মাজহারুল ইসলাম
প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২৫ ০৮:৫৬ এএম
ফাইল ছবি
আগামী জাতীয় নির্বাচন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার, জুলাই ঘোষণাপত্রসহ কয়েকটি বিষয়ে অন্য দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির মতবিরোধের মধ্যেই পুরান ঢাকার ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দলটিকে রাজনৈতিকভাবে বেশ বেকায়দায় ফেলেছে। এ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ইতোমধ্যে জামায়াতে ইসলামী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ইসলামী আন্দোলনের ছাত্র ও যুব সংগঠন রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে।
তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বিভিন্ন দল ও সংগঠন। মোট কথা সবাই মিলে বিএনপির বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছে। বিষয়টি বিএনপিকে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। দলটির হাইকমান্ডও উদ্বিগ্ন। আগামী নির্বাচনে এসব ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা নেতাদের। এ অবস্থায় উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীদের লাগাম টানতে দলের তৃণমূল থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে শুদ্ধি অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দলের চেইন অব কমান্ড ঠিক রাখতে অচিরেই জেলা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত শুদ্ধি অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অচিরেই এটা শুরু হবে।
৭ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েও লাগাম টানা যায়নি : এত বহিষ্কার, অব্যাহতি, পদাবনতি ও কমিটি বাতিল করার মতো কঠোর ব্যবস্থা নিয়েও কেন নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বিএনপি-এমন প্রশ্নও সামনে এসেছে। শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে দলটির শীর্ষ নেতারা হিমশিম খাচ্ছেন। বিএনপির হাইকমান্ড মনে করছেন, দেশ একটি পরিবর্তনকালীন সময় পার করছে। সেখানে বড় দল এবং বৃহৎ কর্মী-সমর্থক গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা কিছুটা দুরূহ। দল ক্ষমতায় থাকলে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নেওয়া যেত। সে সুযোগ এখন নেই। ফলে সাংগঠনিক ব্যবস্থার ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে।
দুষ্কৃতকারীদের অপরাধের দায় দল নেবে না বিএনপির শীর্ষ নেতারা বারবার এ কথা বলে আসছেন। এরপরও একশ্রেণির নেতাকর্মীর বেপরোয়া কর্মকাণ্ড দলটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। যার কারণে লাল চাঁদ হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপিকে লক্ষ্য করে ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও নিন্দা-প্রতিবাদ বাড়ছে।
এর আগে ৩ জুলাই আসামি ছিনিয়ে নিতে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থানায় হামলা চালান বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। হামলায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) পুলিশের আটজন আহত হয়েছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। সর্বশেষ গতকাল রোববার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই শিক্ষকের ওপর হামলা করেছে ছাত্রদল নেতাকর্মীরা। এ ঘটনার পর ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রদলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-মিছিল ও সমাবেশ করেছে। তারা জড়িতদেও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, হয়তো অনেক অপরাধী, সন্ত্রাসী নানা ছিদ্রপথে সংগঠনে ঢুকে যেতে পারে। কিন্তু তাদের দুষ্কর্মের দায় তো বিএনপি নেবে না। বরং এ ব্যাপারে দল খড়গহস্ত। এ পর্যন্ত জেলা, মহানগর, থানা এবং কেন্দ্র মিলে প্রায় সাত হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিএনপি শাস্তিমূলক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে। অপরাধ যে-ই করবে, তাকে চরম শাস্তি দিতে দল বদ্ধপরিকর।
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, লাল চাঁদ হত্যাকাণ্ডের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। মূল দল বিএনপিসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে শুদ্ধি অভিযান চালানোর কথাও বলা হয়েছে। যেসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অতীতে খারাপ কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আছে বা যাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা রয়েছে, তাদের ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে।
তবে বিএনপির নেতাদের কারও কারও অভিমত হচ্ছে, যেসব এলাকায় দলের ভালো নেতৃত্ব নেই, বিশেষ করে আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে অস্পষ্টতা আছে, সেসব এলাকায় নেতাকর্মীরা বেশি বেপরোয়া। কারণ, ওই সব এলাকায় মনোনয়নপ্রত্যাশী একাধিক নেতার মধ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে।
একশ্রেণির নেতাকর্মী বেপরোয়া হয়ে ওঠার বিষয়ে বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যন্ত দলের বড় একটি অংশ রাতারাতি অর্থ উপার্জনে অস্থির হয়ে পড়েছেন। বিগত আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলের সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট থেকে অনেকে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। তাই যার যেখানে প্রভাব আছে, সে সেখানে অবৈধ অর্থের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এ জন্য এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, দখল, চাঁদাবাজি, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে এসব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
বিএনপির দপ্তর থেকে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর এ পর্যন্ত সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এমন নেতাকর্মীর মধ্যে বিএনপির ১ হাজার ৮০০ জন। তাদের মধ্যে ৮০০ জনকে বহিষ্কার, ৫০ জনের পদ স্থগিত, অন্তত ৭০০ জনকে কারণ দর্শানো নোটিশ, ১০০ জনকে সতর্ক এবং ১৫০ জনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
ছাত্রদল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ জনকে বহিষ্কার ও ছয় শতাধিক নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক দলের অন্তত ১০০ নেতাকর্মী বহিষ্কার ও ১৫০ জন কারণ দর্শানো নোটিশ পেয়েছেন। যুবদলেরও শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বিএনপি তো দায় এড়াচ্ছে না; বরং দায়িত্ব পালন করছে। অভিযোগ পাওয়ামাত্র বহিষ্কার করছে, প্রশাসনকে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করছে। এরপরও বিভিন্ন মহল এটা নিয়ে হীন রাজনীতির চেষ্টা করছে। তা না হলে তারেক রহমান জবাব দাও, মিছিল থেকে এই স্লোগান কেন। তারেক রহমান কি রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন? বিএনপি যদি অপরাধীদের রক্ষা করার চেষ্টা করত, সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নিত, তাহলে দোষ দিতে পারত।’
প্রশাসন নিষ্ক্রিয়
রাজনীতির পাশাপাশি দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিই খারাপ বলে মনে করছে বিএনপি। বিশেষ করে মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় সামাজিক শৃঙ্খলাও ভেঙে গেছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে মবের পক্ষে কথা বলায় তা আরও উৎসাহিত হয়েছে। সাধারণ মানুষের জন্য একটা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অকার্যকর মনে হচ্ছে।
একাধিক নেতা দাবি করেন, ঘটনার পরপরই নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশকে অনুরোধ করা হলেও তেমন সাড়া মেলেনি। গত মঙ্গলবার পাবনার সুজানগরে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় দলের পক্ষ থেকে ১০ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সংশ্লিষ্ট থানায় ফোন করে দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু তাতে সাড়া দেয়নি থানা পুলিশ। পরে গত শুক্রবার দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলিম বাদী হয়ে বিএনপির ১০ নেতাকর্মীর নামে সুজানগর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করা হয়নি।
সোহাগ হত্যার ঘটনায় গত শনিবার নয়াপল্টন কার্যালয়ে বিএনপির তিন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সেখানে অভিযোগ করা হয়েছে, সরকার পরিকল্পনামাফিক প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় করে রেখে দেশে অরাজক পরিস্থিতি বিদ্যমান রাখতে চাচ্ছে। সব আসামিকে গ্রেপ্তার না করা এবং মামলার এজাহার থেকে মূল তিন আসামিকে বাদ দেওয়ার দাবি করে তারা একে রহস্যজনক বলে প্রশ্ন তুলেছেন।
যুবদলের সভাপতি মোনায়েম মুন্না বলেন, এই ঘটনায় যারা সরাসরি সংশ্লিষ্ট ভিডিও ফুটেজ ও সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে যাদের দেখা গেছে আর্শ্চযজনক তাদের মামলার প্রধান আসামি করা হয়নি। যারা প্রাণঘাতী আঘাতগুলো করেছে তারা অদ্যাবধি গ্রেপ্তারও হয়নি।
পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী লাল চাঁদ হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেছেন, জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনে পতিত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর এই নির্মম ঘটনাটি (লাল চাঁদ হত্যাকাণ্ড) দেশের মানুষের বিবেককে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি সমাজকে আরও গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত করবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ