ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৫ ০৯:৩১ এএম
ছবি-সংগৃহীত
ঈদুল ফিতরের ধারাবাহিকতায় ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করেও দেশে রেকর্ড প্রবাসী আয় এসেছে। গত মার্চে ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৩২৯ কোটি মার্কিন ডলার, যা এক মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ আয়। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে মে মাসেও এসেছে ২৯৭ কোটি ডলার। এমনকি জুন মাসের শুরুতেই এই ধারা বজায় রয়েছে। জুনের প্রথম তিন দিনে এসেছে ৬০ কোটি ৪০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ আয়। এদিকে দ্বিতীয় মাসের মতো সৌদি আরব থেকে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে। মাঝে বেশ কিছু মাস এটি যুক্তরাষ্ট্রের দখলে থাকলেও পূর্বে সৌদি আরব থেকেই বাংলাদেশে সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় আসত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২৮ দশমিক ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই আয় ছিল ২১ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে মাত্র এক অর্থবছরে ৬ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। এই প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, বর্তমানে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম-৬ হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী এ সংখ্যা ২০ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার।
উল্লেখ্য, এই হিসাব পদ্ধতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়বদ্ধ ও অলভ্যাংশ বাদ দিয়ে কেবল প্রকৃত রিজার্ভ দেখানো হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ সামনে রেখে প্রবাসীরা পরিবার-পরিজনের জন্য বেশি পরিমাণ অর্থ পাঠিয়ে থাকেন, যাতে দেশে তাদের প্রিয়জনেরা উৎসব আনন্দে অংশ নিতে পারেন। এই উৎসবকালীন প্রেরণায় প্রবাসী আয় অনেক সময় দ্বিগুণ হয়ে যায়। মে মাসে প্রবাসী বাংলাদেশিরা পাঠিয়েছেন ২৯৭ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে প্রাপ্ত মোট ২৯৭ কোটি ডলারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫৩ কোটি ৩৪ লাখ ডলার এসেছে সৌদি আরব থেকে, যা প্রায় ১৮ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে সংযুক্ত আরব আমিরাত (৩৫ কোটি ১৫ লাখ ডলার) ও তৃতীয় যুক্তরাজ্য (৩৪ কোটি ৬৮ লাখ ডলার)। এরপর রয়েছে মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ওমান, ইতালি, কুয়েত, কাতার ও সিঙ্গাপুর। অপরদিকে, মার্চে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, ৫৪ কোটি ৬১ লাখ ডলার। এরপরে ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত (৫০ কোটি ৮৩ লাখ), সৌদি আরব (৪৪ কোটি ৮৪ লাখ), যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়া।
রেমিট্যান্সের প্রকৃত উৎস নির্ধারণ :
বিগত বছরগুলোতে রেমিট্যান্সের উৎস হিসেবে একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্র, আমিরাত বা যুক্তরাজ্যকে শীর্ষে দেখা গেলেও বাস্তবে অনেক সময়ই এগুলো ছিল ‘ক্লিয়ারিং দেশের’ ভিত্তিতে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স মূলত আনুষ্ঠানিক চ্যানেল হিসেবে ব্যাংক ও এক্সচেঞ্জ হাউজের মাধ্যমে দেশে আসে। এক্সচেঞ্জ হাউজের মাধ্যমে সংগৃহীত রেমিট্যান্স স্থানীয় ব্যাংকগুলো কিনে নেয় এবং সুবিধাভোগীদের কাছে টাকা পরিশোধ করে। দেশের মোট রেমিট্যান্সের বড় অংশই আসে এই এক্সচেঞ্জ হাউজের মাধ্যমে। যেসব দেশের এক্সচেঞ্জ হাউজ নিবন্ধিত, তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সবচেয়ে এগিয়ে। ফলে প্রবাসীরা পৃথিবীর যে প্রান্ত থেকেই টাকা পাঠান না কেন, অনেক সময় সেই অর্থ ক্লিয়ার হয় ওই নিবন্ধিত দেশ থেকেই।
উদাহরণস্বরূপ, কেউ সৌদি আরব থেকে অর্থ পাঠালেও, যদি তা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক্সচেঞ্জ হাউজের মাধ্যমে পাঠানো হয়, তাহলে তা রেকর্ড হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রেরিত রেমিট্যান্স হিসেবে। এই প্রক্রিয়ার কারণে বেশ কিছু বছর ধরে রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষ দেশ হিসেবে প্রকৃত উৎস নয়, বরং এক্সচেঞ্জ হাউস- নিবন্ধনের দেশগুলোর নাম উঠে আসছে। কারণ, বেশির ভাগ ব্যাংক ক্লিয়ারিং-এর দেশকেই রেমিট্যান্সের উৎস দেশ হিসেবে দেখিয়ে রিপোর্ট করত, প্রকৃত উৎস নয়। এই ভুল রিপোর্টিংয়ের কারণে প্রায় তিন বছর ধরে শীর্ষ রেমিট্যান্স প্রেরণকারী দেশ হিসেবে অনেক সময় প্রকৃত দেশ নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের নাম প্রকাশ পেয়েছে।
এ পরিস্থিতির পরিবর্তনে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি নির্দেশনা জারি করেছে, যাতে প্রতিটি ব্যাংক প্রকৃত উৎস দেশ অনুযায়ী রেমিট্যান্স হিসাব করে রিপোর্ট প্রদান করে। এই নির্দেশনা কার্যকর হওয়ায় এখন রেমিট্যান্সের সঠিক উৎস দেশ চিহ্নিত হচ্ছে এবং তথ্য উপস্থাপনেও স্বচ্ছতা ফিরেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত প্রতিমাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২৫ সালের মার্চে, রেকর্ড পরিমাণ ৩.২৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে প্রায় ৪৮০ মিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছে। এটি ওই মাসে সর্বোচ্চ উৎস দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, প্রবাসী আয়ের এই জোয়ারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। ফলে ব্যাংকগুলো আগের মতো ডলার সংকটে নেই, আর বাজারে অস্থিরতা অনেকটাই কমেছে। আমদানি দায় পরিশোধ, এলসি খোলা কিংবা রিজার্ভ ব্যবস্থাপনাতেও এখন তুলনামূলক স্বস্তি দেখা যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতেই রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে, যা একটি ইতিবাচক মাইলফলক হবে।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান গণমাধ্যমে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ৫ শতাংশ রেমিট্যান্স কর বাংলাদেশসহ অনেক দেশের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। এ ধরনের পদক্ষেপ কার্যকর হলে আগামী দিনে প্রবাসীরা আনুষ্ঠানিক চ্যানেল এড়িয়ে অনানুষ্ঠানিক বা হুন্ডি চ্যানেলের দিকে ঝুঁকতে পারেন। এতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় চ্যালেঞ্জ বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। ব্যাংকিং সেবা সহজ ও কার্যকর করা, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার বাড়ানো এবং কম খরচে দ্রুত টাকা পাঠানোর সুযোগ তৈরি করতে হবে। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ে সক্রিয় যোগাযোগ জরুরি, যাতে তারা এই সিদ্ধান্তের সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে অবহিত থাকেন।
ভোরের আকাশ/এসএইচ