নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২৫ ০১:৩৮ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
দেশে জুলাই সনদ ঘোষণা, জাতীয় নির্বাচনসহ ভূ-রাজনীতিকেন্দ্রিক ঘুমোট পরিবেশ বিরাজ করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে সরকার ও সকল রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক আস্থা ও ঐক্যের বিকল্প নেই। কিন্তু সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কিছু মন্তব্য ও বক্তব্যে বিভ্রান্তিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ। অনেক সময় ঐক্য ভাঙনের কারণ হয়েও দাঁড়াচ্ছে। তাদের মন্তব্য যাই হোক না কেন, সাধারণ মানুষের আলোচনা-সমালোচনার খোরাক হয়ে উঠেছে।
ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে সরকার ও নির্বাচন কমিশন। কিন্তু সাড়ে সাত মাস ধরে অনৈক্যের একই আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে জুলাই সনদ। সিরিজ বৈঠকেও মিলছে না সফলতা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় জুলাই সনদের ওপরই নির্ভর করছে ফেব্রুয়ারির অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের সফলতা। কিন্তু নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে দলগুলো। শুধু তাই নয়, সনদকেন্দ্রিক নিজেদের দাবি পূরণ না হলে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার হুমকি প্রদান করে চলেছে অনেক রাজনৈতিক দল। ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে জুলাই জাতীয় সনদের খসড়া চূড়ান্ত করা হলেও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি। আগামী ১৫ অক্টোবর ঐকমত্য কমিশনের তৃতীয় দফার বর্ধিত মেয়াদ শেষ হবে। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মন্তব্য দেশে মতবিরোধের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
দায়িত্বশীলদের মন্তব্য
সম্প্রতি নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে সাইড লাইনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জিটিওর মেহেদি হাসানকে দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকার দেন।
সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সেসবের ব্যাখ্যা দেন। কিন্তু ইতোমধ্যে দেশে ফিরলেও প্রধান উপদেষ্টা নিজে ওসব বক্তব্যের কোনো ব্যাখ্যা দেননি।
প্রধান উপদেষ্টার যে দুটি বক্তব্য সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে, তা হলো- নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের ফেরা প্রসঙ্গ। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনি এই সাক্ষাৎকারের শুরুতে যেমন বলেছেন, বাংলাদেশের অনেক মানুষ এখনই পদক্ষেপ চান-আগামীকাল নয়, ছয় মাস পরেও নয়। সমালোচকেরা বলছেন, এটি অনেক দেরি। নির্বাচনের জন্য আরও ছয় মাস অপেক্ষা করাটা অনেক দীর্ঘ সময়। মানুষ অস্থির হয়ে পড়ছেন। আমরা কেন আগে নির্বাচন করতে পারছি না? নেপালে, যেখানে এই বছরে কিছুদিন আগে সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, সেখানকার অন্তর্বর্তী নেতা মাত্র ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বাংলাদেশের একটি নির্বাচনের জন্য কেন ১৮ মাস লাগছে বা লাগবে?’
এর জবাবে প্রধান উদেষ্টা বলেন, ‘অবশ্যই, আপনি বললেন, মানুষ বলছে অনেক সময় লাগছে। এমন মানুষও আছে, যারা বলছে ৫ বছর থাকুন, ১০ বছর থাকুন, ৫০ বছর থাকুন। সুতরাং মানুষ সব ধরনের কথা বলছে। আপনি থাকুন, নির্বাচন কেন? কার নির্বাচন দরকার?
আওয়ামী লীগকে নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল হয়নি, কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, সেটা নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত।
তবে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের স্থগিতাদেশ তিনি তুলে নিতে পারেন কিনা জানতেত চাইলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন,‘স্থগিতের আদেশ তুলে নেওয়ার বিষয়টি একটি সম্ভাবনা।’
প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎকারের এই অংশ নিয়ে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ইতোমধ্যে সমালোচনামূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর ‘শাপলা প্রতীক না পেলে কীভাবে নির্বাচন হয় দেখে নেব’- এমন মন্তব্য করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, ‘এনসিপির মার্কা শাপলাই হতে হবে। অন্য কোনো অপশন নাই। না হলে কোনো নির্বাচন কীভাবে হয় আর কে কীভাবে ক্ষমতায় গিয়ে মধু খাওয়ার স্বপ্ন দেখে, সেটা আমরাও দেখে নিব।’ এখানে ‘দেখে নেওয়া’র বিষয়টি নিয়ে চলছে আলোচনা।
গত ১৬ আগস্ট চিকিৎসকদের উদ্দেশে কঠোর প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, আপনারা কি ওষুধ কোম্পানির দালাল? কোন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের? তিনি রোগীদের অপ্রয়োজনীয় টেস্ট না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যস্বত্বভোগী না হওয়ারও অনুরোধ করেন।
তিনি চিকিৎসকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘দয়া করে এসব অত্যাচার বন্ধ করুন। বাংলাদেশের মানুষ গরিব। বড়লোকদের গলা কাটেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রতি এভাবে নিষ্ঠুর হবেন না।’ উপদেষ্টার এমন মন্তব্যে ইতোমধ্যে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে দেশের চিকিৎসক সমাজ।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বাংলাদেশ আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে আয়োজিত গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ‘আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে কারো সঙ্গে কোনো কম্প্রোমাইজ করা হবে না। আমাকে অনেকে ভয় দেখায়-যদি আমরা ক্ষমতায় আসি, পাশের দেশের (ভারত) লোকেরা ঢুকে পড়বে। আমি বলি, আমি দোয়া করি তারা ঢুকুক। ঢুকলেই আমাদের সেই বদনাম যাবে, যা ১৯৭১ সালে মিথ্যাভাবে চাপানো হয়েছে। তখন আমরা প্রকৃত স্বাধীনতার যোদ্ধা হিসেবে নিজেদের প্রমাণের সুযোগ পাব। কমপক্ষে ৫০ লাখ যুবক ভারতের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ করবে।’
খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগের ঘটনাকে ‘ভুয়া ধর্ষণ’ উল্লেখ করে বক্তব্য দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ। এ নিয়ে বিতর্ক হয়।
পরবর্তীতে তিনি জানান, এ অনাকাক্সিক্ষত শব্দ ব্যবহার করার জন্য তিনি ‘বিব্রত ও দুঃখিত’।
হান্নান এবার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘ধর্ষণের মতো গর্হিত অপরাধকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। ধর্ষকের কঠোর থেকে কঠোরতর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জামায়াতকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘ইসলামের নামে রাজনীতি করে জনগণের সঙ্গে মুনাফিকি করছে।’
তিনি বলেন, ‘আপনারা ইশারা ইঙ্গিতে বিএনপিকে দোষারোপ করার চেষ্টা করছেন। জনগণ জানে কারা নিজেদের অঙ্গীকার রক্ষা করে। খালেদা জিয়া জেল খেটেছেন, তারেক রহমান দেশ ছেড়েছেন তবুও দেশকে রক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। নির্যাতিত ও অসহায়দের পাশে দাঁড়িয়েছে- আমরা বিএনপি পরিবার। এই কার্যক্রম চলমান থাকবে।’
দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এমন আরও অনেক মন্তব্য ও বক্তব্য রয়েছে, যা পারস্পরিক সম্প্রীতি ও আস্থার সংকট সৃষ্টি করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এর আগেও চলতি বছরের শুরুতে দেশের সেনাপ্রধানের বক্তব্য এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ ইস্যু নিয়ে চলে ব্যাপক আলোচনা। একই ইস্যুর ওপর সরকার এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের পদত্যাগের জল্পনা বেড়েছিল এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের কথায়।
কিন্তু পরবর্তীতে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।
আর ফেসবুকে ‘প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না’- পোস্ট দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পর মুছে ফেলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দায়িত্বশীল অনেকের ঐকমত্যের আহ্বানমূলক বক্তব্যের কয়েক লাইন পরেই সাংঘর্ষিক ও বিরোধিমূলক কথা চলে এসেছে। স্পর্শকাতর বিষয়ে দেয়া বক্তব্য কয়েক ঘণ্টা পর মুছে ফেলার ঘটনাও ঘটছে। ফলে দায়িত্বশীলদের বক্তব্যে জনসাধারণের আস্থা ও বিশ্বাস রাখার ক্ষেত্রে মারাত্মক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। যা রাষ্ট্র ও সরকার সম্পর্কে জনমনে ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দিচ্ছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ