মাহমুদ সালেহীন খান
প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৯:২১ এএম
ছবি: সংগৃহীত
লাগামহীন দ্রব্যমূল্য কেড়ে নিচ্ছে মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষগুলোর জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। উচ্চমূল্যের এই বাজারে তাদের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। একইসঙ্গে অনিশ্চয়তা বাড়ছে ভবিষ্যৎ নিয়ে। বিশেষ করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে কোনোক্রমে নিজেদের আয়ের হিসেব মেলাতে পারছেন না তারা। বলা হচ্ছে, এখন আর আগের মতো রাস্তাঘাটে বিভিন্ন খাতে চাঁদা দিতে হয় না। তারপরও কেন দ্রব্যমূল্য কমছে না, তার জবাব মেলানো যাচ্ছে না। উচ্চবিত্তদের অবশ্য বাজারমূল্য নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। মাথাব্যথা মধ্য-নিম্নবিত্তদের। নূরুল ইসলাম কাঁচাবাজারে অন্যের মালামাল বহনের কাজ করেন। এই কাজ উনি করছেন আনুমানিক ২০ বছর ধরে। তার প্রতিদিন গড়ে আয় হয় ৬০০ টাকা। অন্যের বাজার বহন করলেও নিজের বাজার করতে হিমশিম অবস্থায় পড়তে হয় তাকে।
নিজের অবস্থার কথা জানিয়ে নুরুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, ৬০০ টাকা দিয়ে সংসার কীভাবে চালাই আমি নিজেই জানি না। আল্লাহই চালায় মনে হয়। আমার বাসায় আমার স্ত্রী, মেয়ে, ছেলে, ছেলের বউ থাকে। দুইটা রুম ভাড়া নিয়ে থাকি। ছেলে আর ছেলের বউ বাসা ভাড়া দেয়। আর আমি খাবার খরচ দেই। কোনও রকমে টিকে আছি। যে টাকা পাই তা দিয়ে চাল কিনবো নাকি মাছ মাংস সবজি কিনবো বুঝতে পারি না। অথচ লাগে সবকিছুই। সঙ্গে তেল, লবণ, মসলা তো আছেই। কীভাবে চলছি সত্যিই জানি না।’
এই বক্তব্য শুধু নূরুল ইসলামেরই না। এমন অনেক নূরুল ইসলাম রয়েছে এই শহরে কিংবা এই দেশে, যারা উচ্চমূল্যের বাজারের চাপ আর সইতে পারছেন না। প্রতিনিয়তই ভুগছেন নিজেকে নিয়ে, পরিবারকে নিয়ে। গতকাল রাজধানীর মিরপুর ১ নম্বরের কাঁচাবাজার গিয়ে কথা হয় বাজার করতে আসা আরও ক্রেতা এবং বিক্রেতাদের সঙ্গে।
জানা যায়, তাদের অবস্থা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আজকের পরিস্থিতি। ইমরান আজিম এসেছিলেন তার স্ত্রীকে নিয়ে বাজার করতে। তিনি একটি ডিমের দোকানে গিয়ে ভাঙা ডিম কিনছিলেন। তিনি জানান ভাঙা হাঁসের ডিম কিনছেন বাসার জন্যই। তিনি বলেন, ‘যখন পারি তখন ভালোটা কিনি আর যখন পারি না তখন যেগুলো ভাঙা ডিম কিন্তু নষ্ট না সেগুলো কিনে নেই।’
আরেক ক্রেতা সুলতানা শারমিন এসেছিলেন বাজার করতে। তিনি বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাসায় ১০০ টাকার ওপরের সবজি খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এর নিচে যা পাই তাই কিনি আজকাল। কারণ আমার বাজেটে কুলায় না। আর যদি আরও দাম বাড়ে তাহলে সবজি খাওয়াই বন্ধ করে দিবো।’
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সাইফুল ইসলাম। তিনি মূল বাজার থেকে না কিনে কিনছিলেন রাস্তায় ঝুড়ি নিয়ে বসা বাজার থেকে। মূলত বাজারের ভেতরের থেকে বাইরে বসা এই বাজারে সবজির দাম কিছুটা কম। সাইফুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘বাজারে জিনিসের দাম মানুষের নাগালের বাইরে। সবজির দাম তো অত্যধিক, মাছ-মাংসের কথা তো বাদই। মানুষ যে মাছ-মাংস না খেয়ে সবজি খাবে সেটার উপায়ও নাই। এত দাম কিভাবে হয়? এটার পেছনে অবশ্যই সিন্ডিকেট আছে। আমি আজকে এক আঁটি লাল শাক কিনেছি ২০ টাকা দিয়ে। এটার দাম কি এমন হওয়ার কথা ছিল? এমন না যে কৃষক বেশি দামে বিক্রি করছে। তারা হয়তো ৫ টাকা করে বিক্রি করে। কিন্তু আমাদের কাছে আসতে হয়ে যায় ২০ টাকা। পরিবহন খরচ কি এতই বেশি!’
তিনি আরও বলেন, ‘বাজারের এই পরিস্থিতিতে যারা নিম্ন আয়ের মানুষ আছে তাদের ঢাকায় থাকা অসম্ভব হয়ে গিয়েছে। আমি মনে করি তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়া উচিত, তাহলে যদি একটু স্বস্তি হয়। ঢাকায় খরচ বহন করে বাস করা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। আমি নিজেই আমার সঞ্চয় ভেঙে চলতে শুরু করেছি। পরিস্থিতি যদি আরও খারাপ হয় তাহলে হয়তো আমাকেও গ্রামের বাড়ি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অথবা পরিবারকে পাঠিয়ে দিয়ে আমাকে একা এখানে থাকতে হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর থেকে হঠাৎ করেই উত্তপ্ত নিত্যপণ্যের বাজার। খুচরা পর্যায়ে পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও দামে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। অসহনীয় দাম চালের বাজারেও। গরিবের মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজি। আর সরু চাল ৯০ টাকা পর্যন্ত। অজুহাতের দেশে সবজির দিকে তাকানো এখন বড় দায়। অনেক সবজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা কেজির উপরে। মসুরের ডালের কেজিও ১৫০ টাকা।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে, নিম্ন আয়ের মানুষের ডাল, ভাত ও সবজি জোগানোও এখন স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাতে ডিম তুলতেও কষ্টের সীমা নেই। ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা। খেটে খাওয়া মানুষের সাধ থাকলেও উচ্চ মূল্যের কারণে সাধ্যের মধ্যে মাছ-মাংস কিনতে পারছেন না। উচ্চমূল্যের কশাঘাতে মধ্যবিত্তরাও পড়েছেন বেকায়দায়। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, সবজি থেকে শুরু করে মাছ-মাংস কোনো কিছুই আর আগের দামে নেই। প্রতিদিন পণ্যের দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে। বাজারে গেলেই চোখে পড়ে মানুষের অসহায়ত্ব। এক সময় যে পরিবার মাসের শুরুতেই একসঙ্গে বাজার করত, এখন তা ভাগ করে সপ্তাহে নামিয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় কম করে কিনে কোনো মতে বেঁচে থাকার লড়াটা চালিয়ে যাচ্ছেন।
নিত্যপণ্যের দাম সামলাতে গিয়ে কমছে ভোজনের তালিকাও। এছাড়া মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে এখন দাওয়াত বা মেহমানদারি যেন বিলাসিতা। কেউ বাড়িতে আসার আগেই মনে পড়ে কেনাকাটার বাজেট। তাই আগেভাগেই ‘না’ করে দিচ্ছেন অনেকেই। শুধু বাজার খরচ নয়, নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে চিকিৎসা, শিক্ষা, যাতায়াতসহ সব খাতে। সব মিলে পণ্যের দাম মেটাতে গিয়ে অন্য অনেক প্রয়োজনীয় খরচেও কাটছাঁট করতে গিয়ে নিত্যপণ্যের বাজারে চাপা পড়ছে মধ্যবিত্তের সাধ। আর চুলায় হাঁড়ি চাপাতে হিমশিম খাচ্ছেন গরিব মানুষ।
রাজধানীর নয়াবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা ভ্যানচালক মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, বাজারে এসেছি আধা ঘণ্টা হয়েছে। কিন্তু কি রেখে কি কিনব বুঝতেপারছি না। যে টাকা আছে তা চাল, ডাল কিনতেই শেষ হয়ে যাবে। পরে টাকা না থাকলে এক পদ সবজিও হয়তো কেনা কঠিন হবে। অনেক পন্যের দাম শুনেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সারা বছর একই প্রক্রিয়ায় মূল্য কারসাজি করে ক্রেতাকে ঠকাচ্ছে। তবে এর বিপরীতে সরকারের তরফ থেকে কোনো স্থায়ী পদক্ষেপ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এছাড়া ভোক্তাকে স্বস্তিতে রাখতে তদারকি সংস্থাগুলোর কোনো গবেষণা নেই। এমনকি নেই কোনো বাজার তদারকির পরিকল্পনা। ফলে বছরের পর বছর বাজারে ভোক্তা নিষ্পেষিত হচ্ছে। সরকারের উচিত হবে অন্যান্য সংস্কারের পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনায় কঠোর নজর দেওয়া।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল বলেন, বাজারে অভিযান থেমে নেই। অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্দেশে প্রতিদিন বাজারে তদারকি করা হচ্ছে। অসাধু পন্থায় দাম বাড়ালে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে পণ্যের দাম সহনীয় করা হচ্ছে। ভোক্তার স্বার্থে অধিদপ্তরের কার্যক্রম চলমান থাকবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ