রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাচারের ষড়যন্ত্র
স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর
প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৪:০২ পিএম
ছবি: ভোরের আকাশ
প্রাণ- প্রকৃতি, পরিবেশ, কৃষি, পানিসম্পদ, মানবাধিকার ও জাতীয় সম্পদ রক্ষার ঐতিহাসিক ফুলবাড়ী খনি আন্দোলনকে নিয়ে প্রেস সচিব শফিকুল আলমের বিভ্রান্তমুলক বক্তব্য প্রত্যাহারসহ ২০০৬ সালের ৩০ আগস্ট স্বাক্ষরিত দেশবিরোধী চুক্তি বাতিল করতে ফুলবাড়ী ৬ দফা চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে এবং লন্ডনে অনুষ্ঠিতব্য এশিয়া এনার্জি (জিসিএম) কোম্পানির সাধারণ সভায় নতুন ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বুধবার (১০ ডিসেম্বর) সংবাদ সম্মেলন করে তেল-গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ।
আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, দিনাজপুর ফুলবাড়ী শাখার আহবায়ক সৈয়দ সাইফুল ইসলাম জুয়েল। এ সময় তিনি বলেন, বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ফেসবুক ভেরিফাইড পেইজে ৬ ডিসেম্বর’২৫ ফুলবাড়ী খনি আন্দোলনের ইতিহাস এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাচার ও লুটপাটের সাফাই দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘ফুলবাড়ী সহ বাংলাদেশের কয়লা উত্তোলন না করাটা ছিল আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত’।
প্রেস সচিবের এই একপেশে তথ্য বিকৃতিমূলক বক্তব্য জাতির নিরাপত্তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে সৈয়দ সাইফুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ফুলবাড়ী আন্দোলন ছিল জাতীয় সম্পদ রক্ষার লড়াই, কোনো দলীয় এজেন্ডা নয়। ২০০৬ সালের ঐতিহাসিক ফুলবাড়ীর আন্দোলনকে হেয় প্রতিপন্ন করে পরিবেশ বিনাশি ‘ওপেন-পিট’ কয়লা খনির পক্ষে যে সাফাই গাওয়া হয়েছে, তা কেবল বিভ্রান্তকরই নয়, বরং বিগত দুই দশকের জ্বালানি খাতের ‘মেধাগত দেউলিয়াত্ব’ এবং ‘আমদানি নির্ভর লুটপাটতন্ত্র’ আড়াল করা একটি অপকৌশল।
প্রেস সচিব তার বক্তব্যে দাবি করেছেন, ‘দেশীয় কয়লা উত্তোলন না করার কারণেই বাংলাদেশ জ্বালানি সংকটে পড়েছে এবং ভারতীয় কয়লার ওপর নির্ভরশীল হয়েছে’। এই বক্তব্যকে অযৌক্তিক দাবি করে সংবাদ সম্মেলনে যৌক্তিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেন নেতৃবৃন্দ।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়
১. প্রেস সচিব ২ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয়ের যে গল্প শুনিয়েছেন, তা অসম্পূর্ণ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ২০০৬ সালে এশিয়া এনার্জির সাথে যে দেশবিরোধী চুক্তি বাতিল করতে জনতা জীবন দিয়েছিল, সেখানে বাংলাদেশের রয়্যালিটি ছিল মাত্র ৬ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকার কয়লা তুললে ৯৪ টাকাই চলে যেত বিদেশি কোম্পানির পকেটে। দেশের ৩ ফসলি উর্বর জমি ও পানির আধার ধ্বংস করে মাত্র ৬ শতাংশ রয়্যালিটির বিনিময়ে সম্পদ তুলে দেওয়াকে ‘অর্থনৈতিক মুক্তি’ বলা যায় না, একে বলা হয় রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাচার। আর এই কয়লা দেশে ব্যবহারও হতো না। এর ৮০ শতাংশ রপ্তানির জন্য রেললাইন তৈরির খরচও ৬ শতাংশ রয়্যালিটি থেকে বহন করতে হতো।
২. চীন বা অস্ট্রেলিয়ার জনমানবহীন মরুভূমির সাথে বাংলাদেশের নিবিড় জনবসতিপূর্ণ উর্বর জমির তুলনা করা ভৌগোলিক অন্ধত্বের শামিল। ফুলবাড়ী ও দিনাজপুর অঞ্চল দেশের অন্যতম প্রধান ‘শস্যভাণ্ডার’। এখানে ওপেন-পিট বা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের অর্থ হলো- বিশাল এলাকাজুড়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর চিরস্থায়ীভাবে ধ্বংস করা এবং উত্তরবঙ্গকে মরুভূমিতে পরিণত করা। 'জ্বালানি নিরাপত্তা'র দোহাই দিয়ে ‘খাদ্য নিরাপত্তা’ ও ‘জননিরাপত্তা’ বিসর্জন দেওয়া কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের নীতি হতে পারে না।
৩. বর্তমান জ্বালানি সংকট কয়লা না তোলার কারণে নয়, বরং স্বাধীনতা পরবর্তী স্থল ও সমুদ্রভাগে গ্যাস অনুসন্ধানে সরকারের ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তার ফল। দেশীয় গ্যাস উত্তোলনের চেয়ে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প ও এলএনজি আমদানিতে কমিশন, সুবিধা ও লুটপাট বেশি বলেই বাপেক্সকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। এটি নীতিগত দুর্নীতি।
৪. ভারতীয় কয়লা বা আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছে সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি এবং অসম চুক্তির কারণে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বিপন্ন করে ভারত চীনের কোম্পানির স্বার্থে একের পর এক কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার কারণে। নিজেদের কমিশনভোগী তৎপরতা এবং অশুভ সিন্ডিকেটের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার জন্য দেশপ্রেমিক আন্দোলনকারীদের দায়ী করা এবং শহীদদের কেবল নিহত বলে অসম্মান করা চরম ধৃষ্টতা।
সংবাদ সম্মেলনে আরো জানা যায়, এশিয়া এনার্জি (জিসিএম) কোম্পানী আগামী ১৭ ডিসেম্বর লন্ডনে বার্ষিক সাধারণ সভায় মিলিত হয়ে ফুলবাড়ী তথা দেশের খনিজ সম্পদ কয়লা উত্তোলন নিয়ে অবারও নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে যাচ্ছে। প্রেস সচিব তাদের স্বার্থ রক্ষার্থেই এই বক্তব্য রেখেছেন বলে পতিয়মান হয়েছে। দেশ বিরোধী দেশী-বিদেশী ষড়ন্ত্রকারীদের ফাঁদে পা না দিয়ে দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রতি তারা আহ্বান জানান।
ফুলবাড়ী শহরের নিমতলা মোড়ে সংগঠনের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, ফুলবাড়ী শাখার সদস্য সচিব ও সিপিবি’র উপজেলা সভাপতি জয়প্রকাশ গুপ্ত, সংগঠনের অন্যতম সদস্য ও সিপিবি ফুলবাড়ী উপজেলার সাধারণ সম্পাদক এস এম নুরুজ্জামান, সংগঠক মো. হামিদুল ইসলাম, সঞ্জিত প্রসাদ জিতু, মো. জামি, মাহামুদুজ্জামান বাবু, হিমেল মন্ডল প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলন শেষে প্রেস সচিব শফিকুল আলমের ফুলবাড়ী আন্দোলন নিয়ে বক্তব্য প্রত্যাহার এবং লন্ডনে এশিয়া এনার্জি (জিসিএম) কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) এর প্রতিবাদসহ ৬ দফা দাবিতে ১৭ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় ফুলবাড়ী নিমতলা মোড়ে প্রতিবাদ সভার কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন সংগঠনের আহবায়ক সৈয়দ সাইফুল ইসলাম জুয়েল।
ভোরের আকাশ/এসএইচ