ডেঙ্গুর ভয়াবহতার শঙ্কা

ডেঙ্গুর ভয়াবহতার শঙ্কা

নিখিল মানখিন

প্রকাশ : ১ ঘন্টা আগে

আপডেট : ৫৮ মিনিট আগে

ডেঙ্গুর ভয়াবহতার শঙ্কা

ডেঙ্গুর ভয়াবহতার শঙ্কা

চলতি বছর দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, স্থবির হয়ে পড়েছে মশক নিধন কার্যক্রম। উঁকি দিচ্ছে ডেঙ্গুর পিক মৌসুম। ডেঙ্গু মোকাবিলার প্রাক প্রস্তুতি চোখে পড়ছে না। বৃষ্টি হলেই সৃষ্টি হবে জলাবদ্ধতা। বাড়বে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজনন। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। তবে এবার মশক নিধন ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থার্ড পার্টি থেকে সরিয়ে সেনাবাহিনীকে দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ।

ডেঙ্গুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর হলো ডেঙ্গুর পিক মৌসুম। তবে জুন থেকেই ডেঙ্গুরোগী ও মৃত্যুর হার বাড়তে থাকে। ডেঙ্গুরোগের বাহক এডিস মশার বংশবিস্তারের তিন স্তর হলো- লার্ভা, বাড়ন্ত ও উড়ন্ত। লার্ভা ধ্বংসে সফলতা দেখাতে পারছেন না দায়িত্বপ্রাপ্তরা। সীমিত সংখ্যক বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করে লার্ভা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। ডেঙ্গু মোকাবিলায় বাড়াতে হবে জনসম্পৃক্ততা।

গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গুবিষয়ক এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ডেঙ্গুতে গত ২৪ ঘণ্টায় কারও মৃত্যু হয়নি এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৩৮ জন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে দুই হাজার ৩৮৭ জন। এর মধ্যে ৬১ দশমিক চার শতাংশ পুরুষ এবং ৩৮ দশমিক ছয় শতাংশ নারী রয়েছেন। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ১৮ জন মারা গেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ২০২৪ সালে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু জ্বর ৫৭৫ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়। বছরের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয় ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন। তাদের মধ্যে ছাড়া পেয়েছে ১ লাখ ৪০ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত বছরের জানুয়ারিতে ১৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৫ জন, মার্চে ৬ জন, এপ্রিলে ২ জন, মে মাসে ১২ জন, জুনে ৮ জন, জুলাইয়ে ১৪ জন, আগস্টে ৩০ জন, সেপ্টেম্বরে ৮৭ জন, অক্টোবরে ১৩৫ জন, নভেম্বরে ১৭৩ জন এবং ডিসেম্বরে ৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

মশার অত্যাচারে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী : বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন রাজধানীর বাসিন্দারা। অবস্থা এমন যে, শুধু রাতে নয় দিনেও কয়েল জ্বালিয়ে বা মশারির মধ্যে থাকতে হচ্ছে নগরবাসীকে। মশা নিধনে দুই সিটি করপোরেশনের চলমান কার্যক্রম কোনো কাজে আসছে না বলে অভিযোগ নগরবাসীর। ফলে দিন দিন মশা বাড়ছে বলে দাবি তাদের। নগরবাসীর শঙ্কা, বর্ষা শুরুর আগেই মশা নিধনে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নিলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব পুনরায় বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

রাজধানীর মগবাজার এলাকার দিলুরোডের বাসিন্দা জয়নাল মিয়া বলেন, ছয়তলায় একটি ফ্লাটে স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকি। মশার উৎপাত এতই বেশি যে সন্ধ্যার পর ছেলে-মেয়েকে মশারির মধ্যে রাখতে হয়। মশার যন্ত্রণায় বাসায় কোথাও একটানা বসে থাকা যায় না। মশার কামড়ে স্বাভাবিক কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু মশা মারতে করপোরেশনের লোকজন স্প্রে করে গেলেও তা কোনো কাজে দিচ্ছে না।

নগরীর পূর্ব রাজাবাজার এলাকার বাসিন্দা ইয়াসমিন আক্তার জানান, দিনেও ঘরের মধ্যে মশার যন্ত্রণায় থাকা যায় না। কয়েল জ্বালালেও মশা যায় না। সন্ধ্যার পর তো এই অবস্থা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। মনে হয় যেন মশা উড়িয়ে নিয়ে যাবে। ২৪ ঘণ্টা ঘরে কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হয়। বাচ্চাদের তো মশারির মধ্যেই রাখতে হয়।

রাজধানীর ফার্মগেটের তেজকুনিপাড়ার বাসিন্দা ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘বর্ষা মৌসুম শুরু হয়ে গেছে, আর বৃষ্টিতে এডিস মশা বৃদ্ধি পায়। তাতে ডেঙ্গুর প্রকোপও বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে। সাধারণত বর্ষার সময়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি। এ সময়কে ডেঙ্গুর মৌসুম বলা হয়। তবে সিটি করপোরেশন যে ওষুধ ছিটাচ্ছে, তা মশা মারতে কতটা কার্যকর পরীক্ষা করে দেখা দরকার।’ শুধু এই কয়েকটা এলাকা নয়, পুরো রাজধানীজুড়ে চলছে মশার উৎপাত।

কার্যকর মশক নিধন ও জনসচেতনতার বিকল্প নেই : বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আমাদের মশা মারার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু মশা মারার সঠিক পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা এখনো গ্রহণ করা হয়নি।

বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি পদ্ধতি প্রয়োগ করে ধাপে ধাপে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ এখনই হাসপাতালগুলোতে রোগী বাড়ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে সামনে বিপদ। তাই রোগী যাতে আর না বাড়ে সে জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। মশার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এটার সমাধান সম্ভব না। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর অন্য রোগব্যাধিতেও আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। যে কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. মো. গোলাম সারোয়ার ভোরের আকাশকে বলেন, শত্রুর সঙ্গে তো আপনি ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে লড়াই করতে পারবেন না। আবার এই লড়াইয়ের জন্য আপনার পর্যাপ্ত সামরিক জ্ঞান থাকতে হবে। তা না হলে আপনার গুলি শত্রুর গায়ে না লেগে নিজের গায়েও লাগতে পারে। আমরা তো শত্রু চিনি। এডিস মশা। কিন্তু দেশে মশা মারার সঠিক ব্যবস্থাপনা তো নেই। ওষুধের প্রয়োগ, সঠিক সময় ও প্রশিক্ষিত জনবল- এই তিনটি ব্যবস্থা বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি ব্যবস্থাপনায় থাকতে হবে। কিন্তু আমরা কী সেটা করতে পারছি? ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিটনাশক ছিটানো ছাড়া তো সংঘবদ্ধভাবে কোনো কাজ নেই। কীটততত্ত্ববিদ দিয়ে দল গঠন করে এডিস মশার প্রজননস্থল খোঁজা হচ্ছে না, মশার লার্ভা ধ্বংস করা হচ্ছে না। ফলে ডেঙ্গুও নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের মানসম্মত ব্যবস্থাপনার (স্ট্যান্ডার্ড ম্যানেজমেন্ট) মধ্য দিয়ে সেবা দিতে হবে। ডেঙ্গু চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় গাইডলাইন প্রণয়ন করা হয়েছে। গাইডলাইন মেনে সেবা দিলে মৃত্যুহার কমে আসবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত ও ভর্তির তথ্যর মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকে। রোগীর সংখ্যা ঠিক না থাকায় ব্যবস্থাপনায় মুশকিল হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, দেশে ডেঙ্গুজ্বরে মৃত রোগীর হার অনেক বেশি। মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা করলে সমস্যাগুলো শনাক্ত করা যাবে এবং সমাধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া যাবে। হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গুর ক্রস ট্রান্সমিশন হচ্ছে। হাসপাতালে রোগী দেখতে এসে অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, দেশের হাসপাতালগুলোতে শয্যার তুলনায় কয়েক গুণ বেশি রোগী ভর্তি থাকে। জনবল কম থাকায় পরিচ্ছন্ন রাখা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরেও আমরা ডেঙ্গু ওয়ার্ডের রোগীদের মশারির ভিতরে রাখার চেষ্টা করি। হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে সিটি করপোরেশন সহযোগিতা করলে সমন্বিতভাবে কাজ করা সম্ভব। এভাবে ক্রসট্রান্সমিশনের ঝুঁকি কমানো যাবে।

ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, ক্রসট্রান্সমিশন ঠেকাতে আমরা হাসপাতালগুলোতে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নিচ্ছি। ডিএনসিসির উদ্যোগে প্রতিটি ওয়ার্ডে বিনামূল্যে ডেঙ্গু টেস্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মশক নিধনে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এম এইচ চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ কমার কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। মশা মারা হচ্ছে না, ডেঙ্গুর ভাইরাস নিয়ে গবেষণা হচ্ছে না এবং মশা মারার জন্য পরিকল্পনাও নেই। অবশ্য এ পরিস্থিতির জন্য জলবায়ু পরিবর্তনও অনেকাংশে দায়ী। তার আশঙ্কা, কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় ডিসেম্বরেও ভোগাতে পারে ডেঙ্গুর প্রকোপ।

মশক নিধন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে সেনাবাহিনী : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেছেন, ‘বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের পরিবর্তন হয় কিন্তু মাঠপর্যায়ের তেমন কোনো কর্মী পরিবর্তন হয় না। আমরা প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করে থাকি তবে থার্ড পার্টিরা মূলত ব্যবসা করার জন্য আসে। তাই মশক নিধন ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থার্ড পার্টি থেকে সরিয়ে সেনাবাহিনীকে দেওয়া হচ্ছে।’

গত মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরে ডিএনসিসি নগর ভবনের হল রুমে ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি ও করণীয়’ শীর্ষক সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। 

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন খাল পরিষ্কার ও মশক নিধনের জন্য মাঠপর্যায়ের কর্মীদের মাসে জনপ্রতি বিল দেওয়া হয় ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা। কিন্তু এই কর্মীরা আসলে হাতে পান ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা। প্রায় ১০ হাজার টাকা নাই। এক হাজার লোকের ১০ হাজার টাকা নাই মানে কোটি টাকার বাণিজ্য। আমরা মাঠপর্যায়ের কর্মীদের সরাসরি বিল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

ভোরের আকাশ/এসএইচ

  • শেয়ার করুন-

সংশ্লিষ্ট

ডেঙ্গুর ভয়াবহতার শঙ্কা

ডেঙ্গুর ভয়াবহতার শঙ্কা

ডেঙ্গুতে আরও ২ জনের মৃত্যু

ডেঙ্গুতে আরও ২ জনের মৃত্যু

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ২৯ জন

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ২৯ জন

সব হাসপাতালে হচ্ছে সরকারি ফার্মেসি, স্বল্প দামে মিলবে ওষুধ

সব হাসপাতালে হচ্ছে সরকারি ফার্মেসি, স্বল্প দামে মিলবে ওষুধ

মন্তব্য করুন