মো. রেজাউর রহিম
প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৫ এএম
ফাইল ছবি
যেকোনো অবস্থায় দেশের কৃষি জমি রক্ষায় বদ্ধপরিকর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কৃষি জমির সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা, প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, অপরিকল্পিত নগরায়ন বন্ধ এবং যত্রতত্র ইচ্ছেমতো স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে একটি খুব শিগগির একটি কঠোর কৃষিজমি রক্ষায় অধ্যাদেশ জারি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে। দেশের কৃষিজমি রক্ষার বিষয়ে অধ্যাদেশ জারির কাজ সম্পন্ন সম্ভব হলে বিপুল জনগোষ্ঠীর এই দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ মোকাবিলা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, আবাসন ও উন্নয়নমূলক নানা কর্মকাণ্ডের কারণে কৃষিজমি প্রতিনিয়ত কমার প্রবণতা রোধে কার্যকর হবে বলে মনে করছে সরকার।
এদিকে, কৃষিজমি সুরক্ষায় একটি আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন আগে শুরু হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। কৃষিজমি রক্ষায় বিষয়ে আইনকে স্থায়ী রূপ দিতে অবশেষে এ অধ্যাদেশ জারি করা হচ্ছে। এছাড়া কৃষিজমি রক্ষায় একটি সুরক্ষা ‘কর্তৃপক্ষ’ও গঠন করবে সরকার।
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভূমি উপদেষ্টা, পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা এবং কৃষি উপদেষ্টার সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটির তত্ত্বাবধানে এ সম্পর্কিত অধ্যাদেশের খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ‘ভূমি ব্যবহার ও কৃষিভূমি সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’র এ খসড়া তৈরি করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। খসড়ায় কৃষিজমি সুরক্ষার ওপর বাড়তি জোর দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, দেশের স্বার্থে এবং ভবিষ্যতের দিকে খেয়াল রেখে কৃষিজমি রক্ষাকল্পে এ অধ্যাদেশে যুক্ত করা হচ্ছে কঠিন বিধি-বিধান। কৃষিজমিতে অকৃষিমূলক কোন স্থাপনা করা যাবে না এবং কৃষি জমির সদব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ অধ্যাদেশ করছে সরকার। এ অধ্যাদেশ না মানলে ভূমি মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হচ্ছে। আইন লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড ও এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান থাকছে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভোরের আকাশকে জানান, বাংলাদেশ বিশে^র অন্যতম জনসংখ্যাবহুল দেশ। কিন্তু ভূমির পরিমাণ বেশ কম। এজন্য কৃষিজমি রক্ষাকল্পে সরকার যুগোপোযোগী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে অধ্যাদেশ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, এ সম্পর্কিত কাজ চলমান রয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, খসড়া অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশ ভূমি জোনিং ও ভূমি সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ’ গঠন করা হবে। এ কর্তৃপক্ষ কৃষিজমির ৮০ শতাংশ কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করবে।
এছাড়া প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে দেশের সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকাকে ভূমির বিদ্যমান ব্যবহার, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, ভূমিরূপ যথাযথভাবে পরীক্ষা করে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ধারণ করা প্রতিচ্ছবি, সরেজমিন পরিদর্শন ও বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন অঞ্চলকে ব্যবহারভিত্তিক বিভাজন বা ভূমি জোনিং করার বিষয়টিও রাখা হচ্ছে।
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, শিগগির সব পক্ষের মতামত ও অন্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে খসড়াটি অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পাঠানো হবে। উপদেশটা পরিষদের অনুমোদনের পর অধ্যাদেশ জারি করা হবে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আমাদের দেশে মানুষের পরিমাণ বেশি হলেও ভূমির পরিমাণ বেশ কম হওয়ায়া কৃষিজমি রক্ষায় বাড়তি জোর দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরো জানান, ভূমি উপদেষ্টা, পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা এবং কৃষি উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, খসড়াটি এক দফা উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদ এ বিষয়ে আরো কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে তা ফেরত পাঠায় এবং কৃষিজমি সুরক্ষার বিষয়টিকে নিশ্চিত করার বিষয়ে জোর দেওয়ার নির্দেশনা দেন।
সূত্র জানায়, খসড়ার প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্টেক-হোল্ডারদের মতামত নেওয়া হয়েছে। এরপর একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে খসড়াটি চূড়ান্ত করার শিগগির উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।
জানা গেছে, খসড়া অধ্যাদেশে কোনো ব্যক্তি ভূমির উপরিভাগের ক্ষতিকর পরিবর্তন রোধে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা না মানলে ও কৃষিজমি বাদে অন্য শ্রেণির ভূমির ক্ষতিকর পরিবর্তন রোধে নির্দেশনা না মানলে শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে অধ্যাদেশে আর কৃষিজমিতে বসতবাড়ি নির্মাণ ছাড়া অকৃষি কাজে ব্যবহার করলেও শাস্তি পেতে হবে। কর্তৃপক্ষ জমিতে অননুমোদিতভাবে নির্মাণ করা স্থাপনা অপসারণ করে বাজেয়াপ্ত করে নিলামে বিক্রিও করতে পারবে- এমন ব্যবস্থাও থাকছে। এসব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। একই অপরাধ আবার করলে শাস্তি বেড়ে দ্বিগুণ হবে। এ ক্ষেত্রে শাস্তি দুই বছরের কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড।
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, কোনো রিয়েল এস্টেট কোম্পানি বা কোনো হাউজিং সোসাইটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কৃষিজমিতে অননুমোদিতভাবে হাউজিং এস্টেট তৈরি করলে বা হাউজিং এস্টেট তৈরির উদ্দেশ্যে অধিক পরিমাণ কৃষিজমি দখল করলে শাস্তির মুখে পড়তে হবে। এছাড়া ইট ভাটা নির্মাণ, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা কোম্পানি বা শিল্প মালিক, ব্যবসায়ী, ব্যাংক, বীমা কোম্পানি, পুঁজিপতি বা কোনো এনজিও বা কোনো ক্লাব কৃষিকাজ ছাড়া বাণিজ্যিক বা বিনোদন কেন্দ্র, রিসোর্ট বা অন্য কাজে ব্যবহারের জন্য অননুমোদিতভাবে নির্ধারিত পরিমাণের বেশি কৃষিজমি দখল করে রাখলে এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা সোসাইটি বা এনজিও বা ক্লাব বা কোম্পানির ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকেই সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধ আবার করলে শাস্তি তা বেড়ে দ্বিগুণ হবে। এক্ষেত্রে দুই বছরের কারাদণ্ড ও এক কোটি টাকা জরিমানার বিধানও রাখা হচ্ছে।
এছাড়া খসড়ায় আদালত উপযুক্ত মনে করলে অপরাধের উপকরণ ও আলামত জব্দ এবং বাজেয়াপ্ত করে নিলামে বিক্রির ব্যবস্থা করতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। খসড়ায় আরো বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশ ভূমি জোনিং ও ভূমি সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ’ নামে একটি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। একজন চেয়ারম্যান ও চারজন সদস্য নিয়ে কর্তৃপক্ষ গঠিত হবে। চেয়ারম্যান হবেন অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। আর কমপক্ষে যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদার দুজন কর্মকর্তা সদস্য হিসেবে নিয়োগ করা হবে।
অন্যদিকে কর্তৃপক্ষ গঠন না হওয়া পর্যন্ত ভূমি সংস্কার বোর্ড কর্তৃপক্ষের সব ক্ষমতা প্রয়োগ এবং দায়িত্ব পালন করবে। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সহকারী কমিশনাররা (ভূমি) নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন বলেও খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষ কৃষিজমি সুরক্ষা ও জোনভিত্তিক ভূমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিতে সারাদেশে একই সঙ্গে বা পর্যায়ক্রমে একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার বা মৌজার ভূমির বিদ্যমান ব্যবহার, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও ভূমিরূপ যথাযথভাবে পরীক্ষা করে মৌজা, দাগ বা অন্য কোনো চিহ্ন বা সীমারেখা দিয়ে সারাদেশে ‘ভূমি ব্যবহার জোনিং ম্যাপ’ ও স্থানিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, ডাটাবেজ সংরক্ষণ ও নিয়মিত হালনাগাদ করবে।
দেশের কৃষিজমি পরিমাপ করে মোট কৃষিজমির কমপক্ষে ৮০ শতাংশ কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ। আর ভূমি জোনিংয়ের উদ্দেশ্যে ভূমিকে ১৪টি শ্রেণিতে ভাগ করা যাবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। এ শ্রেণিগুলো হচ্ছে-কৃষি অঞ্চল, কৃষি-মৎস্য চাষ অঞ্চল, নদী ও খাল, জলাশয়, পরিবহন ও যোগাযোগ অঞ্চল, শহুরে আবাসিক অঞ্চল, গ্রামীণ বসতি অঞ্চল, মিশ্র ব্যবহার অঞ্চল, বাণিজ্যিক অঞ্চল, শিল্প অঞ্চল, প্রাতিষ্ঠানিক ও নাগরিক সুবিধা অঞ্চল, বন ও বৃক্ষরোপণ অঞ্চল, সাংস্কৃতিক-ঐতিহ্য অঞ্চল এবং পাহাড় টিলা।
কৃষিজমি সুরক্ষায় পদক্ষেপ : খসড়ায় বলা হয়েছে, এ আইনের অধীনে সব কৃষিভূমি সুরক্ষা করতে হবে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কৃষিভূমি ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না বা শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না বা এমনভাবে ব্যবহার করা যাবে না যাতে কৃষিভূমির শ্রেণি পরিবর্তন হয়ে যায়। তবে অকৃষি বা অন্য কোনো শ্রেণির ভূমি কৃষিকাজের উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না। এছাড়া কোনো ভূমিতে জ্বালানি বা খনিজসম্পদ বা প্রত্নসম্পদ পাওয়া গেলে বা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সরকার ওই ভূমি থেকে সম্পদ আহরণ বা অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে এ আইনের বিধানাবলি কোনো বাধা হবে না।
অন্যদিকে, দুই বা এর বেশি ফসলি কৃষিভূমি কোনো অবস্থায়ই কৃষি ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। এক ফসলি ভূমিকেও কৃষিভূমি হিসেবেই ব্যবহার করতে হবে। তবে রাষ্ট্রীয় গুরুত্ব, জনস্বার্থ বিবেচনায় ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পরিমাণ এক ফসলি কৃষিভূমি সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্প, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানা স্থাপন বা কৃষি সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক কার্যক্রম বা অন্য কোনো বিশেষ প্রয়োজনে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া যাবে।
এছাড়া ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পরিমাণ জমির অতিরিক্ত জমি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কোন স্থাপনা নির্মাণে ব্যবহার করতে পারবেন না। আর জমির ব্যবহারভিত্তিক সর্বোচ্চ সীমা বিধি দিয়ে নির্ধারণ করা যাবে। বন, জলাভূমি, নদী, পাহাড় ও টিলা শ্রেণি এবং সাগর ও উপকূলীয় অঞ্চলের ভূমি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
অন্যদিকে, দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং ভূমি জোনিং ম্যাপ অনুযায়ী ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার দেশের কোনো অঞ্চল বা এলাকাকে ‘বিশেষ কৃষি অঞ্চল’ হিসেবে সংরক্ষণ করতে পারবে। কোনো ভূমিতে জ্বালানি বা খনিজসম্পদ বা প্রত্নসম্পদ পাওয়া গেলে বা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সরকার ওই ভূমি থেকে সম্পদ আহরণ বা অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে এ আইনের বিধানাবলি কোনো বাধা হবে না বলে অধ্যাদেশে উল্লেখ থাকছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ