কৌশলী বিএনপি-জামায়াত

নির্বাচন ও রাষ্ট্র সংস্কার

কৌশলী বিএনপি-জামায়াত

এম. সাইফুল ইসলাম

প্রকাশ : ৫ ঘন্টা আগে

আপডেট : ১১ মিনিট আগে

কৌশলী বিএনপি-জামায়াত

কৌশলী বিএনপি-জামায়াত

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারকে তাড়াতে একসঙ্গে মাঠে থাকলেও শেখ হাসিনা বিদায়ের পর দুই দলের নেতাদের মধ্যে শুরু হয় কাঁদা ছোড়াছুড়ি। তবে সম্প্রতি লন্ডনে দল দুটির শীর্ষ চার নেতার বৈঠকের পর পাল্টে গেছে মাঠের চিত্র। রাজনীতির মাঠে নানা বক্তব্য থাকলেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন ও রাষ্ট্র সংস্কার প্রশ্নে কৌশলী বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। 

মাঠ পর্যায়ে দুই দলের চলমান বিভেদ কমে এসেছে। বৈঠকের পর থেকে বিএনপি ও জামায়াত নেতারা একই সুরে কথা বলছেন। বিএনপির শীর্ষ নেতারা দ্রুত নির্বাচন আদায় প্রশ্নে হাইলার্ডনে বা মাঠ গরম করা বক্তব্য দেওয়া থেকে সরে এসেছেন। ধৈর্য্যরে সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলার পথেই হাঁটছে দলটি। যদিও নির্বাচন আদায়ে জনমত তৈরিতে দলটি সমমনাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকও করছে বিএনপি।

অপরদিকে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক নীতি বজায় রেখে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে জামায়াতে ইসলামী। নির্বাচন ইস্যুতে দল দুটির নেতারা এখন বিএনপির কাছাকাছি বক্তব্যও দিচ্ছেন। বিএনপি ডিসেম্বরে ভোট চাইছে। আর আগামী রমজানের আগেই জাতীয় নির্বাচনের দাবি তুলে বিএনপির দাবির কাছাকাছি সময়ে চলে এসেছে জামায়াত। কূটনীতিক পর্যায়েও দল দুটি নির্বাচন আদায়ে কাজ করছে।

বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতারা বলছেন- রাষ্ট্রের সংস্কার দরকার। তবে, সংস্কারের জন্য লম্বা সময় নিলে দেশে যে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে সেটি আরো বাড়তে পারে। যার সুযোগ নিতে পারে পতিত আওয়ামী লীগ। ফ্যাসিস্ট দলটির প্রত্যাবর্তন নিয়ে দুই দলই একমত। গণঅভ্যূত্থানে স্পিরিট বজায় রেখে পতিত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যেও জোর দিচ্ছেন তারা। মৌলিক সংস্কার কাজ দ্রুত শেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন চাইছেন তারা। ঐক্য ধরে না রাখতে না পারলে ফের স্বৈরাচার মাথাচাড়া দেওয়ার পাশাপাশি দেশে ফের ভারতীয় আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি বলেও মনে করছেন তারা।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস দৈনিক ভোরের আকাশকে এ বিষয়ে বলেছেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যারাই মাঠে ছিল তাদেরকে নিয়ে বিএনপি ঐক্য চাইছে। জোটবদ্ধ না থাকলেও কিন্তু আমরা অনেক দল মিলে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন করেছি। এখনো আমরা ঐক্য চাইছি। জামায়াতের ইস্যুতেও আমাদের একই অবস্থান। যা আমি জামায়াতের অনুষ্ঠানে গিয়েও বলেছি।

জামায়াতের ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, দীর্ঘদিন থেকেই আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি। আগামীতেও দেশ ও জাতির স্বার্থে বিএনপি ও জামায়াত এক থাকবে ইনশাআল্লাহ।

তিনি বলেন, মাঠের কথাবার্তা যাই হোক না কেন দুই দলের মৌলিক চাওয়া এক।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধভাবে আন্দোলন করেছে বিএনপি ও জামায়াত। মাঝে মধ্যে টানাপড়েন সৃষ্টি হলেও তাতে বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়েনি দল দুটির সম্পর্ক বা জাতীয় কোনো ইস্যুতে অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে। এবারো চুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর কয়েকটি বিষয় নিয়ে দল দুটিতে টানাপড়নের সৃষ্টি হয়।

টানাপড়েন সৃষ্টি হওয়া ইস্যুর মধ্যে নির্বাচনের সময় প্রশ্ন, আগে সংস্কার নাকি নির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যু এবং জুলাই ঘোষণাপত্র ছিল উল্লেখযোগ্য। এসব ইস্যুতে খোদ বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত দ্বিধাবিভক্ত বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দল দুটির নেতাকর্মীদের বাকযুদ্ধ এখন স্বাভাবিক ব্যাপারে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়া শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে স্থানীয়ভাবে প্রভাব সৃষ্টি করা থেকে শুরু করে নানা ইস্যুতে দেশের বিভিন্ন স্থানে দল দুটির নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এসব সংঘর্ষে নিহতের ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকটি। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠনে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ নিয়েও দল দুটির মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। কেন্দ্র থেকে শুরু করে সর্বত্র যার প্রভাব পড়ে। দীর্ঘদিন ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে থাকা বিএনপি ও জামায়াতের এই দ্বন্দ্ব দেশের সচেতন মানুষকে ভাবিয়ে তোলে।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নোবেল জয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই নির্বাচনের সময় প্রশ্নে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়ে স্পষ্ট বিভাজনের সূত্রপাত হয়।

উদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যেই যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের যার তথ্য গত ১৩ এপ্রিল প্রকাশিত হয়। লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের বাসায় তাদের এ বৈঠক হয়। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে এ বৈঠকের কথা স্বীকার না করলেও বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক প্রেস সচিব মারুক কামাল খান সোহেল তার ফেসবুকে এ বিষয়ে একটি পোস্ট করেছিলেন। পরে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান দেশে ফিরে এ বৈঠকের কথা স্বীকার করেন।

তিনি বলেন, অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসনকে তিনি দেখতে গিয়েছিলেন। সেখানে নানা বিষয়ে কথা হয়েছে। ওই বৈঠক নিয়ে রাজনীতির মাঠে নানা বক্তব্য থাকলেও শেষ পর্যন্ত দল দুটির নেতারা ফের একই সুরে কথা বলতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা ও সময় প্রশ্নে বিএনপি নেতারা কিছুদিন আগেও যে হার্ড লাইনে কথা বলতেন সেখান থেকে কিছুটা হলেও তারা সরে এসছেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রায়ই বলতেন, প্রয়োজনে ডিসেম্বরে ভোটের দাবিতে রাজপথে নামবে বিএনপি। কিন্তু হঠাৎ করেই বিএনপি নেতারা ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করছেন।

গত ১৯ এপ্রিল বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে ১২ দলীয় জোটের বৈঠক শেষে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। কারণ, এই সরকারকে তো আমরাই সমর্থন দিয়ে বসিয়েছি। অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজন করবে আমরা সেই আশাই করছি।

এছাড়া গত কয়েকদিনে বিএনপি নেতাদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা গেছে, তাদের বক্তব্যও বেশ কৌশলী বক্তব্য দিচ্ছেন। তাদের বক্তব্যে কিছুটা নমনীয় ভাব লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া জামায়াতকে উদ্দেশে করে বিভিন্ন সময়ে বিএনপি নেতারা নানা বক্তব্য এখন আর সেটি দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচন নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিবাদে জড়ালে ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে এমন বিষয়ও মাথায় রয়েছে বিএনপির। বেশ ধৈর্য্যরে সঙ্গে নিজেদের দাবির পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করছেন বিএনপি নেতারা। প্রতিদিন সমমনা কোনো না কোনো দলের সঙ্গে বৈঠক করছেন বিএনপি নেতারা। এছাড়া কূটনীতির মাঠে কাজ করছে বিএনপি। দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে যে দ্রুত সংসদ নির্বাচন দরকার সেটি তারা সর্বমহলে বোঝানোর কাজে ব্যস্ত। এছাড়া বিএনপির মূল দলের পাশাপাশি অঙ্গসংগঠন পুনর্গঠন নিয়েও ব্যস্ত রয়েছে।

এদিকে, জামায়াত নেতারা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে আগে সংস্কার পরে নির্বাচন বলে জোরেসোরে বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন। নির্বাচন ও সংস্কার প্রশ্নে দলটির নেতার সরাসরি বিএনপির সঙ্গে বিবাদেও জড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু লন্ডনে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে সঙ্গে বৈঠকের পর অবস্থান পরিবর্তন করেছে জামায়াতে ইসলামী।

দলটির আমির ওই বৈঠকের মাত্র কয়েকদিন পর গত সপ্তাহে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, নির্বাচন বেশি দেরি করা ঠিক হবে না। আগামী রমজানের আগেই ভোট চাইছে দলটি। বিএনপির দাবির কাছাকাছি সময়ে তিনিও ভোট চান। এছাড়া ভোট প্রশ্নে জামায়াত এই মূহূর্ত কারো সঙ্গে অনৈক্য সৃষ্টি করতে চায় না। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রেখেই কাজ করতে মাঠ পর্যায়ে বার্তা রয়েছে জামায়াতের।

বিষয়টি নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেছেন, বিএনপি ও জামায়াতে অনৈক্য সৃষ্টি হলে ফ্যাসিবাদিরা সুযোগ নিতে পারে। তাই আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকার উপরে জোর দিচ্ছি।

তিনি বলেন, আগে যাই হোক, এখন তেমন কোনো মনোমানিল্য এখন আর দেখছি না। দুই দলই চাইছে ঐক্য। 

তিনি আরো বলেন, ঐক্য না থাকলে এখানে আবারো ফ্যাসিবাদ ও ভারতীয় আধিপত্য নতুন করে বিস্তার লাভ করতে পারে।

এ বিষয়ে জামায়াতের ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, দীর্ঘদিন থেকেই আমরা ঐক্যবব্ধ আছি। আগামীতেও দেশ ও জাতির স্বার্থে বিএনপি জামায়াত এক থাকবে ইনশাল্লাহ। মাঠের কথাবার্তা যাই হোক না কেন দুই দলের মৌলিক চাওয়া এক।

জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে আন্দোলন করে জামায়াত। পরে ক্ষমতায় এসে জামায়াতকে নিধনে নামে আওয়ামী লীগ। পরে ফের আওয়ামী লীগ ঠেকাতে ১৯৯৯ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট হয়। ২০০১ সালে জোটবদ্ধ নির্বাচন করে সরকার গঠন করে দল দুটি। সম্পর্কে উত্থান-পতন হলেও জোট ভাঙেনি।

২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ আন্দোলন করে বিএনপি ও জামায়াত। ২০১৮ সালের নির্বাচনে নিবন্ধন হারানো জামায়াতের নেতারা বিএনপির প্রতীকে প্রার্থী হন। ২০২২ সালে দুই দল আনুষ্ঠানিকভাবে জোট ভেঙে দিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে নামে। প্রথম দিকে জামায়াত যুগপৎ আন্দোলনে থাকলেও মাঝে কিছু সময় নানা অভিযোগ এন জামায়াত সেখান থেকে সরে দাঁড়ায়। পরবর্তীতে ফের ২০২৪ এর নির্বাচনে আগে ও পরে বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে একই ধরনের কর্মসূচি পালন করে জামায়াত।

গত জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার গণহত্যা চালায়। বিএনপি ও জামায়াতকে আন্দোলনের জন্য দায়ী করে ঢালাও মামলা এবং গ্রেপ্তার করে। গত বছর ২৬ জুলাই জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয় বিএনপি। ওই আন্দোলনে দল দুটি সর্বোচ্চভাবে মাঠে ছিল।

ভোরের আকাশ/এসএইচ

  • শেয়ার করুন-

সংশ্লিষ্ট

চার বছর নয়, সংসদ-রাষ্ট্রপতির মেয়াদ ৫ বছরই চায় জামায়াত

চার বছর নয়, সংসদ-রাষ্ট্রপতির মেয়াদ ৫ বছরই চায় জামায়াত

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বসেছে জামায়াত

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বসেছে জামায়াত

তারেক রহমানের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে

তারেক রহমানের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে

কৌশলী বিএনপি-জামায়াত

কৌশলী বিএনপি-জামায়াত

মন্তব্য করুন