মো. রেজাউর রহিম
প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৫ ১২:১০ এএম
ছবি- সংগৃহীত
আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে, বিশেষ করে নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) কর্মকর্তাদের মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে। আর সাম্প্রতিককালে নির্বাচনকে ঘিরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বোমা-ককটেল বিস্ফোরণ, হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় মাঠপর্যায়ের নির্বাচন কর্মকর্তারা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়েছেন।
এছাড়া সম্ভাব্য হামলা, ভয়ভীতি ও রাজনৈতিক চাপের আশঙ্কায় অনেকে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে আতঙ্কে আছেন। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন আঞ্চলিক, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নির্বাচন কার্যালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দীন আসন্ন নির্বাচন নিরপেক্ষ এবং এ নির্বাচনে সব রকম চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করার ওপর জোর দিয়েছেন। এছাড়া জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের দাবি অনুযায়ী জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে ‘গণভোট’ আয়োজনের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে ইসি। আর গণভোট জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন হোক বা আগে হোক-এই নির্বাচনের জন্য ইসির বাড়তি কিছু প্রস্তুতির প্রয়োজন বিধায় সরকারের নির্দেশনা পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে সেই প্রস্তুতিও শুরু করবে ইসি।
ইসি সূত্র জানায়, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ র্বিাচন অনুষ্ঠোনে আগামীকাল ১৩ নভেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপও শুরু করছে। এছাড়া নির্বাচনের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষ করে তফসিল ঘোষণার অপেক্ষায় থাকবে নির্বাচন কমিশন।
এদিকে, নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে ততই নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে।
ইসি’র বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, মাঠপর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের জনবল বেশ কম, তার ওপর রাজনৈতিক চাপের কারণে কর্মকর্তাদের মধ্যে কিছুটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তাদের আশঙ্কা, নির্বাচনের সময় হামলা ও নাশকতার ঘটনা আরও বাড়তে পারে।
অবশ্য, ইতোমধ্যে নিরাপত্তা জোরদারের বিষয়টি কমিশনকে জানানো হয়েছে বলেও জানান তারা। তবে শুরু থেকেই অপরাধ দমনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হলে নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু থাকবে। আর নারীদের প্রতি সাইবার বুলিং প্রতিরোধ, সংখ্যালঘু ও জঙ্গীকার্ড ইস্যুর মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
পাশাপাশি মানুষের চরিত্র হননের ঘটনা মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে হবে। খারাপ তথ্য প্রতিরোধে নিয়মিত ও দ্রুততার সঙ্গে ভালো তথ্য সরবরাহ করতে হবে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান প্রদানের ব্যবস্থা রাখতে হবে। নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে দ্রুত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার, তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিভিন্নস্থানে নিরাপত্তা চেক পয়েন্ট বসানো, প্রয়োজনে সীমান্ত ও সি-রুট সিল করা, বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়ার মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য বিভিন্ন নাশকতার ঘটনা প্রতিরোধে সকলকে সজাগ থাকতে হবে বলে মনে করেন তারা।
আসন্ন নির্বাচনে নিরাপত্তার বিষয়ে নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দীন ভোরের আকাশকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনে কিছু প্রতিকূলতা ও চ্যালেঞ্জ থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় এবং আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলে চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতা দূর করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কত সংখ্যক জনবল নিয়োগ হলো তার চেয়ে- নিয়োগকৃতরা পেশাদারিত্ব ও আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে কি না, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। অবাধ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে ইসি সম্ভাব্য সবকিছু করবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জানা গেছে, সম্প্রতি টাঙ্গাইলের গোপালপুরে উপজেলা নির্বাচন অফিসে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা নজরুল ইসলামকে মারধর করা হয়। ঘটনায় তিনজন আহতও হয়েছেন। গুরুতর আহত অবস্থায় ডাটা এন্ট্রি অপারেটর আমজাদ হোসেনকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় ইসি সচিবালয়সহ সকল পর্যায়ের ইসি কর্মকর্তারা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
এদিকে, গত ২৫ অক্টোবর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে অনেক জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেই চলছে। এর প্রেক্ষিতে গত ২৮ অক্টোবর ভবনের নিরাপত্তা জোরদার করতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারকে চিঠিও দিয়েছে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সংস্থাটি।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনার পর নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনায় এলাকাটি বিশেষ নজরদারির আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া অফিস সময়ের বাইরে নির্বাচন ভবনের আশপাশে রাত পর্যন্ত ব্যবসায়িক কার্যক্রম চলমান থাকায় সেখানে নাশকতার ঝুঁকি বেড়ে গেছে বলে মনে করছে ইসি। এ কারণে এসব ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধসহ নিরাপত্তা টহল জোরদার করা করা প্রয়োজন।
নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার জানান, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হলে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন সহজ হবে। নির্বাচনে প্রিজাইডিং অফিসাররা গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেন, এই জন্য তাদের নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করা খুবই জরুরি।
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে নির্বাচন পূর্ব সময়ে কিছু অস্বাভাবিক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। একটি ‘দুষ্টচক্র’ প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, পরাজিত প্রার্থী কর্তৃক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা, বিগত দিনের নির্বাচনের খারাপ অভ্যাসগুলো সংস্কৃতির রূপ ধারণ করায় নির্বাচনী অনিয়মের চেষ্টা এবং নির্বাচনকে বিতর্ক তৈরির চেষ্টাসহ সব প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাজ করছে ইসি।
গণভোট নিয়ে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ইসি : ইসি সূত্র জানায়, ফেব্রুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে প্রস্তুতি প্রায় গুছিয়ে এনেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। চলতি মাসের মধ্যে প্রাকপ্রস্তুতি শেষ করে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার চিন্তা করছে কমিশন।
অন্যদিকে, গণভোটের সময়সূচি নিয়ে এখনো রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে না আসতে এ বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে ইসি। গণভোটের বিষয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে, ইসি সেভাবে তা বাস্তবায়ন করবে। এছাড়া সংসদ নির্বাচনের ভোটার তালিকাও সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। খসড়া অনুযায়ী এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ১২ কোটি ৭৬ লাখ ১২ হাজার ৩৮৪ জন। আগামী ১৮ নভেম্বর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হতে পারে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, এবারের নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও মানুষের মধ্যে রয়েছে নানারকম জল্পনা-কল্পনা। আর গণভোট এর সময়সূচীর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ এখনও রয়ে গেছে। বিএনপি চায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হোক।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি চায় গণভোট জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই হোক। তবে এ ব্যাপারে ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, গণভোটের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন এখনো সরকারের কাছ থেকে কোনো নির্দেশনা পায়নি। সরকারের নির্দেশনার পর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় কাজ শুরু করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আচরণবিধির গেজেট, পোস্টার নিষিদ্ধ, অঙ্গীকারনামা বাধ্যতামূলক
এদিকে, আগামি জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রথমবারের মতো সব প্রার্থীর জন্য একই মঞ্চে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করার বাধ্যবাধকতা রেখে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর জন্য ‘আচরণ বিধিমালা, ২০২৫’ জারি করেছে নির্বাচন কমিশন। গত রোববার দিবাগত রাতে বিধিমালাটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। এতে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ এবং ২০০৮ সালের আচরণবিধির সঙ্গে সমন্বয় রেখে বেশ কিছু নতুন ও কঠোর বিষয় যুক্ত করে এই আচরণবিধি প্রণয়ন করা হয়েছে।
জানা গেছে, নতুন এই বিধিমালায় ভোটের প্রচারণায় প্রথমবারের মতো ‘পোস্টার’ ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি ড্রোন ব্যবহার এবং বিদেশে যে কোনো ধরনের প্রচারণা কার্যক্রমেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
এছাড়া বিধিমালা অনুযায়ী, পরিবেশ দূষণ রোধ ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণে নির্বাচনী প্রচারণায় ‘ড্রোন’ ব্যবহারের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আর প্রার্থীর পক্ষে ২০টির বেশি বিলবোর্ড, ব্যানার বা ফেস্টুন ব্যবহার করা যাবে না। এছাড়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভোটের প্রচারেও কঠোর নিয়ন্ত্রণ আনা হয়েছে। আর অসৎ উদ্দেশ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে কোনো প্রচার চালানো সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নতুন বিধি অনুযায়ী, আচরণবিধি কঠোরভাবে মেনে চলার জন্য রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের নির্বাচন কমিশনে একটি অঙ্গীকারনামা জমা দেয়াও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।এছাড়া আচরণবিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে এবার কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। কোনো প্রার্থী বিধিমালা ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড ও দেড় লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে। রাজনৈতিক দলের জন্যও দেড় লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। গুরুতর লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে তদন্ত সাপেক্ষে প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতাও নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ