মুখোমুখি এনসিপি-ইসি
মাজাহারুল ইসলাম
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৫ ১২:৩৭ এএম
ছবি: সংগৃহীত
নির্বাচন পরিচালনার বিধিমালার তালিকায় না থাকলেও নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে শাপলা প্রতীক পাওয়ার দাবিতে অনড় অবস্থানে রয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এমনকি এই প্রতীক আদায়ের হুমকিও দিয়েছে দলটি। দলটির পক্ষে শাপলাই চাই, ইসির পক্ষে সম্ভব না- কাজেই নির্বাচন কমিশন ও এনসিপির মধ্যে এই প্রতীক ঘিরে বাকযুদ্ধের উত্তাপ বাড়াচ্ছে।
এনসিপি বলেছে, আইনি কোনো বাধা না থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক চাপে পড়ে কমিশন সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এদিকে, কমিশন বলছে, শাপলা প্রতীক আগে আরো কয়েকটি দল চেয়েছিল, তাদেরকে দেওয়া হয়নি। পরে এনসিপি শাপলা চেয়েছে। তাই কাউকে এই প্রতীক দেওয়া হয়নি। কাজেই এনসিপির নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে জটিলতা চলছেই। ক্রমাগত তারা শাপলা ফুলের ব্যাপারে জোর দিয়ে আসছে, যদিও নির্বাচন কমিশন প্রতীক সংরক্ষণের যে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে তাতে এই প্রতীক নেই।
এনসিপি শাপলা প্রতীক আদায়ের হুমকি দিলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার বিধিমালা অনুযায়ী ইসির তালিকা থেকেই দলটিকে প্রতীক বেছে নিতে হবে জানিয়েছেন ইসি সচিব আখতার আহমেদ। তিনি বলেন, এনসিপি যে প্রতীকটা চেয়েছে, সেটা আমাদের প্রতীক সংক্রান্ত বিধিমালার তফসিলে নেই। তাই আমরা তাদের কাছে ৩০ সেপ্টেম্বর চিঠি দিয়েছি।
সেই চিঠি পাওয়ার পর তারা যে প্রতীক প্রস্তাব করবেন, সেটি উল্লেখ করে আমরা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবো। তবে তফসিলে যে ১১৫টি প্রতীক রয়েছে, সেখানে শাপলা, সাদা শাপলা বা লাল শাপলা নেই। ফলে এনসিপি শাপলা প্রতীক পাবে না।
এ প্রসঙ্গে এনসিপি বলছে, নির্বাচন কমিশন চিঠি দিয়েছে ৭ অক্টোবরের মধ্যে তালিকাভুক্ত প্রতীক থেকে পছন্দ করে তা জানানোর জন্য। চিঠিতে বলা হয়েছে, দলটির প্রথম পছন্দ ‘শাপলা’ বর্তমানে নির্বাচন পরিচালনার বিধিমালার তালিকায় নেই, তাই এটি বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সেদিনই চিঠিটি পেয়েছে দলটি।
তবে শাপলার ব্যাপারে তারা নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করবেন না বলে জানান এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব ও আইন সম্পাদক জহিরুল ইসলাম মুসা। তিনি বলেছেন, এই চিঠিটা ইস্যু করার আগে তাদের আইনগতভাবে আরও কিছু ধাপ সম্পন্ন করার কথা ছিল, যেটা তারা করেনি এবং তাদের দেওয়া দুটি চিঠির বিষয়ে নিষ্পত্তি না করেই নির্বাচন কমিশন পরবর্তী ধাপে চলে গেছে বলে জানান এনসিপির এই নেতা।
তিনি আরও বলেন, চিঠিগুলো অনিষ্পন্ন অবস্থায় রেখে (চিঠিগুলোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না জানিয়ে) এই ধাপে আসার সুযোগ নেই এবং চিঠিটি আইনানুগভাবে সঠিক হয়নি। নির্বাচন কমিশন তাদেরকে যে চিঠি দিয়েছে, তাতে এনসিপির তিনটি চিঠির কথা বলা হয়েছে, ২২ জুন, ৪ আগস্ট এবং ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখের। এর মধ্যে ২২ জুন পাঠানো চিঠি অনুযায়ী নিবন্ধনের আবেদন প্রাথমিক পর্যালোচনায় গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
ইসি জানায়, এনসিপির আবেদনপত্রে পছন্দের প্রতীকের ক্রম ছিল- শাপলা, কলম অথবা মোবাইল। তবে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৯(১) অনুযায়ী ‘শাপলা’ বর্তমানে বরাদ্দের জন্য নির্ধারিত প্রতীকের তালিকায় নেই। তবে এনসিপি থেকে বলা হচ্ছে যে, ৩ আগস্টের চিঠিতে আগের চিঠির সংশোধনী এনে ‘শাপলা’, ‘সাদা শাপলা’ ও ‘লাল শাপলা’ এই তিনটি ক্রম চাওয়া হয়েছিল। এখন নির্বাচন কমিশনের চিঠির জবাব যে ৭ তারিখের মধ্যে দিতে বলা হয়েছে, সেটি তারা দেবেন কিন্তু আগের অবস্থানই পুনর্ব্যক্ত করা হবে যে, আমরা শাপলার ব্যপারে অনড়- বলেছেন দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব ও আইন সম্পাদক।
প্রধান নির্বাচন (সিইসি) কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন এনসিপিকে কেন শাপলা প্রতীক দেওয়া হয়নি সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শাপলা প্রতীক সবার আগে চেয়েছিল নাগরিক ঐক্য। তাদেরকে দেওয়া হয়নি। পরে এনসিপি শাপলা চেয়েছে। তাই কাউকে এই প্রতীক দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, প্রতীক হিসেবে শাপলা না দেওয়ার কোনো আইনি ভিত্তি নেই ইসির। শাপলা প্রশ্নে ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তারা।
তিনি বলেন, শাপলা প্রশ্নে আমরা যেটা বলবো আমরা মজলুম। নির্বাচন কমিশন এখানে অত্যাচারের ভূমিকা পালন করেছে। আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আমার আন্দোলন জারি রাখবো।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, ইসি একটার পর একটা কারণ দেখালেই কোনটাই যৌক্তিক নয়।
এনসিপি উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, আইনি কোনো বাধা না থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক চাপে পড়ে কমিশন সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এটি নির্বাচন কমিশনের স্পষ্ট ব্যর্থতা ও অক্ষমতার প্রমাণ।
এ নিয়ে ব্যাখ্যায় সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেছিলেন, ‘ফ্ল্যাগ অ্যান্ড এমব্লেম অর্ডার ১৯৭২ এ বলা আছে, আমাদের জাতীয় প্রতীক হবে শাপলা। এতে ধানের শীষ ও পাটের কুড়ি থাকলেও শাপলাটাই হচ্ছে মূল।
সিনিয়র এই আইনজীবী মনে করেন, শাপলা কোনো একটি দলের প্রতীক হতে পারে না। এজন্য কোনো একটি দলকে শাপলা প্রতীক দেওয়া উচিত হবে না বলে মত দেন তিনি।
এছাড়া রাজনীতিবিদ মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য নিবন্ধনের সময়ে বরাদ্দ ‘কেটলি’ প্রতীক বদলে শাপলা বা দোয়েল পাখি বরাদ্দের জন্য আবেদন করেছিল। নির্বাচন কমিশনের বেশ কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে এনিয়ে যোগাযোগ করা হলেও তাদের কারো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে ইসির চিঠিতে বলা হয়েছে, দলটিকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ৯০চ (১) (খ)-এর নিয়ম সম্পর্কে অবগত করা হয়েছে। ওই নিয়ম অনুযায়ী এই আদেশ বা বিধিমালার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কোনো দলের মনোনীত সব প্রার্থীর জন্য নির্ধারিত প্রতীকগুলোর মধ্য থেকে পছন্দ করা একটি প্রতীক বরাদ্দ করা হবে।
বরাদ্দকৃত প্রতীকটি সেই দলের জন্য সংরক্ষিত থাকবে, যদি না দলটি পরবর্তীতে তালিকার অন্য কোনো প্রতীক নিতে চায়। এবং ২০০৮-এর বিধি ৯(১)-এর অন্তর্ভুক্ত এমন একটি প্রতীক নির্বাচন করে কমিশনকে ৭ অক্টোবরের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ নিবন্ধনের পরবর্তী প্রক্রিয়ার জন্য বরাদ্দ না হওয়া প্রতীকগুলোর মধ্যে থেকে দলটিকে প্রতীক বাছাই করতে হবে।
ইসি এনসিপিকে নির্বাচনী প্রতীক পছন্দের জন্য যে ৫০টি প্রতীকের তালিকা দিয়েছে, সেগুলো হলো- আলমিরা, উটপাখি, কলম, কলস, কাপ-পিরিচ, কম্পিউটার, কলা, খাট, ঘুড়ি, চার্জার লাইট, চিংড়ি, চশমা, জগ, জাহাজ, টিউবওয়েল, টিফিন ক্যারিয়ার, টেবিল, টেবিল ঘড়ি, টেলিফোন, তবলা, তরমুজ, থালা, দালান, দোলনা, প্রজাপতি, ফুটবল, ফুলের টব, ফ্রিজ, বক, বালতি, বাঁশি, বেগুন, বেঞ্চ, বেলুন, বৈদ্যুতিক পাখা, মগ, মাইক, মোরগ, ময়ূর, মোড়া, মোবাইল ফোন, লাউ, লিচু, শঙ্খ, সেলাই মেশিন, সোফা, স্যুটকেস, হরিণ, হাঁস এবং হেলিকপ্টার।
এ প্রসঙ্গে এনসিপিকে শাপলা প্রতীক দিলে প্রতিবাদ করবেন বলে জানিয়েছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না।
তিনি বলেন, শাপলা প্রতীক যদি তাদের (এনসিপি) দিয়ে দেয়, কোনো মামলা করব না। কিন্তু প্রতিবাদ তো করব। আমরা যেহেতু আগে আবেদন করেছি; যদি প্রতীক হিসেবে শাপলা বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেটা নাগরিক ঐক্যের প্রাপ্য।
ভোরের আকাশ/এসএইচ