এ কে এম মাহাবুব আলম (হিরা)
প্রকাশ : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ১১:৩৭ এএম
ছবি: ভোরের আকাশ
মৃত্যু, সেটা তো : শুধু একটি শ্বাসের ব্যবধান। "কিন্তু ঠিক এক মিনিট আগেও মারা যাওয়া মানুষটিও হয়তো তাই ভেবেছিল, “মৃত্যু সে তো অনেক দূরে..." এই কথাটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানব জীবনের চরম বাস্তবতা ও আল্লাহর এক মহান সতর্কবাণী। আমরা মৃত্যুর চিন্তা এড়িয়ে চলতে চাই প্রতিমুহূর্তে ভবিষ্যতের স্বপ্নে, দুনিয়ার চাকচিক্যে, পাপ-পুণ্যের হিসাব না করেই। আমরা দিন কাটাই এই ভেবে যে, ‘মৃত্যু এখনো আসেনি, আমি সুস্থ, তরুণ/যুবক, বার্ধক্য এখনো দূরে, এখনো তো সময় আছে। বলতে গেলে মৃত্যু নিয়ে একটা তাচ্ছিল্য ভাব, মুখে মৃত্যু আসবে স্বীকার করলেও মনের মধ্যে নিজেকে অনেকটা অমর ভেবে চলি। কিন্তু ভাই, আপনার নিঃশ্বাসের পরের সেকেন্ডটি কি আপনি নিশ্চিত? যে মুহূর্তটি আমরা ভবিষ্যতের জন্য সাজিয়ে রেখেছি, হয়তো সে মুহূর্ত আমাদের জন্য আসবে না। মৃত্যু এমন একটি সত্য, যা কখন, কোথায়, কীভাবে আসবে—তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে: "অথচ কেউই জানে না আগামীকাল তার জন্যে কী অপেক্ষা করছে এবং কেউ জানে না কোথায় তার মৃত্যু হবে। শুধু আল্লাহই সর্বজ্ঞ, সব বিষয়ে অবহিত।" (সূরা লুকমান, ৩১:৩৪)
আমরা দেখি, প্রতিদিন কত তরুণ, কত স্বাস্থ্যবান, কত প্রভাবশালী মানুষ হঠাৎ করেই চলে যাচ্ছে। তারা কি এক মিনিট আগেও ভাবতে পেরেছিল যে, এটাই তাদের শেষ নিঃশ্বাস? নিশ্চয়ই না। তারা হয়তো পরিকল্পনা করেছিল আগামীকালের, আগামী সপ্তাহের, আগামী বছরের বা হয়তো কারো সাথে রাগান্বিতভাবে উচ্চস্বরে কথা বলছিলেন—মনে মনে এই ভেবে যে "আগামীকাল সব ঠিক করে নেব।"
কিন্তু মৃত্যুর জন্য কোনো "কাল" থাকে না। মৃত্যু এসেছে হঠাৎ। এক ফোঁটা রক্ত জমাট বেঁধেছে মস্তিষ্কে, বা একটি শিরা ফেটে গেছে বক্ষে, বা একটি দূষিত ধাতু ধাবিত হয়েছে দেহে—আর শেষ। সব পরিকল্পনা, সব স্বপ্ন, সব অহংকার, সব ঝগড়া-বিবাদ, অসমাপ্ত কাজগুলো রয়ে গেল অনাদায়ী। চোখের পলকে ইহকাল শেষ, অনন্ত মহাকালের যাত্রা শুরু…।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে মৃত্যুকে অধিক স্মরণ করতে বলেছেন। কারণ মৃত্যুর স্মরণই মানুষকে পাপ থেকে বিরত রাখে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভে উৎসাহিত করে। তিনি বলেছেন: "মৃত্যুকে অধিক স্মরণ কর, কেননা তা গুনাহকে নিশ্চিহ্ন করে দেয় এবং দুনিয়ার মোহ কমিয়ে দেয়।" (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৪২৫৮)
আমরা দুনিয়ার জীবনে এতটাই মশগুল যে, মৃত্যুকে ভুলে থাকি। কিন্তু আল্লাহ তাআলা সতর্ক করে দিয়েছেন: "প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।" (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৮৫)
এই ‘প্রত্যেক প্রাণী’ এর মধ্যে আমরা সকলেই আছি। আজ আমি, কাল আপনি। কেউই এর ব্যতিক্রম নয়। প্রিয় পাঠক, মৃত্যু যখন অনিবার্য, তখন তার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ। যে ব্যক্তি মৃত্যুর পরের জীবনে বিশ্বাস রাখে, সে কখনো আল্লাহর অবাধ্য হতে পারে না। সে জানে, তার প্রতিটি কাজের হিসাব দিতে হবে।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে: "আর তোমরা সেই দিনকে ভয় কর, যখন কেউ কারও কোনো উপকারে আসবে না, কারও থেকে কোনো সুপারিশ গৃহীত হবে না, কারও থেকে কোনো বিনিময় গ্রহণ করা হবে না এবং তাদের কোনো সাহায্যও করা হবে না।" (সূরা আল-বাকারা, ২:১২৩)
“যখন আকাশ বিদীর্ণ হবে. যখন তারকারাজি বিক্ষিপ্তভাবে ছিটকে পড়বে, যখন সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস সব ভাসিয়ে নেবে, যখন কবরসমূহ উন্মুক্ত হবে তখন প্রত্যেকেই জানতে পারবে তার কৃতকর্ম—কী সে সাথে নিয়ে এসেছে, আর কী দুনিয়ায় (সুযোগ) রেখে গেছে।“ (সূরা ইনফিতার, ২-৫)
অর্থাৎ মানুষের প্রকৃত জীবন শুরু হবে মৃত্যু পরবর্তী পুনরুত্থান থেকেই। যে জীবনের শেষ বলে আর কোন শব্দ থাকবে না। তাই পরকাল জীবনের প্রস্তুতি স্বরূপ বর্তমানের এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে ঠিকভাবে কাজে লাগানোর মধ্যেই রয়েছে আল্লাহ পাকের নির্দেশ। প্রতিটি মুহূর্তে তাওবাহ করা (ক্ষমা চাওয়া), জিকির করা (আল্লাহর নাম স্মরণ করা), একাগ্রচিত্তে নামাজ পড়া, যাকাত আদায়ে কার্পণ্য না করা, নেক আমল করা, —এগুলোই হলো মৃত্যুর পর একমাত্র সহায়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: "বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে নিজের নিয়ন্ত্রণকারী (নফসকে) নিয়ন্ত্রণ করে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য আমল করে।" (সুনান আত-তিরমিযী, হাদীস নং ২৪৫৯)
মৃত্যু কোনো বৃদ্ধ বা রোগীর একার বিষয় নয়। মৃত্যু তো যুবক, শিশু, সুস্থ-সবল সবার জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য। স্মরণ করুন আপনার বাবা, মা, ভাই, বোন, নিকটাত্মীয় বন্ধু বা পরিচিতজন; যারা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, তাদের নাম এক এক করে কাগজে লিখুন, দেখবেন পৃষ্ঠা ভরে যাবে, তারপরও কিছু নাম রয়ে যাবে। একবার চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন তো, হারিয়ে যাওয়া সেই মুখগুলি, তাদের সাথে অতিক্রান্ত মুহূর্তগুলি, জীবনে শেষবারের মতো দেখা হওয়া বা কথা বলার মুহূর্তটি। কি মনে হয়? এইতো সেদিন তাই না? অথচ সময়ের স্রোতে তারা এখন শুধুই ছবি আর স্মৃতি। আজ আমরা যারা বেঁচে আছি, তাদেরও একদিন একই অবস্থা হবে। তাই সময় থাকতে মহান রব আল্লাহর দিকে এখনই ফিরে আসুন। নতুবা মৃত্যুই বন্ধ করে দেবে সকল সম্ভবনার রাস্তা।
"হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর, প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত যে, সে আগামীকালের জন্য (আখিরাতের জন্য) কী প্রেরণ করেছে তা চিন্তা করা। আর আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত।" (সূরা আল-হাশর, ৫৯:১৮)
জাহান্নাম: শুধু আগুন নয়—একটি জীবন্ত দানব, একটা গোপন ফাঁদ: "নিশ্চয়ই সেদিন জাহান্নাম প্রতীক্ষায় থাকবে সত্য অস্বীকারকারীদের জন্যে এবং এটিই হবে সীমালঙ্ঘনকারীদের আশ্রয়স্থল। জাহান্নামে ওরা থাকবে যুগ যুগ ধরে...। সেখানে ওরা না পাবে আরামদায়ক ঠান্ডার স্বাদ, না পাবে তৃষ্ণা নিবারণকারী পানি। ওরা স্বাদ নিতে পারবে শুধু বিশ্রী দুর্গন্ধময় আঠালো ফুটন্ত পানীয়ের। এটি হবে ওদের পাপের উপযুক্ত প্রতিফল। তারা তাদের (কৃত কর্মের) কোনো হিসাব নিকাশের আশা করতো না। আর তারা আমার আয়াত সমূহকে সম্পূর্ণ রূপে অস্বীকার করেছিল। আর সব কিছুই আমি লিখিত ভাবে সংরক্ষিত করেছি। সুতরাং তোমরা স্বাদ গ্রহণ করো (যে আজাব সম্পর্কে বার বার সতর্ক করা হয়েছিল)। আর আমি তো কেবল আজাবই বৃদ্ধি করব।" (সূরা নাবা: ২১-৩০)
সবচেয়ে ভয়ংকর কথা: এটি কখনো শেষ হবে না। "নিশ্চয় যারা কুফরি করেছে এবং যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলেছে, তারাই জাহান্নামের অধিবাসী, তারা তথায় থাকবে চিরকাল।" (সূরা আল-বাকারা, ২:৩৯)
এই, চিরকাল! শুধু একটি শব্দ নয়— "এটি এক মহাশূন্য ভয়"। সময় যেখানে থেমে যাবে। যন্ত্রণা কখনো কমবে না। আরামের এক সেকেন্ডও নেই। কেবলই আর্তনাদ: "ইয়া হুত! ইয়া হুত!" (হায় দুর্ভোগ! হায় দুর্ভোগ!) হয়তো এই লেখা পড়ে একটু নড়েচড়ে বসেছেন, কিন্তু কয়েক মিনিট পর আবার দুনিয়ার ভিড়ে মিশে যাবেন। আবার গান শুনবেন, হারাম দৃষ্টি দেবেন, গিবত করবেন, নামাজ বাদ দেবেন।
"আর যারা সত্যকে অস্বীকার করেছে, (হে নবী!) তাদের তুমি যতই সতর্ক করো না কেন, তারা কখনো বিশ্বাস করবে না। আল্লাহ তাদের অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন, কানকে করেছেন বধির আর চোখ ঢেকে দিয়েছেন পর্দায়। ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে কঠিন শাস্তি। আবার কিছু মানুষ মুখে বলে, আমরা আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী। কিন্তু ওরা আদৌ বিশ্বাসী নয়। ওরা আল্লাহ ও বিশ্বাসীদের ঠকাতে চায়। আসলে ওরা নিজেদেরই ঠকাচ্ছে, যদিও ওরা তা বোঝে না। ওদের অন্তর রোগগ্রস্ত কলুষিত আর আল্লাহ ওদের এই রোগ ক্রমান্বয়ে জটিল হতে দেন। ক্রমাগত মিথ্যাচার (ও ভণ্ডামির) পরিণামে ওদের জন্যেও অপেক্ষা করছে কঠিন শাস্তি।" (সূরা বাকারা ৬-১০)
উপরোক্ত লেখা পড়ে আপনার অন্তর যদি বিন্দুমাত্র না কাঁপে, তাহলে আপনার নিজের রোগাক্রান্ত অন্তর নিয়ে এই মুহূর্ত থেকে কাজ শুরু করে দিন। উঠে দাঁড়ান, আপনার সম্ভাবনা মহাবিশ্বের মতই বিশাল। মৃত্যুর পরে সিরিয়াস হয়ে কি করবেন? সব ধরনের অজুহাত আর আলসেমি এই মুহূর্ত থেকে ছাড়ুন। কোরআনের মধ্যে ডুব দিন। আল্লাহর সকল নির্দেশ মানতে সচেষ্ট থাকুন। সব সময় তাকে স্মরণ (জিকির) করুন, উঠতে—বসতে অন্তর থেকে ইস্তেগফার পড়ুন। মনে রাখবেন: আপনার জীবনের মূল্যবান সম্পদ হলো সময়, যেটি প্রতিটি সেকেন্ডে সেকেন্ডে ফুরিয়ে যাচ্ছে। সেই সময় নামক সম্পদকে নিজের জীবনে বাড়ানোর জন্য টাকা দিয়ে কেনার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। আর যদি তা না কিনতে পারেন, তাহলে আপনার জীবনের নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেলে, এমন কি আপনার মোবাইলে এই লেখাটি পড়া শেষ করার আগেই বা পরপরই আপনার রূহ যদি উঠে যায় (মৃত্যু এসে যায়), তখন আর আল্লাহর দিকে ফিরে আসার (অথবা তওবার) কোনো সুযোগ থাকবে না। আপনার পরিবার কাঁদবে, আপনার সম্পদ বণ্টন হবে, কিন্তু আপনার আমলনামায় যা লেখা আছে—তা-ই শুধু আপনার সাথে যাবে।
"অতএব যে চায় তার রবের (আল্লাহর) নিকট আশ্রয় গ্রহণ করুক। নিশ্চই আমি তোমাদের কে একটি নিকটবর্তী (ভয়াবহ) আযাব সম্পর্কে সতর্ক করলাম। যে দিন মানুষ দেখতে পাবে তার দু'হাত কী অগ্রে প্রেরণ করেছে এবং কাফির (আল্লাহকে অমান্যকারী) বলবে "হায় আমি যদি মাটি হতাম" (সূরা নাবা:৩৯-৪০)
লেখক : গবেষক ও দাঈয়ী
ভোরের আকাশ/এসএইচ