মাজাহারুল ইসলাম
প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ১২:০৬ এএম
ছবি- সংগৃহীত
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল দুই-এক দিনের মধ্যে হচ্ছে- এমনটাই আভাস নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্রে পাওয়া গেছে। তফসিলপূর্ব কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গতকাল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পুরো কমিশন সাক্ষাৎ করেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য রেকর্ড করার জন্য বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের কাছে পত্র প্রেরণ করা হবে।
ইসির বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ১০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কমিশনের সাক্ষাতের কথা রয়েছে। এরপর ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে যে কোনো দিন তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে সূত্রে জানা যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের নিদের্শনা অনুয়ায়ী সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের প্রস্তুতিও ইতোমধ্যে নিয়েছে ইসি। ঘোষিত সম্ভাব্য সময়ে নির্বাচন করতে হলে ডিসেম্বরের ১০ অথবা ১১ তারিখে তফসিল ঘোষণা করার ইঈিত রয়েছে ইসির সূত্রে জানা গেছে।
তফসিল ঘোষণা প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, এই সপ্তাহের মধ্যেই কোনো এক সময় আমরা তফসিল ঘোষণা করব। তিনি বলেন, তফসিলপূর্ব যেসব কার্যক্রম আছে এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সেগুলোর স্টক নেওয়া হয়েছে। এগুলো সম্বন্ধে সবাই জানেন। যেমন সংলাপ, আইন ও বিধির সংস্কার। ভোটার তালিকা চূড়ান্তকরণ সেটা হয়ে গেছে।
তফসিল প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, আগামী ৮ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করা হবে। তফসিলপূর্ব ইসির দশম সভা হয়েছে। এই সভার অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল আইন ও রীতির আলোকে তফসিলপূর্ব এবং তফসিল উত্তর কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা।
তিনি আরও বলেন, অতি শিগগির জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং গণভোটের তফসিল ঘোষণা করা হবে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও জাতীয় পার্টি ছাড়াও গনঅধিকার পরিষদ, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি), ১২-দলীয় জোট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), ১১ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, চারদলীয় গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, গণফোরাম, বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি), লেবার পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ (মার্কসবাদী), গণফোরাম, ঐক্য ন্যাপ, জাতীয় গণফ্রন্ট, বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ (মাহবুব) ও গণমুক্তি ইউনিয়ন এখন নির্বাচনমুখী। যখন বেশিরভাগ দলই পুরোপুরি ভোটের মাঠে, তখন হঠাৎ করে নির্বাচনী তফসিল পেছানোর মৌখিকভাবে প্রস্তাব দিয়েছে এনসিপি। অবশ্য এ নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য দলগুলো। দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে এনসিপির এই প্রস্তাবকে গণতন্ত্র উত্তরণের পথে অন্তরায় মনে করছেন তারা। পাশাপাশি এর পেছনের কারণও খুঁজছেন।
এ প্রসঙ্গে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, তফসিল নিয়ে ইসি সিদ্ধান্ত নেবে। একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের মূল ব্যক্তির (বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া) সুস্থতার ব্যাপার আছে। আমরা চাই, সব রাজনৈতিক দল রাজনৈতিকভাবে প্রস্তুত হওয়ার পর তফসিল হোক।
এর আগে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি সংকট উত্তরণের পরই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার কথা নির্বাচন কমিশনকে বলেছে এনসিপি।
এ প্রসঙ্গে দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসার পর তফসিল ঘোষণা করলে তখন কাজটা অনেক সহজ হবে। গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়া অসুস্থ। ফলে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সংকটময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সংকটগুলো উত্তরণ করে সুন্দরভাবে তফসিল দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনকে বলেছি।
এনসিপি তফসিল পেছাতে চায় কি না-জানতে চাইলে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, না, আমরা কেন তফসিল পেছাতে চাইব? আমরা বলেছি যে সংকটগুলো সমাধান করে তফসিলটা দেওয়ার জন্য।’
তবে বিএনপির নেতারা বলছেন, তফসিল ঘোষণা হলেই দেশে আইনশৃঙ্খলা ও শান্তি ফিরে আসবে। আর জামায়াত নেতাদের মতো সবাই যখন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত, তখন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে রাজনীতি করলে তা কেউ গ্রহণ করবে না। তফসিল পেছানোর কোনো অজুহাত গ্রহণযোগ্য হবে না।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আমাদের (বিএনপি) সমস্যা হলে আমরা বলব। এনসিপি কি আমাদের মুখপাত্র? আমরা তো এখনো বলিনি তফসিল দিতে নিষেধ করার কথা। বরং আমাদের এখনো মনে হচ্ছে তফসিল যত দ্রুত ঘোষণা হবে, দেশে আইনশৃঙ্খলা ও শান্তি তত দ্রুত ফিরে আসবে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, এনসিপি কেন নির্বাচন পেছানোর দাবি করেছে, সেটা তারাই বলতে পারবে। আমরা তো দাবি করিনি। আমরা মনে করি, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন হবে। জনগণের আগ্রহ আছে, তারা ভোট দিতে পারবে। জনগণ বহুদিন ভোট দিতে পারেনি।
তিনি বলেন, গণতন্ত্র উত্তরণে নির্বাচনের বিকল্প কিছু নেই। সঠিক সময়ে নির্বাচন না হলে দেশের পরিস্থিতি হয়তো অন্যদিকে চলে যাবে; যা কারোরই কাম্য নয়।
হামিদুর রহমান আযাদ আরও বলেন, খালেদা জিয়া বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। তার দ্রুত সুস্থতার জন্য আমরা দোয়া করছি এবং দেশবাসীকে দলের পক্ষ থেকে দোয়ার আহ্বান জানিয়েছি। আমরা আশা করব, তিনি দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবেন। অসুস্থতা অনেক সময়ই মানুষের হাতে থাকে না। তবে খালেদা জিয়ার অসুস্থার সঙ্গে নির্বাচন পেছানোর কোনো সম্পর্ক নেই। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে সঠিক সময়ে নির্বাচন হওয়া দরকার।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, বর্তমানে যে সংকটগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেই সংকট মূলত একটা নির্বাচিত সরকার না থাকার কারণে। সেক্ষেত্রে দেশ যত দ্রুত নির্বাচিত সরকার পাবে, এ সংকট থেকে উত্তরণের পথ ততটাই সহজ হবে। কাজেই নির্বাচন বিলম্বিত না করে যত দ্রুত সময়ের মধ্যে করা যায়, সেটাই দেশের জন্য সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে মঙ্গলজনক। নির্বাচন নিয়ে প্রায় দেড় যুগ ধরেই কৌশল ও পালটা কৌশলের খেলায় ভোটাধিকারবঞ্চিত দেশের সাধারণ মানুষ। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও কেটে গেছে প্রায় দেড় বছর।
এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে প্রধান তিন দাবি ছিল-জাতীয় নির্বাচন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ও বিগত সরকারের সব অপকর্মের বিচারকাজ দৃশ্যমান করা। জুলাই সনদ ও বিচার দৃশ্যমানের দাবি পূরণ হয়েছে। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতির কথা একাধিকবার বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কথা রয়েছে ইসির।
অন্যদিকে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দলেরই নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে। দলগুলো ইতোমধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীও ঘোষণা করেছে। প্রার্থীরা ভোটের মাঠে গণসংযোগও করছেন। এমন পরিস্থিতিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে শিগগিরই তফসিল ঘোষণা না করার অনুরোধ জানিয়েছে এনসিপি। দলটির দাবি, খালেদা জিয়া অসুস্থ। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সংকটময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত ঠিক আছে। আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে একটু ঘাটতি আছে। বেশকিছু জায়গায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ফলে এ বিষয়ে সরকারের একটা নিশ্চয়তা দিতে হবে। তাই আইনশৃঙ্খলাসহ সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দলগুলোর সম্মিলিত সম্মতিতেই তফসিল ঘোষণা করা ভালো।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তফসিল পেছানোর বিষয়ে এখন পর্যন্ত সরাসরি কোনো আপত্তি জানায়নি এনসিপি। এ বিষয়ে আরও এক-দুইদিন পরে অফিশিয়ালি বক্তব্য দেওয়া হবে বলেও জানান এনসিপির এই সিনিয়র নেতা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তফসিল পিছিয়ে দিলে নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ফেব্রুয়ারি মানেই ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। আর একদিনও দেরি নয়। কারণ, এই সময়ে নির্বাচন করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশবাসীর কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাই প্রতিশ্রুত সময় অনুযায়ী নির্বাচন করে ফেলা উচিত। গণতান্ত্রিক উত্তরণের স্বার্থেই সঠিক সময়ে নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে সরকারের অনড় থাকা জরুরি বলেও মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।
ভোরের আকাশ/এসএইচ