গে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার ভোরের আকাশকে বলেন, গণভোট ও পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের সঙ্গে জুলাই সনদের স্বাক্ষরের কোনো সম্পর্ক নেই। শুধুমাত্র যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছে তার ভিত্তিতেই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা হয়েছে।গোলাম পরওয়ার বলেন, আমাদের আন্দোলন নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করবে না। ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন চাই, তবে এর আগে সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি করতে হবে আর গণভোট দিতে হবে। জুলাই সনদের প্রধানতম কাজ হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিক ভিত্তি নির্মূল এবং গণতান্ত্রিক রূপান্তর। এ কারণে এই সনদের সুস্পষ্ট আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তি থাকতে হবে বলছেন এনসিপি।এ প্রসঙ্গে জাতীয় দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, এনসিপি মনে করে, বাস্তবায়ন পদ্ধতির উল্লেখ ছাড়া সনদে স্বাক্ষর করা জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। কারণ অতীতে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের করা প্রতিশ্রুতি নিজেরাই ভঙ্গ করেছে।এছাড়া জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট আরও তিনটি বিষয় এনসিপি উত্থাপন করেছে।সেগুলো হলো-জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের টেক্সট এবং গণভোটের প্রশ্নটি চূড়ান্ত করে আগেই জনগণের কাছে প্রকাশ করতে হবে; জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জারি করবেন এবং গণভোটের মাধ্যমে জনগণ যদি জুলাই সনদে রায় দেয়, তবে নোট অব ডিসেন্টের কোনো কার্যকরিতা থাকবে না।গণভোটের রায় অনুযায়ী আগামী নির্বাচিত সংসদ তাদের ওপর প্রদত্ত গাঠনিক ক্ষমতাবলে সংবিধান সংস্কার করবে। সংস্কারকৃত সংবিধানের নাম হবে: বাংলাদেশ সংবিধান, ২০২৬। এসব বিষয়ের নিশ্চয়তা ছাড়া সনদের সাংবিধানিক ভিত্তি নিশ্চিত হবে বলে এনসিপি মনে করে না। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে উল্লিখিত বিষয়গুলোর স্পষ্ট উল্লেখ নিশ্চিত না হলে আন্দোলনের মাধ্যমে আদায় করা হবে বলছেন এনসিপির এই শীর্ষ নেতা।তিনি আরও বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতির পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দেখার পর সনদে সই করবে বলেও দলটি।ভোরের আকাশ/এসএইচ