দুই দশক আগে নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও উৎপাদন-বিক্রি বন্ধ হয়নি
নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৫ ১২:৩০ এএম
ছবি: সংগৃহীত
বাজার থেকে পলিথিন নিষিদ্ধ ঘোষণা নতুন কোনো ঘটনা নয়। নিষিদ্ধ হওয়ার গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে পলিথিন নিয়ে লুকোচুরি খেলা প্রত্যক্ষ করে আসছে দেশবাসী। পরিবেশবিদরা বলছেন, ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারও পলিথিন নিষিদ্ধে বেশ সোচ্চার দেখাচ্ছে। পলিথিন পাওয়া গেলে কোনো ছাড় দেওয়া হবে- এমন হুঁশিয়ারি বার্তা দিয়ে রেখেছেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ২০২৪ সালের অক্টোবরে সুপারশপ এবং নভেম্বর থেকে বাজারে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু নতুন এই ঘোষণার এক বছর পরও সফলতার চিত্র দৃশ্যমান হয়নি। মাসে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন অভিযান পরিচালিত হলেও কারখানা চালু থেকে শুরু করে দেশের সর্বত্রই অব্যাহত রয়েছে পলিথিনের ছড়াছড়ি।
পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, ২০০২ সালে ১ মার্চ আইন করে বিষাক্ত পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ। তবে দেশে পলিথিনের ব্যবহার কমেনি; বরং গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়তে দেখা গেছে। এরপর সরকার ২০১০ সালে আরেকটি আইন করে। কিন্তু এই আইনও বাস্তবে কোনো কাজ দেয়নি।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, পলিথিন নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা সম্পর্কে অবগত নন ব্যবহারকারীরা। বিষয়টি নিয়ে ভাবেন না দোকানীরা। মাছ, মাংস, শাক-সবজিসহ এমন মুদি দোকান পাওয়া যাবে না, যেখানে পলিথিন ব্যবহার হয় না। রাজধানীর কারওয়ান বাজার রেললাইন ঘেঁষে গড়ে উঠেছে মাছের আড়ত ও খুচরাবাজার।
গত শুক্রবার এলাকাটি ঘুরে দেখা গেছে, মাছের বাজারটির বিভিন্ন পয়েন্টে খুচরা পলিথিনের ভাসমান দোকান। দোকানে রয়েছে বিভিন্ন সাইজের পলিথিন। পাশেই অনেক মানুষ টাকার বিনিময়ে মাছ কাটার পসরা সাজিয়ে রেখেছে।
খুচরা পলিথিন বিক্রেতা পলি বেগম ভোরের আকাশকে জানান, ‘মাছ কেনার আগে ও পরে অনেক ক্রেতা পলিথিন কিনে নেন। আমরা কেজিতে পলিথিন বিক্রি করি না। ১০ টাকায় বড় সাইজের দুটি এবং ছোট সাইজের চারটি পলিথি পাওয়া যায়।’
পলিথিন নিষিদ্ধের জানতে চাইলে তিনি বলেন ‘বাজার থেকে পলিথিন উঠিয়ে দেওয়া সম্ভব না। সরকার বহুবার এমন ঘোষণা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু কোনো কাজে দেয়নি।’
মাছ বিক্রেতা মো. তাহের ভোরের আকাশকে বলেন, ‘বিকল্প বের না হলে পলিথিন বন্ধ করা যাবে না। সরকারও বিষয়টি ভালো করে জানে। সরকারের পলিথিন নিষিদ্ধের খেলা নতুন কিছু না।’
কারওয়ান বাজারের শাক-সবজির দোকানেও পলিথিনের ছড়াছড়ি। প্রতিটি পণ্যের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে পলিথিন। আবার পণ্যভর্তি একাধিক পলিথিন আবার একটি বড় পলিথিনে ভরিয়ে বিক্রেতারা তুলে দিচ্ছেন ক্রেতাদের হাতে। পাঁচটি পণ্য কিনেছেন মো. সফিক। তিনি ব্যবহার করেছেন মোট ছয়টি পলিথিন।
তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, একটি পলিথিনে একাধিক পণ্য একসঙ্গে ভরালে পণ্যের মান নষ্ট হয়। তাই প্রতিটি পণ্যের জন্য পৃথক পৃথক পলিথিন ব্যবহার করেছি।’
একই চিত্র দেখা গেছে মগবাজার দিলুরোডের ফাহিন স্টেশনারি দোকানে। বিক্রেতা মো. জয়নাল ভোরের আকাশকে বলেন,‘ শুধু কাঁচাবাজার নয়, মাছ, মাংস, শাক-সবজিসহ অধিকাংশ পণ্যের বাজারে পলিথিন থাকতেই হবে। পলিথিন ছাড়া যেন বাজার চলে না। তাছাড়া অধিকাংশ ক্রেতাই প্রস্তুতি নিয়ে অন্য ব্যাগ নিয়ে বাজারে যান না। সারাদিনের অফিস শেষে অনেকেই বাজার করে বাসায় ঢুকেন। এক্ষেত্রে পলিথিন লাগবেই।’
শুধু মুদি দোকান বা কাঁচাবাজার নয়, খাবার হোটেল বা রেস্টুরেন্টেও পলিথিনের খোঁজ পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মগবাজার মসজিদ রোডের সাত তারা রেস্টুরেন্টের হোটেল বয় জুবায়ের ভোরের আকাশকে জানান, ‘প্রতিদিন অনেক খাবার পার্সেল যায়। ভাত-তরকারি পার্সেল করাতে পলিথিন ব্যবহার করা হয়। পলিথিনে ভর্তি করানোর পর অন্য কোনো ব্যাগে রাখা যায়।’
পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য ক্ষতি বিবেচনায়, ২০০২ সালে আইন করে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল বাংলাদেশ সরকার। সে সময় বাংলাদেশ ছিল এমন পদক্ষেপ নেয়া বিশ্বের প্রথম দেশ। যদিও পশ্চিমা বিশ্বের বিবেচনায় বাংলাদেশে পলিথিন ব্যবহারের শুরুটা অনেক পরের দিকে শুরু হয়েছিল। আইন করে নিষিদ্ধ করাটা কাজেও এসেছিল।
২০০৬ সাল পর্যন্ত মোটামুটি পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার সেভাবে দেখা যায়নি। এরপর ধীরে ধীরে নজরদারির অভাবে বাজারে জায়গা ফিরে পায় পলিথিন। এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) নামের সংস্থার একটি হিসেবে প্রতিদিন ঢাকা শহরেই সাড়ে চার কোটি পলিথিন ব্যাগ বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেয়া হয়। তাদের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী যারা প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি কাজ করেন তাদের উপরই বিষাক্ত রাসায়নিকের স্বাস্থ্যগত প্রভাব বেশি পড়ে।
এসডোর সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ড. শাহরিয়ার হোসেন মনে করেন, যেটি আগে থেকেই নিষিদ্ধ সেটি আইনের প্রয়োগ না থাকার কারণেই বিস্তার হয়েছে এবং বর্তমানে আইনের প্রয়োগে বাধা সৃষ্টিটাও রাজনৈতিকভাবে সরকারকে অপ্রস্তুত করতে করা হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে তো চ্যালেঞ্জ আসবেই, কিছু সুবিধাবাদী লোকজন তো এটা করতেই চাইবে। তারপরও ক্ষতির দিক বিবেচনায় আইনের প্রয়োগ করতে হবে।’
পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহারে ২০১০ সালে আরেকটি আইন করা হয়। যদিও আইন প্রয়োগের অভাব এবং বিকল্প ব্যবস্থার সংকটে পলিথিনের ব্যবহার রোধ করা যায়নি। তবে পলিথিন বন্ধের ব্যাপারে সরকারি তোড়জোড়ের কথা যতটা শোনা গেছে, বাস্তবে বাজারে বা যেসব স্থানে পলিথিন বিক্রি করা হয়, সেসব স্থানে অভিযান তেমন দেখা যাচ্ছে না। ফলে সুপারশপ গুলোয় পলিথিন ব্যবহার বন্ধ হলেও খোলা বাজারে এখনো প্রকাশ্যেই পলিথিন বিক্রি ও ব্যবহার হচ্ছে।
বিকল্প সংকট?
পলিথিন নিষিদ্ধের ব্যাপারে একটা প্রশ্ন অনেক সময়েই ঘুরে ফিরে আসে, সেটি হচ্ছে এর বিকল্প কী? ২০২৪ মালের নভেম্বর মাসেই যখন বাজারে পলিথিন নিষিদ্ধ থাকার কথা, তখনও দেদার পলিথিনের ব্যবহার দেখা গেছে। যারা ক্রেতা তাদের বড় অংশই সরকারের পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও সহজলভ্য কোনো বিকল্প না থাকার কথা উল্লেখ করেন। বিক্রেতারাও জানান বিকল্পের ঘাটতির কথা।
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এক্ষেত্রে উল্লেখ করেন, ১৯৯৫-৯৬ সালের আগে পলিথিন না থাকার কথা। সেসময় বাড়ি থেকে চট বা পাটের ব্যাগ নিয়ে মানুষ বাজারে যেতেন যেটা ধুয়ে পুনরায় ব্যবহার করা হতো। সমস্যা হচ্ছে এতটা কম খরচে সহজ বিকল্প এখনও নেই। মাঝে পাট থেকে তৈরি সোনালী ব্যাগ নিয়ে আশার জায়গা তৈরি হলেও, বাজারে সেসব ব্যাগ কখনও সেভাবে দেখা যায়নি।’
তবে এসডোর সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ২০০২ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যখন কড়াকড়ি ছিল তখন বিকল্প উপায়েই বহন করা হতো। তখন মাছ-মাংস থেকে পানি ঝরিয়ে কাগজে বা পাতায় মুড়ে এরপর প্যাকেটে বা ব্যাগে দেওয়া হতো। চাহিদা যখন তৈরি হবে তখন এগুলো চলে আসবে। আমরা যদি চাহিদা তৈরি না করেই বলি বিকল্প নেই সেটা ঠিক হবে না।’
স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি এবং চ্যালেঞ্জ : যেকোনো ধরনের প্লাস্টিক পণ্য পরিবেশে মিশে যায় না বলে পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্যে সমস্যা তৈরি করে। পরিবেশে মিশে না গেলেও প্লাস্টিকের কণা পরিবেশে ঠিকই ছড়িয়ে যায় যেগুলো খাদ্যের সাথে মিশে একরকম বিষাক্ত পরিস্থিতি তৈরি করে।
এসডোর গবেষণা অনুযায়ী খাবার, পানি ও বাতাস, প্রায় সবদিকেই প্লাস্টিকের কণা ছড়িয়ে পড়ে মানবদেহের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁঁকি সৃষ্টি করে। দূরবর্তী পর্যায়ে বিবেচনা করলে চিকিৎসা বা ওষুধপত্রের খরচটাও কম হয় না যেটা হয়তো বিবেচনা করা হয় না। বেশি মাত্রায় প্লাস্টিক থেকে নিঃসৃত রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসলে মেদ, হাঁপানি, হৃদরোগ, পাকস্থলি, ফুসফুস অথবা দৃষ্টিশক্তি সমস্যা, চর্মরোগ, আরও নানাবিধ রোগের কারণ হয় বলে উল্লেখ করা হয় এসডোর প্রতিবেদনে।
ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রভাবে ঢাকায় ঔষধ ও চিকিৎসাবাবদ মাসে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়। প্লাস্টিক পণ্যে সেসব রাসায়নিক উপাদান ভরপূর থাকে এবং ক্রমাগত সেসব বিষাক্ততার সংস্পর্শ মানুষের জন্য দূরবর্তী এমন প্রভাব তৈরি করতে পারে। এছাড়া মাটির সাথে সাথে মাছ-মাংস, এমনকি খাবার পানিতেও প্লাস্টিকের কণার দূষণ দেখা যাচ্ছে যেটা সরাসরি মানুষের দেহে প্রবেশ করে ঝুঁঁকি সৃষ্টি করছে বলে উল্লেখ করছেন ড. হোসেন।
এর বাইরে বিভিন্ন জায়গায় পলিথিনের কারণে পানি জমে যাওয়ার মতো সমস্যা সৃষ্টি করছে যা থেকে মশার বিস্তার এবং ডেঙ্গুর মতো রোগের কারণ হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘পরিবেশ রক্ষায় পলিথিনের পরিবর্তে পাটের ব্যাগ প্রচলনে সরকার ভর্তুকি মূল্যে পাটের ব্যাগ সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের এ উদ্যোগ সফল করতে ভোক্তাদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এরপরও নিষিদ্ধঘোষিত পলিথিন পাওয়া গেলে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না, জব্দসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ লক্ষ্যে নিয়মিত বাজার পরিদর্শন করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘পলিথিনের বহুল ব্যবহার মাটি, পানি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি তৈরি করছে। বিপরীতে পাটের তৈরি ব্যাগ টেকসই, পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে গৃহীত এ প্রকল্পের আওতায় টিসিবির ডিলার এবং বাজারের বণিক সমিতির মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে পাটের ব্যাগ বিক্রি করা হবে।’
ভোরের আকাশ/এসএইচ