ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৭:৫৭ পিএম
ফাইল ছবি
ডেঙ্গুর পিক মৌসুম পার করছে রাজধানীবাসী। ডেঙ্গুরোগীর চিকিৎসার বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মশক নিধন কর্মসূচি ইতোমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছে নগরবাসী। ২৪ ঘণ্টায় দেশে আরও ৫১৪ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাতে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ৪৫ হাজার ২০৬ জনে দাঁড়িয়েছে। আর একই সময়ে ডেঙ্গুতে মোট ১৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১১৫ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৯০ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১১১ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৮০ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯৫ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৫ জন, রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) আট জন রয়েছেন।
২৪ ঘণ্টায় কোনো ৪৯৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। চলতি বছরে এ যাবৎ মোট ৪২ হাজার ৯৭১ জন রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৪৫ হাজার ২০৬ জন। এর মধ্যে ৬০ দশমিক চার শতাংশ পুরুষ এবং ৩৯ দশমিক ছয় শতাংশ নারী রয়েছেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট ৫৭৫ জনের মৃত্যু হয়। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট এক হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়, পাশাপাশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন মোট তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।
এদিকে, রাজধানীর ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বংশবিস্তার অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, স্থবির হয়ে পড়েছে ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম। মশক নিধন বিশেষ করে এডিস মশার লার্ভা ধ্বংসকরণ কর্মসূচি নেই। এর মধ্যে এডিস মশার প্রজননে সহায়ক ভূমিকা রাখছে আবহাওয়া। থেমে থেমে বৃষ্টিপাত এবং তার মাঝে রোদ থাকলে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশার দ্রুত প্রজনন ঘটে।
এদিকে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডীন ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, এ বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির মূল কারণ এডিস মশা বৃদ্ধি। এর পেছনে রয়েছে আবহাওয়ার পরিবর্তন ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত। স্থবির হয়ে পড়েছে ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম। মশক নিধন বিশেষ করে এডিস মশার লার্ভা ধ্বংসকরণ কর্মসূচি নেই। এর মধ্যে এডিস মশার প্রজননে সহায়ক ভূমিকা রাখছে আবহাওয়া। থেমে থেমে বৃষ্টিপাত এবং তার মাঝে রোদ থাকলে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশার দ্রুত প্রজনন ঘটে।
অন্যদিকে মশা নিয়ন্ত্রণে যে জোরালো কার্যক্রম দরকার, সেটি সঠিকভাবে হচ্ছে না। ফলে মশার বংশবিস্তার কমছে না। বিশেষ করে এডিস মশার কামড়ে যারা দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের মৃত্যু বেশি হচ্ছে। এছাড়া বয়স্ক, শিশু, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি-লিভার জটিলতার মতো দীর্ঘ মেয়াদে ভুগছেন-এমন রোগীর ডেঙ্গু হলে বেশি মারা যাচ্ছেন। এখনই জরুরিভিত্তিতে দেশব্যাপী মশা নিধনে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। না হলে আক্রান্ত ও মৃত্যু আগামী কয়েক মাস মহামারির মতো বাড়তে থাকবে।
রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন, এ বছর ডেঙ্গুর পাশাপাশি এডিস মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। চিকিৎসাব্যবস্থার নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এ রোগ শিগগিরই চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার বলেন, গত বছর মশার লার্ভার মৌসুম জরিপে দেখা গেছে, শহরে এডিস মশার ৯৯ শতাংশই এডিস ইজিপ্টাই এবং গ্রামাঞ্চলে ৯৫ শতাংশ এডিস এলবোপিক্টাস। শহর-গ্রাম সবখানেই ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট মানদণ্ডের চেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর প্রধান বাহক এডিস ইজিপ্টাই মশা এবং বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকায় এডিস অ্যালবোপিক্টাস মশা বেশি দেখা যাচ্ছে। শহরাঞ্চলে কমবেশি লার্ভিসাইড ও এডাল্টিসাইড স্প্রে হলেও গ্রামাঞ্চলে নিয়মিত হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলেও আরও অন্তত তিন মাস ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া সংক্রমণ বাড়তে থাকবে। যেটি দীর্ঘ মেয়াদে জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দেবে।
দায়সারা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও মৃত্যুর উচ্চহার কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাই প্রমাণ করে। এখানে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নতুনত্ব কিছু নেই। সবকিছু যেন চলছে দায়সারাভাবে। সমস্যার সমাধানে কার্যকর কোনো তৎপরতা নেই।
এ বিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যত কোনো কার্যক্রম নেই। বিষয়টি একেবারে গা-সওয়া হয়ে গেছে। সরকারের কোনো ভাবনা নেই। মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যত ব্যর্থ সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো।’
জানতে চাইলে আইইডিসিআর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘ডেঙ্গুর মৃত্যু কমাতে হলে চিকিৎসাব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। প্রাথমিক, মধ্যম ও জটিল; সব রোগের চিকিৎসা হচ্ছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা বড় হাসপাতালগুলোতে। এই হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক বাড়ালেও বাড়ে না রোগীর বেড। নেই আইসিইউর (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) ব্যবস্থা, যা আছে তাতে সব রোগীর হয় না। অনেকেই আছে ডেঙ্গুর লক্ষণে ভোগেন, কিন্তু টেস্ট করান না। হাসপাতালে গেলে অনেক সিরিয়াল, হয়রানি। দেশের অনেক মানুষ দরিদ্র, চিকিৎসা করার মতো টাকা থাকে না। হঠাৎ করে একদিন অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পরীক্ষা করে দেখেন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত; তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে।’
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মশক নিধন কর্মসূচি সন্তোষজনক নয় জানিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এভাবে হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু মোকাবিলায় কোনো নতুন ধরনের উদ্যোগ দেখা গেল না। সেই গতানুগতিক ধারাতেই চলছে সবকিছু। যেসব এলাকায় ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব আছে, সেসব এলাকায় নিয়মিতভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা অভিযান পরিচালনা করতে হবে। সেই সঙ্গে এলাকাবাসীকে সচেতন করতে হবে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সারাদেশে একসঙ্গে অভিযান পরিচালনা করতে হবে, হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে এই কাজ করতে হবে। খোলা স্থানগুলোতে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে এডিস মশার প্রজনন ঘটছে বলে জানান তিনি।
ভোরের আকাশ/এসএইচ