তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:৫৯ এএম
বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিতে জোর বিশ্ব সংস্থাগুলোর
বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাও বটে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা খর্ব করতে তৈরি করা হয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। কাগজপত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসন থাকলেও এতে ভাগ বসায় ২০১২ সালে তৈরি করা অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই বিভাগটি। ফলে একটি দেশের আর্থিক খাতের দুটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা দাঁড়িয়ে যায়। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের ব্যাংক খাত।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আর্থিক খাতের দুটি বিশ্ব সংস্থা উদ্যোগ নিয়েছে। আর্থিক খাতে সংস্কারের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করার শর্ত জুড়ে দিয়েছে আইএমএফ। আইএমএফের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করতে বলেছে বিশ্ব ব্যাংক। নানামুখী চ্যালেঞ্জে জর্জরিত বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে স্থিতিশীল ও টেকসই করতে ১০ দফা সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসনের কথা গুরুত্বের সঙ্গে বলা হয়েছে।
বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। এখানে লিজ দেওয়ার পদ্ধতিতে চলেছে লুটপাট ও অর্থপাচার। আর এই পথ সুগম করতে দিন দিন দুর্বল করা হয়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংককে। এজন্য তৈরি করা হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। কাগজপত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসন থাকলেও এতে ভাগ বসায় ২০১২ সালে তৈরি করা অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই বিভাগটি। ফলে একটি দেশের আর্থিক খাতের দুটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা দাঁড়িয়ে যায়। এর আগে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেও এমন একটি বিভাগ সৃষ্টি করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার যা পরে বিএনপি সরকার বাতিল করেছিল।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সৃষ্টি করে সরকারি ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয় এই বিভাগকে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা কার্যক্রমেও হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয় বিভাগটির মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংককে দুর্বল করার পর পরই আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় শুরু হয় ব্যাংক লুটপাট, যার শুরু হয়েছিল সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারির মধ্য দিয়ে। লুটেরাদের বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরও নতুন নতুন লুটেরাদের আকৃষ্ট করে এই খাতে। ক্রমে প্রতাপশালী সকল স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর চাপে কোনঠাসা হয়ে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে চাপে ও লোভে নৈতিক পদস্খলনও ঘটে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তার।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির হিসাবে, গত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে লুটপাট সবচেয়ে বেশি হয়েছে ব্যাংক খাতে। তাদের প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্য ঋণ কেলেঙ্কারি, প্রতারণা, ভুয়া ঋণ ও ঋণের অপব্যবহারের বিভিন্ন ঘটনা চিহ্নিত করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতের লুটপাটের টাকা দিয়ে ১৪টি মেট্রোরেল ও ২৪টি পদ্মা সেতু করা যেত। সেই হিসাবে দেশের আর্থিক খাতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লুটের পরিমাণ ৭ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ব্যাংক খাত থেকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে যে অর্থ লুট করা হয়েছে, তার বড় অংশই পাচার হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এসব কারণে গত বছর ৫ আগস্ট রক্তক্ষয়ী গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সবদিক থেকে জোর দাবি ওঠে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সত্যিকারের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করার। একই সাথে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিলুপ্ত করে এটিকে একটি সেল হিসেবে রাখার পরামর্শ আসে।
অন্তর্বর্তী সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব দেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুরকে। তিনিও শুরু থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার কথা বার বার বলে আসছেন। একই কথা বলছে দুটি বিশ্ব সংস্থা, আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংক। বাংলাদেশের আর্থিক খাত সংস্কারের প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসনের বিষয়টি জোর দিয়ে তুলে ধরেছে বহুজাতিক ঋণদাতা সংস্থা দুটি।
সম্প্রতি ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির বিষয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশ সফর করে গেছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। ওই আলোচনাতেও আর্থিক খাতে সংস্কারের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করার শর্ত জুড়ে দিয়েছে আইএমএফ। ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে আইনগত সংস্কার ও কার্যকর সম্পদ মান যাচাই এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও সুশাসন জোরদারের ওপরও গুরুত্বারোপ করে সংস্থাটি।
পাশাপাশি অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন মোকাবিলায় জোরালো ভূমিকা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। আবার খেলাপি ঋণ কমানোর পাশাপাশি ব্যাংক খাতে দুর্বল তদারকি রোধ এবং নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতার ঘাটতি দূর করার কথাও বলেছে। দুই সপ্তাহের সফর শেষে গত ১৭ এপ্রিল আইএমএফ প্রতিনিধিদল সাংবাদিকদের সামনে যে ব্রিফিং করেছিল সেখানে এই বিষয়গুলো উঠে আসে। আইএমএফের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সায়ত্বশাসন নিশ্চিত করতে বলেছে বিশ্ব ব্যাংক। নানামুখী চ্যালেঞ্জে জর্জরিত বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে স্থিতিশীল ও টেকসই করতে ১০ দফা সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসনের কথা গুরুত্বের সঙ্গে বলা হয়েছে।
সংস্থাটির মতে, দীর্ঘদিনের কাঠামোগত দুর্বলতা, সুশাসনের অভাব ও রাজনৈতিক প্রভাবের ফলে ব্যাংক খাত এখন গুরুতর ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে দ্রুত সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। বুধবার প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ সুপারিশগুলো তুলে ধরেছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে উচ্চ খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি, পরিচালন অদক্ষতা ও রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ বিতরণসহ একাধিক সমস্যায় জর্জরিত। এ অবস্থায় ব্যাংক খাতের দুর্বলতা দূর করতে সুসংগঠিত ও কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি।
বিশ্বব্যাংকের ১০ দফা সুপারিশ হলো: ব্যাংক খাতের নীতি কাঠামো উন্নত করতে অগ্রাধিকার দেওয়া। আমানত সুরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করা। প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন আনা। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক পুনর্গঠন করা। খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনায় শক্ত কাঠামো তৈরি। সমন্বিত দেউলিয়া আইন প্রণয়ন করা। ব্যাংকিং আইন ও নীতির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। জরুরি তারল্য সহায়তার জন্য নীতি কাঠামো তৈরি করা। ব্যাংক তদারকিতে আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা অনুসরণ করা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৪ সালের জুনের শেষে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের মোট সম্পদ মূল্য দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা দেশের আর্থিক খাতের ৮৮ শতাংশ এবং মোট জিডিপির প্রায় ৫০ শতাংশ। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ রয়েছে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের, ২৫ শতাংশ রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের এবং ৪ শতাংশ বিদেশি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে।
বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে ঋণের নামে অর্থ আত্মসাৎ, পারিবারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ প্রদান এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক অনুমোদন দেওয়ার মতো ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে চলমান। ২০২৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে এক পরিবারের সদস্যদের পর্ষদে থাকার মেয়াদ ১২ বছরে উন্নীত করায় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরও দৃঢ় হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির তথ্য উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে আটটি ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে পারস্পরিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৭০ কোটি মার্কিন ডলার, যা প্রমাণ করে ব্যাংক খাতে কীভাবে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম ইনস্টিটিউশনালাইজড হয়ে উঠেছে।
বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে বলেছে, ব্যাংক খাতের অস্থিরতা কেবল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করে না, বরং বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস করে এবং জিডিপির প্রায় ৭ শতাংশ পর্যন্ত বার্ষিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭০ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত বিশ্বের ১৫১টি ব্যাংকিং সংকট বিশ্লেষণ করে এমনটাই উঠে এসেছে। সংস্থাটি মনে করে, অন্তর্র্বতী সরকার গঠনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু দুর্বলতা চিহ্নিত করে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এই উদ্যোগকে কার্যকর করতে হলে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কার্যকর নীতিনির্ধারণ প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাংক জোর দিয়ে বলেছে, ব্যাংকিং খাতের সংকট মোকাবিলায় যত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে, অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রা ততই হ্রাস করা সম্ভব হবে। এ জন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সহ দশ দফা সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
ভোরের আকাশ/এসএইচ
তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
প্রকাশ : ৪ ঘন্টা আগে
আপডেট : ২ মিনিট আগে
বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিতে জোর বিশ্ব সংস্থাগুলোর
বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাও বটে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা খর্ব করতে তৈরি করা হয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। কাগজপত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসন থাকলেও এতে ভাগ বসায় ২০১২ সালে তৈরি করা অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই বিভাগটি। ফলে একটি দেশের আর্থিক খাতের দুটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা দাঁড়িয়ে যায়। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের ব্যাংক খাত।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আর্থিক খাতের দুটি বিশ্ব সংস্থা উদ্যোগ নিয়েছে। আর্থিক খাতে সংস্কারের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করার শর্ত জুড়ে দিয়েছে আইএমএফ। আইএমএফের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করতে বলেছে বিশ্ব ব্যাংক। নানামুখী চ্যালেঞ্জে জর্জরিত বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে স্থিতিশীল ও টেকসই করতে ১০ দফা সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসনের কথা গুরুত্বের সঙ্গে বলা হয়েছে।
বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। এখানে লিজ দেওয়ার পদ্ধতিতে চলেছে লুটপাট ও অর্থপাচার। আর এই পথ সুগম করতে দিন দিন দুর্বল করা হয়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংককে। এজন্য তৈরি করা হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। কাগজপত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসন থাকলেও এতে ভাগ বসায় ২০১২ সালে তৈরি করা অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই বিভাগটি। ফলে একটি দেশের আর্থিক খাতের দুটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা দাঁড়িয়ে যায়। এর আগে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেও এমন একটি বিভাগ সৃষ্টি করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার যা পরে বিএনপি সরকার বাতিল করেছিল।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সৃষ্টি করে সরকারি ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয় এই বিভাগকে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা কার্যক্রমেও হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয় বিভাগটির মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংককে দুর্বল করার পর পরই আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় শুরু হয় ব্যাংক লুটপাট, যার শুরু হয়েছিল সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারির মধ্য দিয়ে। লুটেরাদের বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরও নতুন নতুন লুটেরাদের আকৃষ্ট করে এই খাতে। ক্রমে প্রতাপশালী সকল স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর চাপে কোনঠাসা হয়ে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে চাপে ও লোভে নৈতিক পদস্খলনও ঘটে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তার।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির হিসাবে, গত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে লুটপাট সবচেয়ে বেশি হয়েছে ব্যাংক খাতে। তাদের প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্য ঋণ কেলেঙ্কারি, প্রতারণা, ভুয়া ঋণ ও ঋণের অপব্যবহারের বিভিন্ন ঘটনা চিহ্নিত করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতের লুটপাটের টাকা দিয়ে ১৪টি মেট্রোরেল ও ২৪টি পদ্মা সেতু করা যেত। সেই হিসাবে দেশের আর্থিক খাতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লুটের পরিমাণ ৭ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ব্যাংক খাত থেকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে যে অর্থ লুট করা হয়েছে, তার বড় অংশই পাচার হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এসব কারণে গত বছর ৫ আগস্ট রক্তক্ষয়ী গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সবদিক থেকে জোর দাবি ওঠে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সত্যিকারের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করার। একই সাথে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিলুপ্ত করে এটিকে একটি সেল হিসেবে রাখার পরামর্শ আসে।
অন্তর্বর্তী সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব দেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুরকে। তিনিও শুরু থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার কথা বার বার বলে আসছেন। একই কথা বলছে দুটি বিশ্ব সংস্থা, আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংক। বাংলাদেশের আর্থিক খাত সংস্কারের প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসনের বিষয়টি জোর দিয়ে তুলে ধরেছে বহুজাতিক ঋণদাতা সংস্থা দুটি।
সম্প্রতি ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির বিষয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশ সফর করে গেছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। ওই আলোচনাতেও আর্থিক খাতে সংস্কারের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করার শর্ত জুড়ে দিয়েছে আইএমএফ। ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে আইনগত সংস্কার ও কার্যকর সম্পদ মান যাচাই এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও সুশাসন জোরদারের ওপরও গুরুত্বারোপ করে সংস্থাটি।
পাশাপাশি অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন মোকাবিলায় জোরালো ভূমিকা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। আবার খেলাপি ঋণ কমানোর পাশাপাশি ব্যাংক খাতে দুর্বল তদারকি রোধ এবং নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতার ঘাটতি দূর করার কথাও বলেছে। দুই সপ্তাহের সফর শেষে গত ১৭ এপ্রিল আইএমএফ প্রতিনিধিদল সাংবাদিকদের সামনে যে ব্রিফিং করেছিল সেখানে এই বিষয়গুলো উঠে আসে। আইএমএফের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সায়ত্বশাসন নিশ্চিত করতে বলেছে বিশ্ব ব্যাংক। নানামুখী চ্যালেঞ্জে জর্জরিত বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে স্থিতিশীল ও টেকসই করতে ১০ দফা সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসনের কথা গুরুত্বের সঙ্গে বলা হয়েছে।
সংস্থাটির মতে, দীর্ঘদিনের কাঠামোগত দুর্বলতা, সুশাসনের অভাব ও রাজনৈতিক প্রভাবের ফলে ব্যাংক খাত এখন গুরুতর ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে দ্রুত সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। বুধবার প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ সুপারিশগুলো তুলে ধরেছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে উচ্চ খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি, পরিচালন অদক্ষতা ও রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ বিতরণসহ একাধিক সমস্যায় জর্জরিত। এ অবস্থায় ব্যাংক খাতের দুর্বলতা দূর করতে সুসংগঠিত ও কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি।
বিশ্বব্যাংকের ১০ দফা সুপারিশ হলো: ব্যাংক খাতের নীতি কাঠামো উন্নত করতে অগ্রাধিকার দেওয়া। আমানত সুরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করা। প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন আনা। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক পুনর্গঠন করা। খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনায় শক্ত কাঠামো তৈরি। সমন্বিত দেউলিয়া আইন প্রণয়ন করা। ব্যাংকিং আইন ও নীতির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। জরুরি তারল্য সহায়তার জন্য নীতি কাঠামো তৈরি করা। ব্যাংক তদারকিতে আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা অনুসরণ করা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৪ সালের জুনের শেষে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের মোট সম্পদ মূল্য দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা দেশের আর্থিক খাতের ৮৮ শতাংশ এবং মোট জিডিপির প্রায় ৫০ শতাংশ। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ রয়েছে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের, ২৫ শতাংশ রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের এবং ৪ শতাংশ বিদেশি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে।
বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে ঋণের নামে অর্থ আত্মসাৎ, পারিবারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ প্রদান এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক অনুমোদন দেওয়ার মতো ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে চলমান। ২০২৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে এক পরিবারের সদস্যদের পর্ষদে থাকার মেয়াদ ১২ বছরে উন্নীত করায় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরও দৃঢ় হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির তথ্য উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে আটটি ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে পারস্পরিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৭০ কোটি মার্কিন ডলার, যা প্রমাণ করে ব্যাংক খাতে কীভাবে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম ইনস্টিটিউশনালাইজড হয়ে উঠেছে।
বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে বলেছে, ব্যাংক খাতের অস্থিরতা কেবল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করে না, বরং বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস করে এবং জিডিপির প্রায় ৭ শতাংশ পর্যন্ত বার্ষিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭০ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত বিশ্বের ১৫১টি ব্যাংকিং সংকট বিশ্লেষণ করে এমনটাই উঠে এসেছে। সংস্থাটি মনে করে, অন্তর্র্বতী সরকার গঠনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু দুর্বলতা চিহ্নিত করে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এই উদ্যোগকে কার্যকর করতে হলে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কার্যকর নীতিনির্ধারণ প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাংক জোর দিয়ে বলেছে, ব্যাংকিং খাতের সংকট মোকাবিলায় যত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে, অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রা ততই হ্রাস করা সম্ভব হবে। এ জন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সহ দশ দফা সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
ভোরের আকাশ/এসএইচ