আশরাফুল ইসলাম সুমন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১২:২৪ পিএম
ছবি: ভোরের আকাশ
বেশ পরিপাটি একটা বাড়ি। আভিজাত্যের ছাপ শত বছর আগের কাচারি বা বাংলো ঘর। গাছ-গাছালিতে ছায়া ঘেরা। বাড়িতে ঢোকার পথে পুকুরটা যেন সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বাড়ির ভেতরে প্রায় ৭০ বছরের পুরোনো একাধিক ভবনের পাশাপাশি আছে পাঠাগার ভবন ও মসজিদ আছে।
ফাঁকা বাড়ি, তবে কাউকে জিজ্ঞেস করে জানার প্রয়োজন নেই এ বাড়িটি কার। বাড়ির গুণী পূর্বপুরুষদের কথা তুলে ধরা হয়েছে পাথরে খোদাই করে; এই বায়োগ্রাফি যেন বাড়ির সমৃদ্ধ ইতিহাসকে সামনে নিয়ে এসেছে। বাড়িটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার বড়াইল ইউনিয়নের জালশুকা গ্রামে।
জেলা সদর থেকে জালশুকা যেতে মোটরসাইকেলে প্রায় আধাঘন্টার পথ। গ্রামের ভিতরে ঢুকতে পিচঢালা পথ যেন সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেলে করে এ এলাকার মানুষ যাতায়াত করে জেলা কিংবা উপজেলা সদরে।
এলাকার মানুষ বাড়িটিকে চেনেন "জালশুকা মোল্লাবাড়ি" হিসেবে। বাড়ির সামনে পুরোনো টিনশেড কাচারি ঘরের সামনে একটি ডাকবাক্স। ১৯৫৬ সালে লম্বা কাচারি ঘরের একটি কক্ষে প্রতিষ্ঠিত হয় ডাকঘর, যা অত্র অঞ্চলের মানুষের জন্য ছিল স্বপ্নসমান বিষয়। এ বাড়ির পূর্বপুরুষ আব্দুর রউফের হাত ধরেই ডাকঘরটি নির্মিত হয়।
বাড়ির ভেতরে স্থাপন করা পাঠাগারটি আধুনিকভাবে নির্মিত। এটি ২০১২ সালে রেজিস্ট্রেশনও করা হয়। পাঠাগারের নিচতলার পুরোটাই বই রাখার সেলফ। এর পাশের একটি কক্ষে ডাকঘরের কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপরতলায় রয়েছে থাকার ব্যবস্থা।
দূরদূরান্ত থেকে প্রকৃতিপ্রেমী কিংবা বইপ্রেমীরা এখানে এলে নিজেদের মতো করে থাকতে পারবেন বলে জানিয়েছেন মোল্লাবাড়ির সদস্যরা। ১৯৫৫ ও ১৯৫৬ সালে নির্মিত দালান ঘর যেন আভিজাত্যের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির কীর্তিমান পূর্বপুরুষদেরকে ভিন্নভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। খোদাই করা পাথরে লেখা তাদের কথা। ওই লেখায় তুলে আনা হয়েছে আনসার আলী মোক্তার, তার ছেলে আব্দুর রউফ আর আব্দুর রউফের ছেলে আব্দুর রহিম ও আব্দুর রহমানের বর্ণাঢ্য জীবনচিত্র।
পাথরে লেখা আছে— আব্দুর রউফ, ইপিইএস। ডাক নাম নওয়াব মিয়া। জালশুকা গ্রামের সম্ভ্রান্ত মোল্লাবাড়ির আনসার আলী মোক্তারের এই সন্তানের জন্ম ১৯০৮ সালে। আব্দুর রউফ ১৯২৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন শেষে পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা বিভাগে কর্মজীবন শুরু করেন।
তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন ইউনিভার্সিটি থেকেও উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন অঙ্গরাজ্যের গভর্নর তাঁকে “ওরেগন অ্যাম্বাসেডর টু পাকিস্তান” হিসেবে বিরল সম্মাননা দেন।
ষাটের দশকে অবসর নিয়ে আব্দুর রউফ অবসরোত্তর জীবন কাটাতে চলে আসেন নিজ জন্মভিটায়, নিভৃত জালশুকা গ্রামে। কর্মজীবন বা অবসর— সবসময়ই গ্রামের মানুষের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তিনি। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে জালশুকা গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং বড়াইল ও গোসাইপুরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখে অনগ্রসর এ অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছেন শিক্ষার আলো। দুর্গম গ্রামে যোগাযোগ সহজ করতে ১৯৫৬ সালে নিজ বাড়িতে ‘ডাকঘর’ চালু করেন।
আনসার আলী মোক্তারের অন্য সন্তানদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হুদা ওরফে লাল মিয়া মুন্সি ও আব্দুল হাই জিল্লু মিয়া। লাল মিয়া ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলে দীর্ঘ ৩৫ বছর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ও জিল্লু মিয়া পুলিশের ডিএসপি হিসেবে ব্যুরো অব অ্যান্টি-করাপশনে কর্মরত ছিলেন।
আবদুর রহিম ওরফে হুমায়ূন: তিনি ‘হুমায়ূন চেয়ারম্যান’ নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। আব্দুর রউফের বড় ছেলে হুমায়ূন তদানীন্তন সাদেকপুর পশ্চিম বর্তমানে বড়াইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত একটানা দায়িত্ব পালন করেন। অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠ ও সততার জন্য এলাকার মানুষের কাছে সমুজ্জ্বল তাঁর নাম। মুক্তিযুদ্ধকালীন নিজ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় হুমায়ূন চেয়ারম্যানের অবদান অসামান্য।
আবদুর রহিম স্বাধীনতা উত্তরকালে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত হন। ঢাকায় ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়। এছাড়া ‘দৈনিক কিষান’ এবং ‘দৈনিক বাংলার মুখ’ সংবাদপত্রে কাজ করেন। ১৯৮৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কুমিল্লার ‘দৈনিক রূপসী বাংলা’র সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
আবদুর রহমান: আবদুর রহমান ওরফে আবু মিয়া হলেন আব্দুর রউফের চার সন্তানের মধ্যে তৃতীয় ও সুযোগ্য উত্তরসূরি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছিলেন তিনি। আবদুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে ১৯৬৪ সালে বিএ অনার্স এবং ১৯৬৫ সালে এমএ পাস করে কর্মজীবনের শুরুতে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হন। কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব হাজী আসমত আলী কলেজ ও পরবর্তীতে ঢাকার আবু জর গিফারী কলেজে অধ্যাপনা করেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ে চাকরিকালীন সময়ে পাবলিক রিলেশন বিষয়ে ১৯৮২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ফেলোশিপ এবং ইউনেস্কোর পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতে ‘ফ্যামিলি প্ল্যানিং কমিউনিকেশন’ শীর্ষক কোর্সে অংশ নেন।
মোল্লাবাড়ির বংশধর হাফিজুর রহমান বলেন, ‘গ্রাম থেকে শহরে চলে গেলে কেউ আর গ্রামের বাড়িটির সেভাবে খোঁজ নেয় না। কিন্তু মোল্লাবাড়ির ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে ব্যতিক্রম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাড়ির গুণী মানুষদের জীবনচিত্র তুলে ধরা, যা পাঠাগারে ঢোকার মুখেই চোখে পড়বে।’
ওই এলাকার বাসিন্দা মো. মোশারফ হোসেন বলেন, ‘জালশুকা গ্রামের মোল্লাবাড়ির আলাদা একটা ঐতিহ্য আছে। এ বাড়িতে কেউ না থাকলেও গ্রামের মানুষ বাড়ির সামনে যে ঐতিহ্যবাহী ডাকঘর আছে সেখানে বসে আড্ডা দেয়। বাড়ির ঐতিহ্য ধরে রাখতে একটি সুন্দর পাঠাছবি: ভোরের আকাশগার তৈরির বিষয়টি বেশ আশাজাগানিয়া। এছাড়া বাড়ির পূর্বপুরুষদেরকে যেভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, এটি ব্যতিক্রম।’
জালশুকা মোল্লাবাড়ির সন্তান, অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য পরিদর্শক মো. মিজানুর রহমান জানান, আমাদের পূর্বপুরুষরা আমাদের জন্য গৌরবের। বাড়ির যে সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য রয়েছে— তা এই পাথর সবসময় বহন করবে। এটি নতুন প্রজন্মের কাছে ভালো বার্তা দেবে। গ্রামের ছেলেরা অন্য দিকে না গিয়ে পাঠাগারটিতে পড়াশোনার সুযোগ পাবে।
বর্তমানে সদর উপজেলার চিলেকূট গ্রামের বাসিন্দা জালশুকা খাঁবাড়ির হাফেজ ছানাউল্লাহ খাঁন বলেন, ‘মোল্লাবাড়িতে এক-দু’বছর নয়, ৮০ বছর এই বাড়িতে জামাল উদ্দিন হুজুর নামে একজন আল্লাহর ওলি ছিলেন। যিনি “চিটাগাংয়ের হুজুর” নামেই সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। ডাইরেক্টর সাহেবেরও নাম আছে। তিনি আমেরিকা থেকে সততার পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার ছেলে হুমায়ূন চেয়ারম্যান থাকাকালীন সবকিছু মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন। নিজের জন্য কিছুই রাখেননি। তার ছোট ভাই সরকারি বড় কর্মকর্তা আবদুর রহমানও সৎ মানুষ ছিলেন। তাদের মতো মানুষ বর্তমানে বিরল।’
বড়াইল কাজীবাড়ির কাজী আবু হানিফ জানান, আমাদের পূর্বপুরুষ থেকেই এ বাড়ির নামডাক। অনেক গুণী মানুষ রয়েছেন এ বাড়িতে; যারা নিঃস্বার্থভাবে এলাকার মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন।’
সত্যিই যেন গ্রামের মানুষের জন্য উৎসর্গকৃত গুণীজনদের এ জন্মভিটা— ‘জালশুকা মোল্লাবাড়ি’!
ভোরের আকাশ/তা.কা