নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১২:৪০ এএম
ছবি: সংগৃহীত
ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে সর্বাত্মক প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে সরকার ও নির্বাচন কমিশন। নির্ধারিত মাসে নির্বাচন না হলে জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে- অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তির মন্তব্যে এমন শঙ্কাও প্রকাশ পাচ্ছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ ইতোমধ্যে চলতি মাসে দু’বার স্পষ্টভাবে এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দলের দায়িত্বশীল নেতারাও একই সুরে ঝুঁকির কথা বলছেন।
এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরাজ করছে পারস্পরিক টানাপোড়েন। কঠিন শর্তজুড়ে দিয়ে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকির বিষয়টি দেশবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ঘনিয়ে আসছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। পাল্টে যাচ্ছে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের অভিন্ন ঐক্য ভুলে দলীয় স্বার্থ রক্ষায় বেশি ঝুঁকছে দলগুলো। শুধু জুলাই সনদে নয়, বিভিন্ন কর্মসূচিতে পরস্পরের প্রতি দলগুলোর মন্তব্য ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে আক্রমণাত্মক আচরণ ও মনোভাব ফুটে উঠছে। দাবি পূরণ না হলে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার হুমকিও নানাভাবে দিয়ে যাচ্ছে অনেক রাজনৈতিক দল। টেবিলে আলোচনা রেখেই ইতোমধ্যে রাজপথে কর্মসূচি শুরু করেছে জামায়াতসহ সাতটি রাজনৈতিক দল। দলগুলোর মাঝে সৃষ্ট এমন গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতি ‘নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ’কে পুনর্বাসিত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে পারে- এমন আতঙ্কও করছেন বিশ্লেষকরা।
ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে সরকার ও নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা প্রায় প্রতিদিনই ঘোষিত নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন আয়োজন করতে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে যাচ্ছেন। কোনো শক্তিই নির্বাচন ব্যাহত করতে পারবে না বলেও দেশবাসীকে আশ্বস্ত করছেন তারা। নির্বাচন আয়োজনে সরকারের আন্তরিকতা থাকলেও জুলাই সনদসহ বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্যে স্বস্তিবোধ করছেন না সাধারণ মানুষ। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সামনের দিনগুলোতে বিপদের অশনি সংকেত দেখতে পাচ্ছেন তারা।
জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির শঙ্কা
নির্ধারিত মাসে নির্বাচন না হলে জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে- অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তির মন্তব্যে এমন শঙ্কাও প্রকাশ পাচ্ছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ ইতোমধ্যে চলতি মাসে দু’বার স্পষ্টভাবে এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
গতকাল শনিবার ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা দেখেন কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত কোনো অনিশ্চয়তা দেখি না। আমি যেটা মনে করি, ফেব্রুয়ারিতে অবশ্যই নির্বাচন হওয়া দরকার। নির্বাচন না হলে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অভ্যন্তরীণভাবে তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে, সে রকম পরিস্থিতিতে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এটা একধরনের হুমকি তৈরি করতে পারে। একধরনের বিপদ তৈরি করতে পারে। এটা রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে। সবাইকেই একসঙ্গে আসতে হবে। সরকারকে কঠোর অবস্থান নিয়ে, রাজনৈতিক দলগুলোকে একত্র করে, সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনটা যেন অবশ্যই অনুষ্ঠিত হয়।’
এর আগে গত ১৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে ‘নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার পথ’ শিরোনামের গোলটেবিল বৈঠকে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে বাংলাদেশে কেবল অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে, তা নয়; জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। আমি তা-ই মনে করি। সেই কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রয়োজন এ জিনিসটা মোকাবিলা করা।’
গত ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘সংস্কার সংস্কারের মতো চলবে, এটি কনটিনিউ প্রসেস। বিচারেও টাইম লিমিট করা যায় না, তাতে অবিচার হবে। সেটা (বিচার) চলবে, যে সরকারই আসুক। কিন্তু নির্বাচনকে কন্ডিশনাল করা যাবে না। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে রিজিওনাল সিকিউরিটির জন্য থ্রেড হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠান যেন না হতে পারে, যেন একটি অনিশ্চিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়, ফ্যাসিবাদী শক্তি সেই চেষ্টা করছে। ফ্যাসিবাদী শক্তি সুযোগ পেলে, আস্কারা পেলে জাতীয় জীবনের জন্য, এমনকি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে। আমি বলছি, এটি রিজিওনাল সিকিউরিটির জন্য থ্রেড হতে পারে।
প্রতিবেশী শক্তিধর দেশগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘এখানে দুটি রিজিওনাল শক্তি। আমরা বাংলাদেশকে সেখানে নিতে চাই না। নির্ধারিত টাইম লাইনে নির্বাচন হতেই হবে।’
সম্প্রতি এক টেলিভিশন টক শোতে চিকিৎসক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. সাখাওয়াত হোসেন সায়ন্থ বলেছেন, দেশের গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে, অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে এবং উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের নিরাপদে দায়িত্ব থেকে সরে আসতে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।
তিনি সতর্ক করে বলেন, নির্বাচন না হলে দেশে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যা ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীর উত্থানের সুযোগ করে দেবে এবং গৃহযুদ্ধের ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। সরকারের তরফ থেকে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে এতদূর এগিয়ে আসার পর যদি নির্বাচন না হয়, তবে তা একটি অস্বাভাবিক অবস্থা হবে, যা দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।’
তিনি আরও বলেন,‘এই ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হলে ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী সুযোগ নেবে। এই পরিস্থিতি সরকার বনাম কোনো রাজনৈতিক দল বা দলগুলোর মধ্যে সংঘাতের জন্ম দেবে, যা কেবল ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। গৃহযুদ্ধ হলে তা গৃহের ভেতরে সীমিত থাকবে না, বরং গৃহে গৃহে ছড়িয়ে পড়বে। এতে মধ্যবর্তী স্থান আর নিরাপদ থাকবে না।’
সম্প্রতি বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, ‘দলীয় এজেন্ডার কারণে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে গেলে গণঅভ্যুত্থানের অর্জন বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। দেশের বিদ্যমান নিরাপত্তা ঝুঁকি আরও আরও বৃদ্ধি পাবে এবং সে রকম পরিস্থিতিতে আম-ছালা দুটোই চলে যেতে পারে।’
অনিশ্চয়তা কাটেনি জুলাই সনদের
চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় মাসের জন্য কাজ শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম দফার আনুষ্ঠানিক আলোচনা গত ৩১ জুলাই শেষ হয়েছে। পূর্বঘোষিত জুলাইয়ের মধ্যে সনদ ঘোষণা করতে পারেনি কমিশন। তারপর আগস্টের প্রথমার্ধেও সনদ ঘোষণার প্রস্তুতি নিয়েছিল কমিশন। দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য থাকায় কমিশনের মেয়াদ বাড়ানো হয় ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এই মেয়াদেও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। ফলে আগামী ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত তৃতীয় দফা মেয়াদ বেড়েছে ঐকমত্য কমিশনের। কিন্ত দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের তুলনায় অনৈক্যের তীব্রতাই যেন বেড়েছে।
অস্থিরতার শঙ্কা বাড়ছে
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুসারে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর পাঁচ মাস বাকি। কিন্ত বিষয়টি নিয়ে জনমনে এখনো অনিশ্চয়তা কাটেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে- ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। কিন্ত দলগুলোর মতবিরোধ এবং জটিল জটিল শর্তজুড়ে দেওয়ার মধ্যে দেশে সম্ভাব্য অস্থিরতার আশঙ্কা করছেন সাধারণ মানুষ।
বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘দাবিগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলো একে অপরকে ছাড় দিতে হবে। অন্যথায় দেশের জন্য সমূহ সংকট তৈরি করবে। আর সেই সংকট সবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে সবকিছু চিন্তা-ভাবনা করেই সব করা উচিত।’
গত ১৫ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদসহ সংশ্লিষ্ট অন্য বিষয়গুলোতে সমঝোতা না হলে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘দেশে যখন একটা সংকট হয়, তখন সব রাজনৈতিক শক্তি একত্র হয়ে সেই সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টা করে। নেপালে যে ঘটনা ঘটল, আমরা জানলাম, সেখানে দ্রুত একজনকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং তিন-চারজনের একটি মন্ত্রিসভা গঠন করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে- ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে। সে দেশের জনগণ এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। কিন্ত আমাদের এখানে তেমনটা হয়নি। আমাদের রাজনৈতিক শক্তিগুলো কোনো বিষয়েই তো একমত হতে পারছে না। তারা যদি একমত না হয় তাহলে নির্বাচন ঝুলে যাবে এবং দেশে ভয়ানক অনিশ্চয়তা দেখা দেবে।’
ভোরের আকাশ/এসএইচ