টাকার বিপরীতে দর বেড়ে চলেছে বিদেশি মুদ্রার
ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কিনে মার্কিন মুদ্রাটির (ডলার) দাম স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তথা মজুত বেড়েছে। কিন্তু বিদেশি মুদ্রার বিপরীতে টাকার দরপতন থামানো যাচ্ছে না। দেশে গত চার বছরে প্রধান বিদেশি মুদ্রার বিপরীতে টাকার এই দরপতন অব্যাহত রয়েছে।কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত ইউরোর দাম বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৭০ শতাংশ, মার্কিন ডলারের দর বেড়েছে ২৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং পাউন্ডের দর বেড়েছে ৩০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মালয়েশিয়ার রিঙ্গিত, ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ। এ সময় কানাডীয় ডলারের দাম বেড়েছে ২১ দশমিক ৪৯ শতাংশ, সিঙ্গাপুরি ডলারের ২৭ দশমিক ৩১ শতাংশ, অস্ট্রেলীয় ডলারের ২১ দশমিক ৬৮ শতাংশ, সৌদি রিয়ালের ২৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ এবং ভারতীয় রুপির ২০ শতাংশ।মুদ্রাবাজারের অস্থিরতার পটভূমি২০২২ সালের শুরুতে ডলারের আন্তঃব্যাংক বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা, যা একই বছরের ডিসেম্বরের শুরুতে দাঁড়ায় ১০৫ টাকা ৪০ পয়সা। এরপর ধাপে ধাপে দাম বাড়তে থাকে। করোনা মহামারীর পর থেকে এবং বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা তীব্র হয়। সরবরাহ বিঘ্ন ও আমদানি ব্যয়-বৃদ্ধির প্রভাবে টাকার মান দ্রুত কমতে থাকে।বাজার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক একসময় ডলারের দর বেঁধে দেয়, যা মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে বিনিময় হার নির্ধারণই বাজারের স্বাভাবিক নিয়ম।আগস্ট ২০২২: মার্কিন ডলার ক্রয় ৯৪ টাকা শূন্য ৫ পয়সা, বিক্রয় ৯৫ টাকা শূন্য ৫ পয়সা; ইউরোপীয় ইউরো ক্রয় ১০২ টাকা ৯৮ পয়সা, বিক্রয় ১১০ টাকা ৪২ পয়সা; ব্রিটেনের পাউন্ড ক্রয় ১২২ টাকা ৬৫ পয়সা, বিক্রয় ১৩০ টাকা শূন্য ৬ পয়সা; ভারতীয় রুপি ক্রয় ১ টাকা ১৫ পয়সা, বিক্রয় ১ টাকা ১৯ পয়সা; মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত ক্রয় ২০ টাকা ৯৪ পয়সা, বিক্রয় ২১ টাকা ২২ পয়সা; সিঙ্গাপুরের ডলার ক্রয় ৭২ টাকা ৮২ পয়সা, বিক্রয় ৭৮ টাকা ৯৭ পয়সা; সৌদির রিয়াল ক্রয় ২৫ টাকা, বিক্রয় ২৫ টাকা ৩১ পয়সা; কানাডিয়ান ডলার ক্রয় ৭২ টাকা ৩৯ পয়সা, বিক্রয় ৭৩ টাকা ১৪ পয়সা ও অস্ট্রেলিয়ান ডলার ক্রয় ৬৪ টাকা ৮৭ পয়সা, বিক্রয় ৬৬ টাকা ৫৭ পয়সা।আগস্ট ২০২৩: মার্কিন ডলার ক্রয় ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা, বিক্রয় ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা; ইউরোপীয় ইউরো ক্রয় ১১৭ টাকা ৪৯ পয়সা, বিক্রয় ১২৩ টাকা ১২ পয়সা; ব্রিটেনের পাউন্ড ক্রয় ১৩৬ টাকা ৯৪ পয়সা, বিক্রয় ১৪২ টাকা ২৪ পয়সা; ভারতীয় রুপি ক্রয় ১ টাকা ২৮ পয়সা, বিক্রয় ১ টাকা ৩৩ পয়সা; মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত ক্রয় ২৩ টাকা ৩০ পয়সা, বিক্রয় ২৩ টাকা ৫৬ পয়সা; সিঙ্গাপুরের ডলার ক্রয় ৮০ টাকা ১৫ পয়সা, বিক্রয় ৮৩ টাকা ৪০ পয়সা; সৌদি রিয়াল ক্রয় ২৮ টাকা ৮৭ পয়সা, বিক্রয় ২৯ টাকা ১৯ পয়সা; কানাডিয়ান ডলার ক্রয় ৭৯ টাকা ৮৪ পয়সা, বিক্রয় ৮০ টাকা ৫৫ পয়সা ও অস্ট্রেলিয়ান ডলার ক্রয় ৬৯ টাকা ৯৬ পয়সা, বিক্রয় ৭১ টাকা ৫৭ পয়সা।আগস্ট ২০২৪: মার্কিন ডলার ক্রয় ১১৭, বিক্রয় ১১৮ টাকা; ইউরোপীয় ইউরো ক্রয় ১২৭ টাকা ৭১ পয়সা, বিক্রয় ১৩০ টাকা ৫৮ পয়সা; ব্রিটেনের পাউন্ড ক্রয় ১৪৯ টাকা ২২ পয়সা, বিক্রয় ১৫২ টাকা ৫৯ পয়সা; ভারতীয় রুপি ক্রয় ১ টাকা ৩৬ পয়সা, বিক্রয় ১ টাকা ৪১ পয়সা; মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত ক্রয় ২৬ টাকা ৩৪ পয়সা, বিক্রয় ২৬ টাকা ৬২ পয়সা; সিঙ্গাপুরের ডলার ক্রয় ৮৭ টাকা ৭৭ পয়সা, বিক্রয় ৯০ টাকা ৬১ পয়সা; সৌদি রিয়াল ক্রয় ৩১ টাকা ১১ পয়সা, বিক্রয় ৩১ টাকা ৪৩ পয়সা; কানাডিয়ান ডলার ক্রয় ৮৫ টাকা ৩০ পয়সা, বিক্রয় ৮৬ টাকা শূন্য ৪ পয়সা ও অস্ট্রেলিয়ান ডলার ক্রয় ৭৭ টাকা ৫২ পয়সা, বিক্রয় ৭৯ টাকা ২০ পয়সা।আগস্ট ২০২৫: মার্কিন ডলার ক্রয় ১২১ টাকা, বিক্রয় ১২২ টাকা ৫০ পয়সা; ইউরোপীয় ইউরো ক্রয় ১৩৮ টাকা ৭২ পয়সা বিক্রয় ১৪৪ টাকা ৭৮ পয়সা; ব্রিটেনের পাউন্ড ক্রয় ১৬০ টাকা ২৯ পয়সা বিক্রয় ১৬৭ টাকা ২৬ পয়সা; ভারতীয় রুপি ক্রয় ১ টাকা ৩৮ পয়সা বিক্রয় ১ টাকা ৪০ পয়সা; মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত ক্রয় ২৮ টাকা ৫০ পয়সা বিক্রয় ২৮ টাকা ৯৩ পয়সা; সিঙ্গাপুরের ডলার ক্রয় ৯২ টাকা ৭১ পয়সা বিক্রয় ৯৬ টাকা ৭৯ পয়সা; সৌদি রিয়াল ক্রয় ৩২ টাকা ২৪ পয়সা বিক্রয় ৩২ টাকা ৬৪ পয়সা; কানাডিয়ান ডলার ক্রয় ৮৭ টাকা ৯৫ পয়সা বিক্রয় ৮৯ টাকা ০৫ পয়সা ও অস্ট্রেলিয়ান ডলার ক্রয় ৭৮ টাকা ৯৪ পয়সা বিক্রয় ৭৯ টাকা ৯৮ পয়সা।বিনিময় হার নির্ধারণে বাফেদার ভূমিকা অস্থিরতা কমাতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বাফেদা (বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন) ও এবিবি (অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ) যৌথভাবে রেমিট্যান্স, রপ্তানি ও আমদানির ক্ষেত্রে অভিন্ন বিনিময় হার ঘোষণা করে। পরে ২০২৪ সালের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করে, যেখানে ডলারের মিড রেট নির্ধারণ করা হয় ১১৭ টাকা। তবে এসব পদক্ষেপ বাজারে স্থিতিশীলতা পুরোপুরি ফেরেনি।বর্তমান পরিস্থিতি ও মন্তব্য অর্থনীতিবিদ এবং গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন, অর্থনৈতিক সংকট বা অস্থিরতার সময় কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে; তবে দাম সরাসরি বেঁধে দেওয়া বাজারের স্বাভাবিকতাকে ব্যাহত করে এবং সংকট বাড়াতে পারে।বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, বর্তমানে ব্যাংকে প্রতি ডলারের দর ১২১ দশমিক ৩৫ থেকে ১২১ দশমিক ৯০ টাকার মধ্যে রয়েছে। তিনি দাবি করেন, বাজার শিথিল করার পরও অনেকে আশঙ্কা করেছিল ডলারের দর ১৬০-১৭০ টাকা ছাড়াবে, কিন্তু তা হয়নি। এতে মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রয়েছে।বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ডলারের দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া বা পড়ে যাওয়া— দুটোই অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজন অনুযায়ী হস্তক্ষেপ করছে। এতে মুদ্রাবাজারের অস্থিতিশীলতা নেই।অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর পর শুরুতে বড় উল্লম্ফন অস্বাভাবিক বিষয় নয়। তবে অন্য সব কিছু ঠিক থাকলে দীর্ঘমেয়াদে ডলারের বাজারে স্থিতাবস্থা আনতে এটি সহায়ক হবে। যদিও এটি নিশ্চিত করতে হলে হুন্ডি কিংবা ডলারের এ ধরনের বাজারবহির্ভূত যে লেনদেন সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’ভোরের আকাশ/এসএইচ