মাহমুদ সালেহীন খান
প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২৫ ১২:২০ এএম
ছবি- সংগৃহীত
পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মামলার রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ নিয়ে গত কয়েকদিন ও গতকাল বুধবার বেশকিছু নাশকতার ঘটনা ঘটায় রাজধানীর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় একপ্রকার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। একের পর এক ককটেল বিস্ফোরণ এবং বাসসহ বিভিন্ন যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক বেড়েই চলেছে। সরকার থেকে নিরপত্তা জোরদার করা হয়েছে। রাজধানীর মোড়ে মোড়ে পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছে।
গত ২৪ ঘন্টায় ৪৫ জন আলীগ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে মাঠে থাকার আহ্বান জানানো হয়। সরকারের ডাকে সাড়া দিয়ে বিএনপি, জামায়াতসহ ৮ ইসলামি দল, গণ অধিকার পরিষদ, এনসিপিসহ জুলাই অভ্যূান্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজনৈতিক দলগুলো আলীগের কর্মসূচী ঠেকাতে নিজ নিজ কর্মসূচী দিয়েছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার রায়ের দিন নির্ধারণ নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। ওই দিন কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শক্ত অবস্থানে থাকবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ১৩ নভেম্বর কোনো ধরনের শঙ্কা নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। সন্ত্রাসীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
এর আগে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সভাপতিত্বে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠক সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার বিচারের রায়ের দিন নির্ধারণ ঘিরে কর্মসূচি দেওয়ায় ১৩ নভেম্বরের পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) দলগুলোকে মাঠে থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে। কাউকে সন্দেহ হলে, আইন হাতে তুলে না নিয়ে পুলিশকে জানাতে বলা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সবার সহযোগিতা চেয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাবেন।
আপনারা অনেক সময় বলেন, সন্ত্রাসীরা খুব তাড়াতাড়ি জামিন পেয়ে যায়। সহজে যাতে জামিন না পায়, সেজন্য যারা জামিন দেন, আমরা তাদের কাছে অনুরোধ করব। সন্ত্রাসী যারা জেল থেকে জামিনে বের হচ্ছে, তারা অন্য ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত হলে যেন আবার আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের শনাক্তে অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। রাজধানীজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সতর্ক অবস্থায় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীর প্রবেশপথে বাড়ানো হয়েছে চেকপোস্ট ও তল্লাশি কার্যক্রম। বিমানবন্দর, আব্দুল্লাহপুর, ধানমন্ডি ৩২, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, কাকরাইল ও হাইকোর্ট এলাকায় গাড়ি থামিয়ে চালকদের পরিচয়পত্র ও কাগজপত্র যাচাই করছে পুলিশ। পাশাপাশি রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় ১২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
বিজিবির কর্মকর্তারা জানান, নাশকতার আশঙ্কা মাথায় রেখে এই মোতায়েন করা হয়েছে। কেউ সহিংসতা বা ভাঙচুরের চেষ্টা করলে কঠোরভাবে দমন করা হবে। এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ৪৪ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগ পৃথক অভিযানে আরও বেশ কয়েকজনকে আটক করেছে। মঙ্গলবার রাত থেকে ফকিরাপুল, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, কাকরাইল, এলিফ্যান্ট রোডসহ রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে অভিযান চালানো হয়। হোটেল অতিথিদের জাতীয় পরিচয়পত্র, পেশা ও ঢাকায় আগমনের কারণ জানতে চাওয়া হয়। সন্দেহভাজনদের মোবাইল ফোনও পরীক্ষা করে দেখা হয়।
রমনা বিভাগের ডিসি মাসুদ আলম বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট তথ্যেরভিত্তিতেই অভিযান চলছে। কলাবাগানের একটি মেস থেকে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যারা নাশকতার পরিকল্পনায় ঢাকায় জড়ো হয়েছিল বলে ধারণা।’
পুলিশ জানায়, সন্দেহভাজনদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর তথ্য যাচাই করা হয় সিডিএমএস (অপরাধীদের ডাটাবেজ) এ। অনেকের বিরুদ্ধেই পূর্বের মামলা পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, রায় ঘোষণার আগে ও পরে যেকোনো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা প্রস্তুত।
গত সোমবার গভীর রাত থেকে গতকাল বুধবার ভোররাত পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গেট, উত্তরা ও মিরপুর ১ নাম্বারে চারটি বাস ও একটি প্রাইভেটকারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অগ্নিকাণ্ডের এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার রাশেদ বিন খালিদ। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর মিরপুর ১ নম্বরে সনি সিনেমা হলের সামনে ‘শতাব্দী’ পরিবহনের একটি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
গত মঙ্গলবার রাত ১২টা ৫৫ মিনিটের দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় রাজধানী পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এরপর রাত ২টা ৮ মিনিটের দিকে যাত্রাবাড়ীর ইবনে সিনা হাসপাতালের সামনে রাইদা পরিবহনের আরেকটি বাসে আগুন লাগে। রাত ২টা ৩৫ মিনিটের দিকে ১০০ ফুট রোড-সংলগ্ন বসুন্ধরা গেট এলাকায় একটি প্রাইভেটকারে আগুন লাগে।
এরপর সর্বশেষ ভোর ৪টার দিকে উত্তরার সোনারগাঁও জনপদের খালপাড় এলাকায় রাইদা পরিবহনের আরেকটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। রাজধানীর ধানমন্ডির ১১/এ এলাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) তদন্ত সংস্থা কার্যালয়ের সামনে গত মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়াও সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, আগারগাঁও, মিরপুর, বাংলামোটরসহ বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেছে। এসব ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও পেট্রোল বোমা : দুর্বৃত্তরা শুধু ককটেল বিস্ফোরণ বা বাসে আগুন দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না, তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করছে। সর্বশেষ, মঙ্গলবার দিবাগত রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের গার্লস শাখায় পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। যদিও এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকায় অবস্থিত রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, সুপ্রিম কোর্ট, সচিবালয়সহ প্রধান প্রধান সরকারি অফিসগুলোতে পুলিশের পাশাপাশি পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশ, র্যাব, বিজিবির পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরাও মাঠপর্যায়ে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাজ করছেন।
বিশেষ নজর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে : পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এসব রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ছাড়াও রাজধানীর বনানী, উত্তরা, বাড্ডা, পল্টন ও ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকায় বাড়তি পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তবে, বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরসহ সম্পূর্ণ ধানমন্ডি এলাকায়।
ধানমন্ডি থানা সূত্রে জানা যায়, বিশেষ করে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এলাকায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের নাশকতার ঘটনা যেন না ঘটতে পারে, সেজন্য গত দুই দিন ধরেই সেখানে পুলিশের ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। সন্দেহজনক যান চলাচল দেখলে পুলিশ ব্যারিকেডে আটকে তল্লাশি করছে। গত কয়েক দিনের ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনার ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অধিকাংশ ঘটনা ঘটেছে রাতের বেলায়। সেজন্য রাতে যেন কোনো ধরনের নাশকতার ঘটনা না ঘটতে পারে, সেজন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও কার্যক্রম গ্রহণ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও থানায় বাড়তি নজর: ঢাকার বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা জোরদারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ডিএমপি।
এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর বর্তমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রতিটি থানার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সাম্প্রতিক যে ঘটনাগুলো ঘটছে, এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নাশকতার শঙ্কায় রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থেকে শুরু করে প্রতিটি থানার সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৮ থেকে ১০ জন করে অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
রমনা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গোলাম ফারুক বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় গত কয়েক দিন ধরে রমনা থানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। শুধু থানায় নয়, রমনা থানার অধীনে যেসব এলাকা আছে, সেসব এলাকায়ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
ডিএমপির শাহবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খালিদ মনসুর বলেন, থানার সামনে বাড়তি পুলিশ সদস্য মোতায়েনের বিষয়টি স্বাভাবিক নিরাপত্তা কার্যক্রম।
এছাড়া, শাহবাগ থানা এলাকায় প্রায়ই দাবি-দাওয়া নিয়ে বিভিন্ন আন্দোলন সংঘটিত হয়। এসব বিষয় এবং বর্তমান পরিস্থিতি মাথায় রেখে বাড়তি পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তবে, বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ