যুদ্ধবিরতিতে পাক-ভারত
রাজীব দাস
প্রকাশ : ১১ মে ২০২৫ ০৯:২৭ এএম
ট্রাম্প কার্ডে স্বস্তি
ট্রাম্প কার্ডে স্বস্তি ফিরেছে। অতিদ্রুততম সময়ের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্য়কর করেছে ভারত ও পাকিস্তান। যুদ্ধের চরম উত্তেজনার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় পাকিস্তান ও ভারত এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর করে। ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা পৃথক পৃথক বিবৃতিতে যুদ্ধবিরতিতে সম্মতির কথা জানিয়েছেন। এই সিদ্ধান্তের পর পরই পাকিস্তানের আকাশসীমা সকল দেশের বিমানের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধ বন্ধ করতে পাকিস্তান ও ভারতকে রাজি করাতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগ ও সফলতার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দেওয়া হয়েছে।
গতকাল ডোনাল্ড ট্রাম্প তার পোস্টে লিখেন, ‘অবিলম্বে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়ে গিয়েছে ভারত এবং পাকিস্তান।’
নিজের সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘আমেরিকার মধ্যস্থতায় রাতভর (যুক্তরাষ্ট্রের হিসাবে) আলোচনার পর, আমি আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি, যে ভারত এবং পাকিস্তান অবিলম্বে পূর্ণ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।’
এর পরেই ভারত এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে স্বাগত জানিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য, বাস্তবজ্ঞান এবং অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার সদ্ব্যবহার করার জন্য দুই দেশকে অভিনন্দন। এই বিষয়ে (যুদ্ধবিরতি) মনোযোগ দেওয়ার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ! পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী তথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইসাক দারও যুদ্ধবিরতি নিয়ে নয়াদিল্লি-ইসলামাবাদ ঐকমত্যের কথা জানিয়েছেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও গতকাল যুদ্ধবিরতি কথা জানিয়ে এক্স পোস্টে লিখেছেন, ভ্যান্স (মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট) এবং আমি গত ৪৮ ঘণ্টা ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং শাহবাজ শরিফ, ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান অসিম মুনির এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল এবং অসিম মালিক (আইএসআই প্রধান)-সহ ঊর্ধ্বতন ভারতীয় ও পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারই পরিণতিতে সংঘর্ষবিরতি হয়েছে বলে জানান তিনি।
সাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও দুরদৃষ্টির জন্য দুই দেশকেই শুভেচ্ছা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প! সাম্প্রতিক সময়ে কাশ্মীর সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পাকিস্তানের লাগাতার ড্রোন হামলা, ভারতের পাল্টা প্রতিক্রিয়া, আকাশসীমা লঙ্ঘন এবং রাফাল যুদ্ধবিমান মোতায়েনের মতো ঘটনাগুলো দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের আশঙ্কাকে ভয়াবহভাবে বাড়িয়ে তুলেছিল। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে অন্তত ২৬টি এলাকায় হামলার চেষ্টা চালানো হয়, যার বেশিরভাগ ভারত ব্যর্থ করে দেয়। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল যে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের সূচনা হতে পারে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি ঠেকাতে কূটনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করে যুক্তরাষ্ট্র।
হোয়াইট হাউস ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের সূত্র বলছে, পাকিস্তান প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সহায়তা চেয়ে যোগাযোগ করে। এরপরেই মার্কিন প্রশাসন সক্রিয়ভাবে দুদেশের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে টানা ৪৮ ঘণ্টা ধরে আলোচনা চালায়।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানান, তিনি এই সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান অসিম মুনির, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল এবং পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা আসিম মালিক সবাইয়ের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেন। রুবিও বলেন, আমরা দুই দেশের নেতৃত্বের দূরদর্শিতা ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতাকে আন্তরিকভাবে সাধুবাদ জানাই।
যুদ্ধবিরতির কথা নিশ্চিত করে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসাক দার সোশ্যাল মিডিয়ায় এক পোস্টে জানান, আমরা ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছি এবং তা গতকাল বিকেল ৫টা থেকে কার্যকর হয়েছে। কিছুক্ষণ পর ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ও জানায়, পাকিস্তানের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এবং আন্তর্জাতিক শান্তির স্বার্থে ভারত এই সংঘর্ষবিরতিতে সম্মত হয়েছে।
ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিক্রম মিসরি বলেন, গতকাল বিকাল ৩টা ৩৫ মিনিটে পাকিস্তানের ডিজিএমও ভারতের ডিজিএমওকে ফোন করেন। ওই আলোচনার মাধ্যমেই দুই দেশের মধ্যে আকাশ, স্থল ও জলপথে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি হয়। এরপর বিকেল ৫টা থেকে তা কার্যকর হয়।
তিনি আরও জানান, ১২ মে দুই দেশের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা সরাসরি বৈঠকে বসবেন, যেখানে ভবিষ্যতের নিরাপত্তা কাঠামো এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের রূপরেখা তৈরি হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই যুদ্ধবিরতির পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দৃঢ় অবস্থান, ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের চাপ এবং রুবিওর দ্রুত কূটনৈতিক তৎপরতা এই সমঝোতার পথ সুগম করে দেয়। এমনকি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গেও একাধিকবার কথা বলেন রুবিও।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এখন প্রশ্ন উঠছে, এই যুদ্ধবিরতি কি সত্যিই একটি দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথে অগ্রগতি, নাকি সাময়িক একটি কৌশলগত বিরতি? দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বলছে, এ অঞ্চলে সংঘাত প্রায়শই রাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ চাপের কারণে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তবে এবার আন্তর্জাতিক চাপ এবং যুদ্ধের বিপুল সম্ভাব্য খরচ উভয় দেশকেই হয়তো বাস্তববাদী পথে হাঁটার জন্য বাধ্য করেছে। এই মুহূর্তে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলা যাবে না। দুই দেশকেই কৌশলগতভাবে সংযম দেখাতে হবে এবং একে অপরের ওপর আস্থা তৈরি করতে হবে।
বিশেষ করে সীমান্তে টহল, আকাশপথ ব্যবস্থাপনা এবং সন্ত্রাসবাদ নিয়ে সহযোগিতার দিকগুলোতে উভয় দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। এই যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে সেই শান্তি কতটা টিকবে, তা নির্ভর করছে পরবর্তী কয়েকদিনের ওপর কূটনৈতিক অঙ্গনে যেভাবে আলোচনার ধারা বজায় রাখা যায় এবং উসকানিমূলক ঘটনা কীভাবে এড়িয়ে চলা যায়, তার ওপরই নির্ভর করছে পুরো অঞ্চলের ভবিষ্যৎ।
ভোরের আকাশ/এসএইচ