হোয়াইটওয়াশ হলো আয়ারল্যান্ড
রাজীব দাস
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৫ ০৪:১৩ পিএম
আইরিশদের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের ট্রফি হাতে উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশ দল। ছবি-ভোরের আকাশ
বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে যেসব দিন লাল অক্ষরে লেখা থাকে, আজ ছিল তেমনই একটি দিন। মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে এক পরিচিত আবেগের জায়গা; কখনো হতাশা, আবার কখনো বন্য উচ্ছ্বাসে ডুবে থাকে এই মাঠ। তবে আজ ছিল উজ্জ্বল আনন্দের দিন যে দিনে দেশের অন্যতম সেরা ব্যাটার, পরিশ্রমের আরেক নাম মুশফিকুর রহিম খেললেন তার শততম টেস্ট ম্যাচ। শততম টেস্ট শব্দ দুটি শুধু সংখ্যা নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেট পরিক্রমার ইতিহাস।
যে দেশে টেস্ট ক্রিকেটের সূচনা হয়েছিল ২০০০ সালে, সেখানে একজন ব্যাটারের শততম ম্যাচে নামা মানে এক যাত্রার সীমানা ছোঁয়া। আর সেই বিশেষ দিনে বাংলাদেশ উপহার দিল এক মহাজয় ২১৭ রানের উদ্বেলিত সাফল্য, যা শুধু একটি ম্যাচ নয়, বরং মুশফিকের দুই দশকের পরিশ্রম, নিবেদন আর স্থৈর্যকে সম্মান জানানোর নিখুঁত উপায় হয়ে উঠল। একই সঙ্গে নাজমুল হোসেন শান্তর দল সিলমোহর মেরে নিল ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জয়। আর দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও শেষ পর্যন্ত হোয়াইটওয়াশ হলো সফরকারী আয়ারল্যান্ড।

মুশফিকের শততম টেস্টের কথা ঘোষণার পর থেকেই মিরপুরে ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ঝুলেছিল মুশফিকের বড় বড় ব্যানার, মি: ডিপেন্ডেবল, ১০০ টেস্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। মিরপুরের গেটে প্রবেশ করলেই ভেসে আসছিল শিশুর মুখে মুশফিক-স্তুতি ‘মুশফিক খেলবে আজ, বাংলাদেশ জিতবেই!
ডিয়ামের কর্মীরা পর্যন্ত বলছিলেন মুশফিকের শততম টেস্টে যেন কিছু বিশেষ হয়। আর সত্যিই কিছু বিশেষ হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে আয়ারল্যান্ডের বোলারদের ওপর প্রথম থেকেই চাপে রাখে। টপ অর্ডার কিছুটা নড়বড়ে হলেও শৃঙ্খলিত ব্যাটিংয়ে মুশফিক ও লিটন দাস দলকে গড়ে দেন শক্ত ভিত।
মুশফিকের ব্যাটিং সবসময়ই দায়িত্বশীল। এই ম্যাচেও তার ব্যতিক্রম হলো না। ধীরে শুরু করে তিনি এগোতে লাগলেন কচ্ছপের মতো স্থিরতায়, আর শট খেলতে লাগলেন উচ্চমানের ব্যাটিং শিল্পীসুলভ শান্ত ভঙ্গিতে। শততম টেস্টে তিনি যেন নিজের পুরো ক্যারিয়ারের মিশ্রণ দেখিয়ে দিলেন ধৈর্য, টেকনিক, বিচারবুদ্ধি। লিটন দাসকে সঙ্গে নিয়ে জোড়া সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশ তোলে ৪৭৬ রান যা মিরপুরে প্রায় অপরাজেয় টোটাল।
জিততে হলে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ প্রথম থেকেই পেতে হতো। সেটি এনে দিলেন তাইজুল ইসলাম। তিনি একাই ভেঙে দেন আয়ারল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপ। শ্লথ পিচে তিনি যেন ভিন্ন মাত্রায় ছিলেন লাইন, লেংথ আর টার্ন আইরিশরা ২৬৫ রানে থেমে গেলে বাংলাদেশের লিড দাঁড়ায় বিশাল। দুই ইনিংস মিলিয়ে ব্যাটিংয়ে ছিল বাংলাদেশের পূর্ণ আধিপত্য। সাদমান ৭৮, জয় ৬০, মুমিনুল ৮৭, আর মুশফিক শততম টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৩, অথচ অপরাজিত। ৪ উইকেটে ২৯৭ রানে ইনিংস ঘোষণা করে বাংলাদেশ। ৫০৯ রানের লক্ষ্য তাড়া করা যে সহজ নয় তা শুরু থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
চতুর্থ দিনের শেষে আইরিশদের স্কোর ছিল ১৭৬/৬। বাংলাদেশ জয়ের গন্ধ পেয়ে খাবি খাচ্ছিল মাঠে। গ্যালারিতে ঢাক-ঢোল, পতাকা ও উৎসবমুখর পরিবেশ শুরু হয়ে গিয়েছিল তখনই। কিন্তু ক্রিকেটের নাম যদি হয় ‘গ্লোরিয়াস আনসার্টেনটি’, তবে পরদিন ঘটল ঠিক সেইরকম কিছু। বাংলাদেশের ম্যাচ জেতার জন্য দরকার ছিল মাত্র ৪ উইকেট। কিন্তু ক্যাম্ফার পরিস্থিতি বদলে দিলেন তার অবিশ্বাস্য ধৈর্যে। ২৫৯ বলের ‘অলৌকিক’ প্রতিরোধ, ২৫৯ বল ৭১ রান এক প্রান্ত আগলে থাকা। এই ধরনের ইনিংস সাধারণত দেখা যায় বড় দলের হয়ে খেলা পরীক্ষিত ব্যাটারদের কাছ থেকে।
কিন্তু ক্যাম্ফার দেখালেন ইস্পাত-কঠিন মানসিকতা। তার সঙ্গে গ্যাভিন হোয়ের ৩৭ রানের লড়াই আয়ারল্যান্ডকে দীর্ঘায়িত করে। মিরপুরের গ্যালারিতে তখনও কেউ কেউ বলতে শুরু করে, এ যাত্রায় হয়তো ড্র হবে! ক্যাম্ফারকে একা রেখে অন্য প্রান্তে চাপ বাড়িয়ে যেতে থাকেন হাসান মুরাদ। তাইজুলের সঙ্গে মিলেমিশে দুজন মিলে দ্বিতীয় সেশনের মাঝামাঝি সময়েই আয়ারল্যান্ডকে ভেঙে ফেলেন। শেষ ৪ উইকেট যেন মুহূর্তেই তুলে নিলেন তারা। ১১৩.৩ ওভারে আয়ারল্যান্ড থেমে গেল ২৯১ রানে।
স্পিনের মুগ্ধকর নৈপুণ্যই বাংলাদেশের জয় এনে দিল শেষ পর্যন্ত। ম্যাচ শেষে আবেগঘন দৃশ্য মুশফিককে ঘিরে সতীর্থদের উচ্ছ্বাস। শেষ উইকেট পড়তেই সতীর্থরা দৌড়ে গিয়ে মুশফিককে ঘিরে ধরলেন। মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা মুশফিকের মুখে ছিল স্থির হাসি সময় যেন স্থির হয়ে গিয়েছিল এক মুহূর্তের জন্য। ক্যামেরায় ধরা পড়ল সতীর্থদের কাঁধে তুলে নেওয়া, দর্শকদের ‘মুশফিক! মুশফিক!’ ধ্বনি, ড্রেসিংরুমের বারান্দায় খেলোয়াড়দের করতালির ঝড়। এ যেন শুধু এক ক্রিকেটারকে সম্মান জানানো নয়, বরং বাংলাদেশের ক্রিকেট অধ্যায়ের এক উজ্জ্বল অধ্যায়কে উদযাপন।
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে যারা দেশের হয়ে দীর্ঘক্ষণ নিরলস সেবা দিয়েছেন তাদের তালিকায় মুশফিক অন্যতম শীর্ষে। শততম টেস্ট মানে ২০ বছরের বেশি পেশাদার ক্রিকেট, হাজারো পরীক্ষা, বিপর্যয়ের মাঝেও দলের ত্রাতা, সবচেয়ে কঠিন সময়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব এবং একজন পেশাদারের সবটুকু। এই শততম টেস্টও তার সাক্ষী হয়ে থাকবে। এই সিরিজ জয় শুধু জয় নয়, বরং দলের মানসিক শক্তি বৃদ্ধি, নতুনদের আত্মবিশ্বাস, ব্যাটিং গভীরতা প্রমাণ, স্পিনারদের আধিপত্য, আর শান্তর নেতৃত্বে কৌশলগত স্থিরতা। এই সাফল্য ভবিষ্যতের বড় সিরিজের আগেই বাংলাদেশকে এনে দিল বাড়তি শক্তি।
মুশফিকুর রহিমের শততম টেস্ট জয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হলো এক পুনর্জাগরণের গল্প। এই জয় যেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে এক মিষ্টি বাতাস। একই সঙ্গে ক্রিকেটার, দর্শক ও দেশের ক্রিকেটভক্তদের মনে চিরস্থায়ী হয়ে রইল। শততম টেস্টে মুশফিক ইতিহাস, পরিশ্রম ও জয়ের প্রতীক।
ভোরের আকাশ/এসএইচ