এম বদি-উজ-জামান
প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৫ ১১:৪৫ এএম
খালেদা জিয়া দেশে ফিরছেন ১৯ এপ্রিল
সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে বিএনপির চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া দেশে ফিরছেন আগামী ১৯ এপ্রিল শনিবার। তিনি ১৮ এপ্রিল শুক্রবার লন্ডন থেকে দেশের উদ্দেশে রওয়ানা হবেন বলে জানা গেছে।
চিকিৎসার জন্য তিন মাসেরও বেশি দিন লন্ডনে অবস্থান শেষে দেশে ফিরছেন বাংলাদেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এ সময়ে পারিবারিক আবহে নিবিড় চিকিৎসায় তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিএনপি চেয়ারপার্সনের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
বাংলাদেশের 'গণতন্ত্রের প্রতীক' ৭৯ বছর বয়সী বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসসহ শারীরিক নানা অসুস্থতায় ভুগছেন। ২০১৮ সালে 'কথিত' দুর্নীতির মামলায় সাজা দিয়ে তাকে কারাবন্দি করা হয়েছিল। ওই মামলায় সাজা দিয়ে দুই বছরের বেশি সময় নির্জন কারাগারে রাখা হয়েছিল তাকে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতির আদেশে খালেদা জিয়াকে পুরোপুরি মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির ওই আদেশের দিকে না তাকিয়ে আইনিভাবে মামলা মোকাবিলা করেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট থেকে তিনি 'কথিত' দুর্নীতির দুই মামলা থেকেই খালাস পান। সেসব মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হিসেবে তিনি কারাবন্দি হয়েছিলেন, সেসব মামলার সাজল বাতিল করে রায় দেন সুপ্রিম কোর্ট।
এরপর খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ৮ জানুয়ারি লন্ডনে যান। ৮ থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি লন্ডনের দ্য ক্লিনিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এরপর সেখানে অবস্থানরত তার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন তিনি। তারেক রহমানের বাসায় ফেরার পর গত দুই মাসে খালেদা জিয়াকে আর হাসপাতালে নিতে হয়য়নি। কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন হলে দ্য ক্লিনিকের চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা বাসায় গিয়ে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বটি পরিবারের প্রভাব অত্যন্ত প্রবল। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মী ও অনুসারী আছে দেশের আনাচে কানাচে। বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেও এই দুই পরিবারের একনিষ্ঠ সমর্থক ও শুভাকাঙ্ক্ষী রয়েছে। ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় এই দুই পরিবারকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে মাইনাস করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও খালেদা জিয়ার দৃঢ়তায় সে অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তখন রাজনীতিতে 'মাইনাস টু ফর্মুলা' আলোচনায় ছিল এবং দুই নেত্রীকে রাজনীতিকে থেকে সরে দাঁড়াবার জন্য চাপ তৈরি করা হয়েছিলো।
সর্বশেষ গত বছর ৫ আগস্ট শেখ মুজিব কন্যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর যখন খালেদা জিয়া লন্ডনে যান তখন একই ধরনের প্রপাগাণ্ডা চালানো হয়। এবারও দুই পরিবার বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে মাইনাস হচ্ছেন বলে গুঞ্জন ও অপপ্রচার চালানো হয়। কারণ খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা পরিবারের সবাই এখন বিদেশে।
খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাওয়ার পর দলের ভেতরে ও বাইরে এবং শুভাকাঙ্খীদের মধ্যে 'স্বস্তি'র পাশাপাশি 'উদ্বেগ উৎকণ্ঠা' দেখা দেয়। খালেদা জিয়া দেশে থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকারের কারণে। আর তার বড় ছেলে তারেক রহমান আগে থেকেই লন্ডনে রয়েছেন। তিনিও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের রোষানলে পড়ে বিদেশে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। তাকেও একাধিক মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে। বিগত সরকার আমলে তাকে ৬টি মামলায় সাল দেওয়া হলেও উচ্চ আদালত থেকে এরই মধ্যে ৪টিতে তিনি নির্দোস প্রমাণিত হয়েছেন।
এখনও দুটি মামলায় তার সাজা রয়েছে, যা তিনি আইনগতভাবে মোকাবিলা করতে আইনজীবীদের বলেছেন। এমন অবস্থায় অতীত ইতিহাস ও রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে বেগম খালেদা জিয়া দেশে ফিরবেন কি না কিংবা ফিরতে পারবেন কি না এমন আলোচনা গুঞ্জন ডালপালা মেলে। খালেদা জিয়াকে নিয়ে এমন উৎকণ্ঠা তৈরি হওয়ার মূল কারণ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।
অনেকের মধ্যে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় তা হলো 'খালেদা জিয়া চিকিৎসা শেষে স্বাভাবিকভাবে দেশে ফিরতে পারবেন তো? না কী 'তার ফিরতে কোনো সমস্যা হবে'। দুই পরিবারকে বিশেষ করে জিয়া পরিবারকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠানোর ষড়যন্ত্র আছে বলেই খালেদা জিয়ার লন্ডন যাওয়া নিয়ে এই প্রশ্ন ওঠে। তবে আগামী সপ্তাহেই সেই প্রশ্ন ও উদ্বেগের পরিসমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। আগামী সপ্তাহে দেশে ফিরছেন বেগম খালেদা জিয়া।
এর আগে, ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই চিকিৎসার জন্য লন্ডন গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। চিকিৎসা শেষে ওই বছরের ১৮ অক্টোবর দেশে ফেরেন তিনি। পরের বছর ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা হওয়ার পর কারাগারে পাঠানো হয় খালেদা জিয়াকে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে শর্তসাপেক্ষে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়। এর পর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ছয় মাস পর পর তার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ বাড়াচ্ছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। অসুস্থ খালেদা জিয়াকে বহুবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে।
চিকিৎসক ও তার পরিবারের সদস্যরা তাকে বিদেশ নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানালেও তাতে মন গলেনি তথাকথিত 'মানবতার জননী' ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার। কারাগারে থাকাবস্থায় বেগম খালেদা জিয়ার লিভার প্রতিস্থাপন খুব জরুরি হয়ে পড়ে। ২০২০ সালের পর তাকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্যে পরিবারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে আবেদন করা হলেও তাতে সাড়া দেয়নি তখনকার ফ্যাসিস্ট সরকার যদিও করোনার সময় সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্ত সাপেক্ষে ৬ মাসের জন্য সাজা স্থগিত করে খালেদা জিয়াকে কারামুক্তি দেওয়া হয়। এই মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস পরপর বাড়ানো হয় কয়েকদফা। কিন্তু তখনকার সরকার খালেদা জিয়াকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেয়নি।
এর মধ্যে বেশ কয়েকবার গুরুতর অসুস্থ হন 'আপসহীন' খেতাবপ্রাপ্ত সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। পরে দেশি বিদেশি চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুথানে শেখ হাসিনার পতন হয়।
এর পরদিন ৬ আগস্ট এভারকেয়ারে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার মুক্তির আদেশ দেন রাষ্ট্রপতি বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন দৈনিক ভোরের আকাশকে কয়েকদিন আগে জানান বেগম খালেদা জিয়া দ্য ক্লিনিকের অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি ও জেনিফার ক্রসের অধীনে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন। এছাড়া তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল টিমের সদস্যরা সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিচ্ছেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিচ্ছেন।
কবে দেশে ফিরবেন সে বিষয়ে তিনি একাধিকবার গণমাধ্যমকে বলেছেন, মধ্য এপ্রিল খালেদা জিয়া দেশে ফিরতে পারেন। ডা. জাহিদ বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে দীর্ঘ সময় কারাবন্দি রেখে উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রাখে। জুলাই আগস্টে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর বেগম খালেদা জিয়ার ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ সুগম হয়। আইনি লড়াইয়ে তিনি সব মামলা মোকাবিলা করেন। ইতোমধ্যে উচ্চ আদালতও তার বিরুদ্ধে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দায়ের করা মামলাগুলোকে হয়রানিমূলক বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে।
এর আগে ২০১৭ সালে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ওই সময়ও তিনি তিন মাস তারেক রহমানের বাসায় অবস্থান করে চিকিৎসা নেন এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সেখানে ঈদুল আজহা উদযাপন করেন। এরপর দীর্ঘদিন কারাগারে থাকায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করা হয়নি তার। এর অর্ধযুগ পর এবার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে লন্ডনে ঈদুল ফিতর উদযাপন করলেন তিনি। ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে 'ফ্যাসিস্ট' আওয়ামী লীগের পতনের পর পরিবারের সঙ্গে লন্ডনে ঈদ উদযাপন করেন।
যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়ছর এম আহমেদ দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, 'বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন ম্যাডাম খালেদা জিয়া। তিনি কবে দেশে ফিরবেন সে বিষয়ে আমার কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।' এর আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বলেছিলেন মধ্য এপ্রিলে খালেদা জিয়া দেশে ফিরতে পারেন।
ভোরের আকাশ/এসএইচ