ভোরের আকাশ ডেস্ক
প্রকাশ : ১২ ডিসেম্বর ২০২৫ ১১:১৯ এএম
ছবি : সংগৃহীত
আধুনিক যুগ। তথ্য ও প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে আমরা সবাই এখন খবর দাতা ও খবর গ্রহীতা, হাতে হাতে খবরের কাগজ, নিউজ চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। যে কোন খবর এখন মুহুর্তে ছড়িয়ে পড়ে বিশে^র এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। রসদযুক্ত খবর মুহুর্তেই হয়ে পড়ে ভাইরাল। ত্রিশ বছর আগের মত খবর পেতে এখন আর খবরের কাগজের অপেক্ষা করা লাগে না। সবার হাতে হাতে দৃশ্যমান স্থির কিংবা গতিশীল খবর ধারণের যন্ত্র। শুধুমাত্র ‘ক্লিক’ আর ‘আপলোড’ এরপর ভাইরাল, আর অন্যজনের প্রদত্ত খবর ছড়িয়ে দেওয়া আরো সহজ জাস্ট ‘শেয়ার’।
খবরদাতা সাংবাদিক কিংবা খবরের কাগজ বা চ্যানেল পরিচালকদের যেমন কিছু নিয়মনীতি বা নর্মস মেনে চলতে হয় তা লাগেনা আমাদের সবার, প্রকৃত ঘটনা যাচাই করেই কেবল সংবাদ প্রচার করতে পারেন তারা, আর আমাদের শুধু খবর হলেই হলো। যদিও বর্তমান সময়ে ভুল সংবাদ প্রচার করে সরি বলতেও দেখা যায় অনেক খবর দাতাদের।
খবর বা তথ্য, হোক সেটা ভালো কিংবা খারাপ আমরা যারা তা যাচাই বাছাই ছাড়াই যে প্রচার কিংবা শেয়ার করছি, আমরা কি উচিত কাজটি করছি? হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীস, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোন লোকের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে (সত্যতা যাচাই না করে) তা-ই বলে বেড়ায়।’ (মুসলিম)।

ইংরেজি শব্দ Misinformation বা Fake news এটি এমন যোগাযোগ প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে ভুলত্রুটিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর তথ্য সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। যে কোনো খবর বা তথ্য আমাদেরকে যাচাই বাছাই করেই অপরকে বলা কিংবা সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো উচিত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘হে মু’মিনগণ! যদি কোন পাপাচারী তোমাদের নিকট কোন বার্তা আনয়ন করে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে, পাছে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোন সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে বস, এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হতে হয়।’ (হুজরাত, ৪৯ : ৬)।
শোনা কথা যাচাই-বাছাই ছাড়াই বলে বেড়ানো বা ছড়িয়ে দেওয়া মিথ্যার একটি রূপ। এর ফলে অনায়াসে ভুল বা মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। অথচ আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মিথ্যাবাদীকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন, এ প্রসঙ্গে তাঁর সহধর্মিণী উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত হাদীস, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট মিথ্যার চেয়ে অধিক ঘৃণিত স্বভাব আর কিছুই ছিল না। কোন ব্যক্তি তাঁর সামনে মিথ্যা কথা বললে সেই বিষয়টি তাঁর স্মরণে থাকত যতক্ষণ না তিনি জানতে পারতেন যে, মিথ্যাবাদী তার মিথ্যা কথন থেকে তওবা করেছে।’ (তিরমিযি)।
তথ্য ও প্রযুক্তি যোগাযোগের বিপ্লবের ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার বা এক্স, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, ইমু, টেলিগ্রাম, লিংকডইন প্রভৃতি যোগাযোগ মাধ্যমগুলো যোগাযোগকে যেমন সহজ করে দিয়েছে তেমনি এগুলো ভুয়া ও মিথ্যা খবর ও তথ্যের অন্যতম উৎস হয়ে উঠেছে। না জেনে শুনে যাচাই-বাছাই না করেই আমরা এসব মাধ্যমে অনেক ভুয়া ও মিথ্যা খবর পোস্ট কিংবা শেয়ার করার মাধ্যমে অপছন্দ ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকে গালাগাল ও অবমূল্যায়ন করছি। একটি শ্রেণী আছে যারা সত্য ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে মিথ্যা সংযুক্ত করে ছড়িয়ে দেয় আরেকটি শ্রেণী আছে খন্ডিত বক্তব্য প্রকাশ করে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ায়।

এদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা আল কুরআনুল কারীমে বলেন, ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত করো না এবং জেনে-শুনে সত্য গোপন করো না।’ (বাকারা, ২ : ৪২)।
অপপ্রচার কিংবা মিথ্যা প্রচার এতটাই জঘণ্য যে এর ফলে আমাদের সমাজে অনায়াসে খুন-খারাবী মত ঘটনা ঘটে যায়, এমন ঘটনা রয়েছেও অসংখ্য। একে শেষ যুগ বা ফিতনার যুগের কাজ উল্লেখ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, দুনিয়া খতম হবে না যে পর্যন্ত না মানুষের নিকট আসে এমন এক যুগ, যখন হত্যাকারী জানবে না যে, কি কারণে সে হত্যা করেছে এবং নিহত ব্যক্তিও জানবে না যে, কি কারণে সে নিহত হয়েছে। প্রশ্ন করা হল, এমন যুলুম কিভাবে হবে? তিনি বললেন: সে যুগটা হবে খুনাখুনির যুগ। এরূপ যুগের হত্যাকারী ও নিহত উভয় ব্যক্তিই জাহান্নামী হবে।’ (মুসলিম)।
বর্তমান সময়ে মিথ্যে তথ্য প্রচার ও প্রোপাগান্ডা খুব ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এমনকি কারো কারো ব্যাপারে জেনে শুনে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হচ্ছে এবং তা নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা কবিরা গুনাহের অন্তর্ভূক্ত, এই মিথ্যে অপবাদ যারা আবার শেয়ার এর মাধ্যমে ছড়াচ্ছেন তারা কিন্তু একই অপরাধে অপরাধী হচ্ছেন।
ইতিহাসের অন্যতম জঘন্যতম অপবাদের ঘটনা ইফকের ঘটনার উল্লেখ করে আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারীমে বলেন, ‘যখন তোমরা মুখে মুখে এটি ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে যার কোন জ্ঞান তোমাদের ছিল না এবং তোমরা এটিকে তুচ্ছ গণ্য করেছিলে, যদিও আল্লাহর নিকট এটি ছিল গুরুতর বিষয়।’ (নূর, ২৪ : ১৫)।
অপবাদ আরোপ এক জঘন্য অপরাধের নাম, অপবাদ মিথ্যার থেকেও জঘন্য, এতে বান্দার অধিকার ক্ষুন্ন হয়। সমাজব্যবস্থা ধ্বংস সমাজে অরাজকতার সৃষ্টি হয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও আস্থা হারিয়ে যায়, সম্পর্কে চিড় ধরে একপর্যায়ে ছিন্ন হয়ে যায়। অপবাদ প্রদানকারীকে পবিত্র কুরআনে অভিশপ্ত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অপবাদ আরোপের দ্বারা ব্যক্তি অন্যের সম্মানহানির পাশাপাশি নিজেকে কবিরা গুনাহে লিপ্ত করে, যা কোনো ক্ষেত্রেই কল্যাণকর নয়।

অপবাদের শাস্তির কথা উল্লেখ করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘যাহারা সাধ্বী, সরলমনা ও ঈমানদার নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে তারা দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত এবং তাহাদের জন্য আছে মহাশাস্তি।’ (নূর, ২৪ : ২৩)।
কোনো তথ্য পাওয়া মাত্রই যাচাই-বাছাই না করে ছড়িয়ে দেওয়া ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করাকে ‘চিলে কান নেওয়া’ প্রবাদের মাধ্যমে ব্যঙ্গ করা হয়।
এমন করে ভুল তথ্য ছড়ানোকে ব্যঙ্গ করে কবি শামসুর রহমান তার ‘পন্ডশ্রম’ কবিতায় বলেন, ‘এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে,
চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।
কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতারবিলে,
আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে।
দিন-দুপুরে জ্যান্ত আহা, কানটা গেল উড়ে,
কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুঁড়ে।
কান গেলে আর মুখের পাড়ায় থাকল কি-হে বল?
কানের শোকে আজকে সবাই মিটিং করি চল।’
প্রকৃত সত্য না জেনে যে কোন তথ্য ছড়ানো উচিত নয়। কোনো বিষয়ের প্রকৃত জ্ঞান ছাড়া শুধু অনুমানের ভিত্তিতে বলা চূড়ান্ত অপরাধ ও গুনাহের কাজ। এমন ধারণাপ্রসূত অপবাদ আরোপ থেকে বিরত থাকতে হবে। অনুমানলব্ধ জ্ঞানকে কোন কোন ক্ষেত্রে পাপ উল্লেখ করে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘হে মু’মিনগণ! তোমরা অধিকাংশ অনুমান হতে দূরে থাক; কারণ অনুমান কোন কোন ক্ষেত্রে পাপ।’ (হুজরাত, ৪৯ : ১২)।

ভুল-মিথ্যা তথ্য, সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে সংবাদ বা তথ্য প্রকাশ ও শেয়ার করে ছড়িয়ে দেওয়া এগুলো বড় মাপের প্রতারণাও। একজন মুমিনের বিভিন্ন ধরনের ভুল-ত্রুটি থাকতেই পারে, কিন্তু কোনোভাবেই সে মিথ্যাবাদী ও প্রতারক হতে পারে না। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মুমিনের চরিত্রে সব কিছুর অবকাশ থাকতে পারে, কিন্তু প্রতারণা ও মিথ্যা নয়।’ (মুসনাদে আহমাদ, বায়হাকী)।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা অনায়াসেই যে মিথ্যা তথ্য বা সংবাদ ছড়িয়ে থাকি অনেকে এটাকে ক্ষুদ্র মিথ্যা মনে করেন কিন্তু এ মিথ্যাও তাদেরকে বড় মিথ্যাবাদীর দিকেই ধাবিত করে। সত্য ও মিথ্যাবাদীতা সম্পর্কে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) বলেন, ‘তোমরা অবশ্যই সত্যকে অবলম্বন করবে। কেননা সত্য সৎকর্মের দিকে ধাবিত করে আর সৎকর্ম ধাবিত করে জান্নাতের দিকে।
কোন ব্যক্তি যদি সত্য বলতে থাকে এবং সত্যের প্রতি সদা মনযোগ রাখতে থাকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছেও সিদ্দীক হিসাবে তার কথা লিপিবদ্ধ হয়। তোমরা মিথ্যার থেকে বেঁচে থাকবে, কেননা মিথ্যা অন্যায়ের দিকে নিয়ে যায়, আর অন্যায় নিয়ে যায় জাহান্নামের দিকে। কোন বান্দা যখন মিথ্যা বলতে থাকে এবং মিথ্যার প্রতিই তার খেয়াল থাকে এমন কি শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছেও কাযযাব (অতি মিথ্যাবাদী) বলে তার নাম লিপিবদ্ধ হয়।’ (মুসলিম ও তিরমিযি)।
অতএব যে কোন ধরনের তথ্য যাচাই বাছাই ব্যতীত প্রকাশ ও প্রচার করা গুণাহের কাজ। এ ধরণের কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা ও তার রাসূল (সা.)-এর ক্রোধের ধারক-বাহক হয়ে যেতে পারি। অনেক আলেম-ওলামাগণও ফেসবুকে পাওয়া যে কোন তথ্য যাচাই না করেই শেয়ার করে বসেন। আমাদেরকে এ ধরণের কাজ থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালার কাছে আমাদের প্রার্থনা তিনি এ ধরণের গর্হিত কাজ থেকে আমাদেরকে হেফাজত করুন, আমীন।

মাওলানা এ বি এম সাইফুল ইসলাম
সচিব, শরিয়া কাউন্সিল, প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানি লিমিটেড
ভোরের আকাশ/মো.আ.