মো. রেজাউর রহিম
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৯:২৮ এএম
ফাইল ছবি
দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে এবং কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে কৃষকদের কাছে সারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে চায় সরকার। এজন্য সারের চাহিদা ও সরবরাহের ক্ষেত্রে সব সিন্ডিকেট ভেঙে দেবে সরকার। কৃষকদের চাহিদামাফিক সারের প্রাপ্রতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন এবং কৃষিকে আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও লাভজনক করতে সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া সারের মূল্য নিয়ে যাতে কেউ কোন কারসাজি করতে না পারে সেজন্য সরকারি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। অধ্যাপক ড. মুহাম্দ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ের সব সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার কাজ অনেকাংশে সম্পন্ন হয়েছে বলে কৃষি মন্ত্রণলয়সহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে। আর শিগগির সার নিয়ে একটি নীতিমালা অনুমোদনও দিচ্ছে সরকার।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার কৃষিকে আরও টেকসই ও রপ্তানিমুখী করতে চায়। এজন্য নিরাপদ পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন, কৃষি-প্রযুক্তি উদ্ভাবন, জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল কৃষি ব্যবস্থা এবং কৃষকের আয় বৃদ্ধি করার বিষয়কে অত্যন্ত প্রাধান্য দিয়েছে। এজন্য উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে সারের সরবরাহ ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার বিষয়কে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালযের উপদেষ্টা অব. লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে সার নিয়ে সিন্ডিকেট করা চলবে না। আমি যতদিন আছি সারের দাম বাড়বে না।
সার সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ের রেখে যাওয়া সারের বকেয়া পরিশোধ করে চাহিদামত সার আমদানি করে কৃষকদের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে। এজন্য দেশে সারের কোন ঘাটতি গত এক বছরে হয়নি। আগামী মৌসুমেও যাতে ঘাটতি না হয় সেজন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। উপদেষ্টা বলেন, বৈশ্বিক মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এখন থেকে দেশে সার আমদানি করা হবে, যাতে সার নিয়ে কোনও কারসাজি কেউ না করতে পারে।
কৃষি উপদেষ্টা বলেন, ইতোমধ্যে সার নিয়ে একটি নীতিমালা করা হয়েছে। যা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য শিগগির জাতীয় কমিটিতে যাবে। জাতীয় কমিটির প্রধান শিল্প উপদেষ্টা। তিনি বাইরে আছেন, আগামী সপ্তাহে আমরা মিটিং করে অনুমোদন দিয়ে দেবো।
নীতিমালায় সারের ডিলারের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সারের দাম বাড়ানো হয়নি, তবে সার পাচার হয়। এজন্য সারের পাচার রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রথম লটে ৫ লাখ ৫৫ হাজার টন সার আমদানিতে কৃষি মন্ত্রণালয় সাশ্রয় করেছে ১ কোটি ৯০ লাখ ৫৫ হাজার ডলার। ওই সময়ের বিদ্যমান বিনিময় হারে টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ২৩৩ কোটি ৬১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। কার্যাদেশ প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের আমদানিতব্য সারের প্রস্তাবিত দেশভিত্তিক দর এর সঙ্গে দাপ্তরিক প্রাক্কলিত ও কার্যাদেশ প্রদত্ত দর এর মধ্যে উভয় দরের পার্থক্য যাচাই করে এই পার্থক্য নির্ধারণ করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ৩ লাখ ৩৫ হাজার টন ডিএপি সার আমদানিতে সাশ্রয় হয়েছে ১ কোটি ৩৫ লাখ ৫ হাজার ডলার। আলাদা আলাদা লটে ১০টি প্রতিষ্ঠান এসব সার আমদানি করবে।
এর মধ্যে দুটি লটে ৮০ হাজার টন আমদানি করবে বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লি.। এছাড়া নোয়াপাড়া ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ২০ হাজার টন, মৌনতা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ২০ হাজার টন, দেশ ট্রেডিং করপোরেশন ৪০ হাজার টন, মোশারফ এন্ড ব্রাদার্স ৪০ হাজার টন, মেসার্স সুফলা ট্রেডিং কর্পো. ২৫৫ হাজার টন, সাইফুল্লাহ গালফ ৩০ হাজার টন, নোয়াপাড়া ট্রেডিং ৪০ হাজার টন, এনআরকে হোল্ডিং ৪০ হাজার টন।
সূত্র জানায়, অন্যদিকে ৯০ হাজার টন এমওপি সার আমদানিতে সাশ্রয় হয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। এর মধ্যে ৬০ হাজার টন আনবে বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লি.। আর ৩০ হাজার টন আনবে দেশ ট্রেডিং করপোরেশন। এছাড়া ৯০ হাজার টন টিএসপি আমদানিতে সাশ্রয় হয়েছে ৫ লাখ ২৮ হাজার ডলার।
এর মধ্যে ৬০ হাজার টন সার আমদানি করবে বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লি. এবং ৩০ হাজার টন আমদানি করবে দেশ ট্রেডিং করপোরেশন। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সর্বনিম্ন দরদাতাদের মধ্যেও গুটিকয়েক কোম্পানি সার আমদানির সুযোগ পাচ্ছে।
জানা গেছে, কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন এবং কৃষিতে আধুনিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি কৃষিকে লাভজনক খাতে রূপান্তর করার বিষয়কে বর্তমান সরকার অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছে।
এদিকে, গত বৃহস্পতিবার কৃষি মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গত এক বছরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অগ্রগতির বিষয় তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে জানানো হয়েছে, সরকার কৃষির উন্নয়নে নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে এবং তার ধারাবহিকতা চলমান থাকবে। দেশে ধান, গম, ভুট্টা, ডাল, তেলবীজ ও শাক-সবজির উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলমূল উৎপাদনেও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।
গত বোরো মৌসুমে দেশে ১৫ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছে, যা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। সভায় জানানো হয়, বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মোকাবিলা এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশের কৃষি জমি সংরক্ষণে কঠোর বিধান রেখে ভূমি ব্যবহার ও কৃষি ভূমি সুরক্ষা অধ্যাদেশ প্রণয়ণেরও কাজ চলছে। কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সরকার বাজার মনিটরিং ও বিভিন্ন নীতি সহায়তা প্রদান করেছে এবং সারের পাশাপাশি কৃষিঋণ বিতরণ, সেচ ও সার সহায়তা অব্যাহত রেখেছে।
সভায় বলা হয়, গত এক বছরে ৮৮ লাখ ৫৫ হাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে সার, বীজ ও চারা এবং অন্যান্য সহায়তা বাবদ ৮৯৩ কোটি ২০ লাখ টাকা প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।
সভায় আরো জানানো হয়, সারের বকেয়া ২০,৬৯১ (বিশ হাজার ছয়শত একানব্বই) কোটি টাকাসহ মোট ২৭,৬৮৪.৯৭ (সাতাশ হাজার ছয়শত চুরাশি দশমিক সাতানব্বই) কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এছাড়া রাশিয়া থেকে বিনামূল্যে ৩০ হাজার মে. টন সার প্রাপ্তির কার্যক্রমও সম্পন্ন হয়েছে এবং পাটকলের অব্যবহৃত গুদামগুলোকে সার মজুদের জন্য ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ