আন্দোলন চাপে সরকার
ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে নানামুখী আন্দোলন নিয়ে চাপে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকারের বিরুদ্ধে সচিবালয়ে প্রশাসনিক কাজ বন্ধ রেখে টানা আন্দোলন করছেন সরকারি চাকরিজীবীরা। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষকদের কর্মবিরতি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে অপসারণের সময় বেঁধে দিয়েছে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’। দাবি আদায়ে দুই দিনব্যাপী কলমবিরতি কর্মসূচি শুরু করতে যাচ্ছে প্রশাসন ক্যাডার বাদে সিভিল সার্ভিসের ২৫টি ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন আন্ত ক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। বিদ্যুৎ সেবা চালু রেখে সাত দফা দাবিতে সারা দেশে কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পবিস) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন তার সমর্থকরা। অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার বিচার, উপাচার্য-প্রক্টরের পদত্যাগ ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবি জানিয়েছেন ঢাবি শাখা ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। এতোসব আন্দোলনের মধ্যে দৃশ্যত চাপে রয়েছে বর্তমান সরকার।‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ প্রত্যাহারের দাবিতে আবারও বিক্ষোভ মিছিল করার ঘোষণা দিয়েছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মচারীরা। একই সঙ্গে একই ধরনের কর্মসূচি পালনের জন্য সচিবালয়ের বাইরে সারা দেশের সরকারি দপ্তরের কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।গতকাল সোমবার কর্মসূচি শেষে এ ঘোষণা দিয়েছেন ‘বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরাম’। এখন থেকে সচিবালয়ে কর্মরত কর্মচারীদের সবগুলো সংগঠন মিলে এ সংগঠনের ব্যানারে পরবর্তী কর্মসূচি পালন করবে। ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের একাংশের সভাপতি মো. বাদিউল কবীর বলেন, কর্মসূচি ততক্ষণ পর্যন্ত চলমান থাকবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত এই ‘কালো’ আইন বা অধ্যাদেশ বাতিল সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার না করা হবে। এই আইন বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে চলমান কর্মসূচি সমাপ্ত হবে।তিনি আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টায় সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে মিছিল নিয়ে সচিবালয় চত্বরের বাদামতলায় সমবেত হওয়ার আহ্বান জানান। ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের আরেকাংশের সভাপতি মুহা. নূরুল ইসলাম বলেন, সারা দেশের কর্মচারীরা তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষকদের কর্মবিরতি। পৃথক আন্দোলনে যোগ দিয়ে শিক্ষকরা অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মস্থল ত্যাগ করে বেতন বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন।তিন দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গতকাল সোমবার থেকে দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা পূর্ণদিবস কর্মবিরতিতে গিয়েছেন। এর অর্থ, তারা নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকলেও কোনো শ্রেণি কার্যক্রম বা পরীক্ষা গ্রহণে অংশ নিচ্ছেন না।শিক্ষকরা জানিয়েছেন, তাদের দাবি মানা না হলে এই কর্মসূচি অনির্দিষ্টকালের জন্য চলবে। এ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে ‘প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদ’, যেখানে দেশের ছয়টি সহকারী শিক্ষক সংগঠন একত্রিত হয়েছে। সংগঠনটির নেতারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই তারা বেতন বৈষম্য ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অসংগতি নিয়ে আন্দোলন করে আসছেন, কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। শিক্ষকদের প্রধান তিন দফা দাবি হলো- সহকারী শিক্ষক পদকে অ্যান্ট্রি পদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ১১তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ। ১০ এবং ১৬ বছর পূর্ণ হওয়ার পর উচ্চতর গ্রেডে যাওয়ার জটিলতা নিরসন। প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ পদোন্নতি এবং দ্রুত পদোন্নতির সুযোগ নিশ্চিত করা।জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে দুই বিভাগে ভাগ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত করার ঘোষণার পর এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিবাদের মুখে রোববার সরকার সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। পরে ধর্মঘট স্থগিত হয়। তবে আগামী বৃহস্পতিবারের (২৯ মে) মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে অপসারণের সময় বেঁধে দিয়েছে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’।গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে পরিষদ নেতারা এ ঘোষণা দিয়েছেন। তারা বলেছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের প্রতি কর্মীদের ‘বিশ্বাস ও আস্থার চরম সংকট’ তৈরি হয়েছে। সুতরাং আগামী ২৯ মের মধ্যে তাকে অপসারণ করতে হবে।দাবি আদায়ে আজ মঙ্গলবার দুই দিনব্যাপী কলমবিরতি কর্মসূচি শুরু করতে যাচ্ছে প্রশাসন ক্যাডার বাদে সিভিল সার্ভিসের ২৫টি ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন আন্ত ক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলার প্রতিবাদে এবং ‘কৃত্য পেশাভিত্তিক’ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, উপসচিব পদে পদোন্নতিতে কোটা বাতিল ও সব ক্যাডারের মধ্যে সমতা আনার দাবিতে এ কর্মসূচি পালিত হবে।আজ মঙ্গলবার ও আগামীকাল বুধবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সারা দেশে সিভিল সার্ভিসের ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা এ কর্মসূচি পালন করবেন। গতকাল সোমবার আন্ত ক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।বিদ্যুৎ সেবা চালু রেখে সাত দফা দাবিতে আজ মঙ্গলবার থেকে সারা দেশে কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পবিস) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচির ষষ্ঠ দিন গতকাল সোমবার সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন পল্লী বিদ্যুৎ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি প্রকৌশলী তাজুল ইসলাম।অভিন্ন চাকরিবিধি বাস্তবায়ন, হয়রানি বন্ধ, মামলা প্রত্যাহারসহ সাত দফা দাবিতে সারা দেশের ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গত ২১ মে থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনির্দিষ্টকালের অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন তার সমর্থকরা। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দাবি পূরণ না হলে আরও কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন তারা।এছাড়া, ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়াতে স্থানীয় সরকার সচিবকে একটি আইনি নোটিশও দেওয়া হয়েছে। ইশরাক সমর্থকদের বিক্ষোভের ১৩তম দিনে গতকাল সোমবার বিকেলে নগরভবনের ভেতরের গেটে অবস্থান কর্মসূচির সময় ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন আন্দোলনরত ‘ঢাকাবাসী’র প্রধান সমন্বয়ক সাবেক সচিব মশিউর রহমান। এর আগে, সকাল ১০টা থেকে ইশরাকের সমর্থক ও সিটি করপোরেশন শ্রমিক ইউনিয়নের বিপুল সংখ্যক কর্মী নগরভবনে বিক্ষোভ করেন। এতে সিটি করপোরেশনের সব ধরনের সরকারি পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার বিচার, উপাচার্য-প্রক্টরের পদত্যাগ ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবি জানিয়েছেন ঢাবি শাখা ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এই দাবিতে তাঁরা ঢাবি উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে ‘অবস্থান কর্মসূচি’ পালন করেছেন।গতকাল সোমবার দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বর থেকে ঢাবি শাখা ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন।বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে তারা উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন।কর্মসূচিতে গণেশ চন্দ্র রায় সাহস বলেন, ১৩ দিন হয়ে গেল, শাহরিয়ার হত্যার ঘটনার কোনো সুরাহা হলো না। গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখ সারির যোদ্ধা ছিলেন শাহরিয়ার। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত ঢাবির এই প্রশাসন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ প্রশাসনের ৯ মাসে ক্যাম্পাসে তোফাজ্জল হত্যা, ফ্যাসিস্টের মোটিফ পোড়ানো, গাছে লাশ ঝোলাসহ অনেক ঘটনা দেখেছেন তারা। কিন্তু অপরাধীদের ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারেনি প্রশাসন। তারা এই প্রশাসনের পদত্যাগের পাশাপাশি যারা শাহরিয়ার হত্যাকাণ্ড নিয়ে ভিন্ন ন্যারেটিভ দাঁড় করাচ্ছেন, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান।গত বছর আগস্টে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত যাওয়ার পর ৮৪ বছর বয়সী নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস ১৭ কোটি ৩০ লাখ মানুষের দেশের অন্তর্বর্তী প্রধানের দায়িত্ব নেন। সেই থেকে সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, রাজনৈতিক দল এবং সামরিক বাহিনীর চাপের মুখে পড়েছে তার প্রশাসন।গত রোববার সরকার এক অধ্যাদেশ জারি করে প্রশাসন মন্ত্রণালয়কে দীর্ঘ প্রক্রিয়া ছাড়াই অসদাচরণের অভিযোগে সরকারি কর্মচারী বরখাস্তের ক্ষমতা দিলে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনকারীরা একে ‘দমনমূলক’ আখ্যা দিয়ে এর প্রত্যাহার দাবি করছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও ঘনীভূত হয় যখন ছাত্রনেতৃত্বাধীন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) এক শীর্ষ নেতা দাবি করেন, রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার ও নির্বাচনকালীন সময়সূচি নিয়ে একমত হতে না পারলে ইউনূস পদত্যাগ করতে পারেন।তবে পরিকল্পনাবিষয়ক উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, আমরা আমাদের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোথাও যাচ্ছি না।তিনি জানান, ইউনূস বাধা স্বীকার করলেও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বর্তমান সরকার একদিকে যেমন দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে চাপে রয়েছে, অন্যদিকে রয়েছে কাক্সিক্ষত সংস্কারেরও চাপ।ইউনূস জানিয়েছেন, নির্বাচন ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে হতে পারে। তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যেই ভোটের দাবি জানিয়ে আসছে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গত সপ্তাহে এক ভাষণে ডিসেম্বরেই নির্বাচন দাবি করে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন, যা সরকারের ওপর চাপ আরও বাড়িয়ে দেয়। এই পরিস্থিতিতে শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে হঠাৎ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক ডাকেন ইউনূস এবং বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টির সঙ্গে বৈঠক করেন।পরের দিন আরও বেশ কয়েকটি দলের নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন।প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, আমরা এখন যুদ্ধাবস্থার মধ্যে রয়েছি। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর আমাদের অস্থিতিশীল করতে বিভিন্ন চেষ্টার ইঙ্গিত মিলছে। এখান থেকে আমাদের বের হতে হবে। এই মাসেই শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে। ফলে দলটি আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না।ভোরের আকাশ/এসএইচ