মাজাহারুল ইসলাম
প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ১২:১০ এএম
ছবি- সংগৃহীত
বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। তার শারীরিক অবস্থার ৭২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণ শেষ হয়েছে গতকাল সন্ধ্যায়। তাকে চিকিৎসা সহায়তা দিতে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে এসেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. রিচার্ড বিলি। দেশের একদল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস হাসপাতালের চিকিৎসক এবং লন্ডন ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের অধীন খালেদা জিয়ার চিকিৎসা চলছে। চীনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দলেরও ঢাকায় আসার কথা।
চিকিৎসকদের মতে, তিনি খুব খারাপ কিংবা খুব ভালো আছেন-বলা যাবে না। তবে কেউ ডাকলে সাড়া দিচ্ছেন। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসায় কিছুটা অগ্রগতির কথাও জানান চিকিৎসকরা। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) খালেদা জিয়ার চিকিৎসা চলছে এবং তার অবস্থা এখনো সংকটজনক। তবে তিনি চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন বলেও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় যুক্তরাজ্য থেকে আসা চার সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ মেডিকেল টিম গতকাল দুপুরে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে পৌঁছায় এবং পৌঁছানোর পরই চিকিৎসা কার্যক্রমে অংশ নেয়। এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ড. রিচার্ড বিল।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসক দলটি প্রথমেই সিসিইউতে গিয়ে খালেদা জিয়ার বর্তমান শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। পরে তারা স্থানীয় মেডিকেল টিমের সঙ্গে চিকিৎসা পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা শুরু করে।
সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) খালেদা জিয়ার চিকিৎসা চলছে এবং তার অবস্থা এখনো সংকটজনক। তবে তিনি চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন বলেও নিশ্চিত করা হয়েছে।
জানা যায়, বিদেশি বিশেষজ্ঞ টিম দীর্ঘমেয়াদি রোগ ব্যবস্থাপনা, ঝুঁকির বর্তমান মাত্রা, অর্গান সাপোর্ট এবং পরবর্তী করণীয় বিষয়ে উন্নত চিকিৎসা পরিকল্পনা প্রণয়নে কাজ করবে। তারা স্থানীয় মেডিকেল টিমের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ এবং বর্তমান চিকিৎসা অগ্রগতির মূল্যায়ন করবেন। প্রথম দিনের কাজের অংশ হিসেবে বিশেষজ্ঞ দলটি খালেদা জিয়ার বিভিন্ন জটিলতার ক্লিনিক্যাল নোট, সর্বশেষ টেস্ট রিপোর্ট এবং ব্যবহৃত সাপোর্ট সিস্টেমের ডকুমেন্টেশন পর্যালোচনা করেছে। এরপর স্থানীয় চিকিৎসকদের সঙ্গে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে আলোচনা হয়।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন জানান, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার নতুন করে অবনতি হয়নি। চিকিৎসাতেও তিনি সাড়া দিচ্ছেন।
দেশজুড়ে কোরআন খতমসহ দোয়া-প্রার্থনা অব্যাহত : বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় দেশজুড়ে কোরআন খতম ও দোয়া মাহফিল অব্যাহত রয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ বিভাগসহ দেশের সব জেলায় ও উপজেলায় বিএনপির নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর সুস্থতা কামনায় দোয়া মাহফিল ও প্রার্থনা করছেন। দলের চেয়ারপারসন প্রবীণ রাজনীতিক খালেদা জিয়ার অসুস্থতায় বিএনপির সামগ্রিক কার্যক্রম থমকে গেছে। নেতাকর্মীরা সাংগঠনিক কার্যক্রমে মনোযোগ দিতে পারছেন না। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা নিয়মিত চেয়ারপারসনের চিকিৎসার সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর রাখছেন বলেও জানা গেছে। অবস্থা দেখে প্রয়োজনে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, বিএনপি চেয়ারপারসনকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে চাইলে সরকার সব ধরনের সহযোগিতা করবে। একই সঙ্গে খালেদা জিয়াকে ভিভিআইপি ঘোষণার সিদ্ধান্ত সব সংস্থাকে অবিলম্বে কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। তা ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসনকে রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ঘোষণার পরদিন থেকেই তার নিরাপত্তায় এভারকেয়ার হাসপাতালে মোতায়েন করা হয়েছে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ)।
বসুন্ধরায় এভারকেয়ার হাসপাতালের বাইরে অসুস্থ খালেদা জিয়ার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা সাংবাদিকদের অবহিত করেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে ডাক্তাররা যে চিকিৎসা দিচ্ছেন, সেই চিকিৎসা উনি (খালেদা জিয়া) গ্রহণ করতে পারছেন। অথবা আমরা যদি বলি উনি মেনটেইন করছেন। আমরা এই সংকটময় মুহূর্তে আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে তার সুস্থতার জন্য দোয়া চাই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যাতে দেশবাসীর দোয়া, সারা পৃথিবীর অনেক মানুষের তার প্রতি ভালোবাসা এবং দোয়ার কারণে হয়তো বা তিনি এই যাত্রায় সুস্থ হয়ে উঠবেন।
চিকিৎসায় যুক্ত দেশি-বিদেশি চিকিৎসক : অধ্যাপক জাহিদ হোসেন বলেন, যুক্তরাজ্য থেকে খালেদা জিয়াকে দেখার জন্য বিশেষজ্ঞরা আসছেন এবং উনারা দেখছেন। উনাকে যদি ট্রান্সফারেবল হয়, আমাদের যদি ট্রান্সফার করার প্রয়োজন পড়ে, উনার মেডিকেল বোর্ড মনে করে, তখনই উনাকে যথাযথ সময়ে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হবে। আমাদের সব প্রস্তুতি আছে। কিন্তু সর্বোচ্চটা মনে রাখতে হবে যে, রোগীর বর্তমান অবস্থা এবং সর্বোপরি মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শের বাইরে কোনো কিছু করার সুযোগ এই মুহূর্তে নেই।
ডা. জাহিদ আরও বলেন, দলের মহাসচিব এবং দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ সারাদেশের মানুষের মতো প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা সার্বক্ষণিকভাবে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যাপারে যথাযথ সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ অর্থাৎ আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, চীন, কাতার, সৌদি আরব, পাকিস্তান, ভারত খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যাপারে তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিদেশ নিলে সহযোগিতা করবে সরকার : সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে সরকারের প্রস্তুতি রয়েছে। যদি চিকিৎসকরা সেটা মনে করেন এবং দলের সিদ্ধান্ত হয়, সে অনুযায়ী তা করা হবে।
তৌহিদ হোসেন বলেন, খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে চিকিৎসক ও দলের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল, তবে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের প্রতি তারেক রহমানের কৃতজ্ঞতা : বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতার সময়ে সহযোগিতা ও শুভকামনার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দেশবাসীর সম্মিলিত সমর্থনই জিয়া পরিবারের শক্তি ও প্রেরণার উৎস বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে তারেক রহমান লিখেছেন, ‘বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতার জন্য যেভাবে সহযোগিতা ও শুভকামনা জানানো হচ্ছে, জিয়া পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা সবার প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ, কূটনীতিকরা, বন্ধুগণের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা, পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের অপরিসীম ভালোবাসা ও দোয়া, সবকিছু আমাদের আবেগ ও অনুভূতিকে গভীরভাবে স্পর্শ করছে।
তারেক রহমান আরও লেখেন, দেশবাসীর সম্মিলিত সমর্থনই আমাদের পরিবারের শক্তি ও প্রেরণার উৎস। মমতাময়ী দেশনেত্রীর দ্রুত আরোগ্যের জন্য আমরা সবাই নিরন্তর দোয়া করছি। এই কঠিন সময়ে ঐক্য, সহমর্মিতা ও সংহতির জন্য প্রতিটি মানুষের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা রইল।
নিরাপত্তার দায়িত্বে এসএসএফ : খালেদা জিয়াকে ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ ঘোষণা করার একদিন পরই এসএসএফ নিরাপত্তা দেওয়া শুরু করেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন ও নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান গত রাতে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বেগম খালেদা জিয়াকে দেখতে যান।
ভোরের আকাশ/এসএইচ