মাজাহারুল ইসলাম
প্রকাশ : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ১২:০৫ এএম
ছবি- সংগৃহীত
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। অন্যদিকে ব্যক্তি স্বার্থকে পরিহার করে জয়ের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে ভোটের মাঠে প্রচার-প্রচারণায় রয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এমনটাই ভাবছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, সংসদ নির্বাচনের জন্য সারা দেশে ২৭২টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে বিএনপি। আর তিনশত আসনে প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছে জামায়াত।
এছাড়া অন্যান্য দলগুলোও তাদের দলীয় প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছে। কাজেই তফসিল ঘোষণার পরপরই রাজনৈতিক দলগুলো পুরোপুরি নির্বাচনমুখী। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নতুন উদ্যমে গণসংযোগে নেমে পড়েছেন দলগুলোর নেতারা। কিন্তু বিএনপির মধ্য রয়েছে বিভক্তি এবং দলীয় কোন্দল। দলটির ঘোষিত আসনের অন্তত ৫০টিতে কোন্দল চরম রূপ নিয়েছে। মনোনয়ন না পাওয়া প্রার্থীরা ঘোষিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে যেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেওয়ার ফলে অর্ধশতাধিক আসনে দলীয় নেতাকর্মীর মধ্যে বিভক্তি রয়েছে। এ কারণে ভোটের বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে বিএনপির। অন্যদিকে দলের ঘোষণাকে মেনে নিয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করছে জামায়াতের নেতাকর্মীরা। কাজেই বিএনপির চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে জামায়াত-এমটাই মনে করছেন রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করতে বিভিন্ন জটিলতায় ভূগছে বিএনপি। বিএনপি দু’দফায় যে প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে, তা ঘিরে তৃণমূলে চলছে তীব্র ক্ষোভ ও বিভক্তি। অনেক জায়গায় মনোনয়নবঞ্চিতদের বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। তালিকা ঘোষণার পর দলের ভেতর অসন্তোষ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ইলেকশনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
এরই মধ্যে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এমনকী নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তাজনিত কারণে দেখিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মো. মাসুদুজ্জামান মাসুদ ত্রয়োদশ জাতীয় পার্লামেন্ট ইলেকশন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এ নিয়ে দলের ভেতরে বাইরে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। তৃণমূল নেতাদের মতে, খুব দ্রুত এসব কোন্দল নিরসন না হলে ইলেকশনের ফলাফলেও এর প্রভাব পড়তে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, বিএনপিকে এককভাবে সরকার গঠন করতে হলে এখনই শক্তিশালী দলীয় ঐক্য ও মাঠের বিরোধ নিষ্পত্তি জরুরি। নইলে আশানুরূপ রেজাল্ট বঞ্চিত হবে দলটি।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, যশোর-৪ সংসদীয় আসনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) কর্তৃক ঘোষিত প্রার্থী তালহা শাহরিয়ার আইয়ুব ওরফে টি এস আইয়ুবের মনোনয়ন বাতিল ও পরিবর্তনের দাবিতে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহ্ উদ্দিন রিগ্যানের মাধ্যমে এ নোটিশ পাঠান যশোর-৪ আসনের ভোটার ও বাঘারপাড়া উপজেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি প্রয়াত আব্দুল খালেক বিশ্বাসের পুত্র মোঃ ইকবাল কবির। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমকে এ নোটিশ প্রেরণ করা হয়েছে।
লিগ্যাল নোটিশে বলা হয়, তালহা শাহরিয়ার আইয়ুব দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্তৃক দায়ের করা মানি লন্ডারিং মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। অভিযোগ অনুযায়ী, এলসি জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ২১ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের ঘটনায় তিনি অভিযুক্ত। একই সঙ্গে তিনি চারটি ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় দেড়শ কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ করে আত্মসাৎ করেন এবং বর্তমানে ঋণখেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত।
নোটিশে আরও উল্লেখ করা হয়, অভিযুক্ত প্রার্থী পতিত সরকারের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শেখরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এসব অনিয়মে জড়িত ছিলেন বলে এলাকায় ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। ফলে যশোর-৪ আসনের সাধারণ ভোটার, স্থানীয় নেতাকর্মী ও বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ, অসন্তোষ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। আইনজীবীর মাধ্যমে পাঠানো নোটিশে দাবি করা হয়, জুলাই সনদের ৭৫ নম্বর অনুচ্ছেদ এবং রাষ্ট্র সংস্কারে বিএনপির ঘোষিত ৩১ দফার ১৩ নম্বর দফা অনুযায়ী দুর্নীতিবাজ, চার্জশিটভুক্ত আসামি ও ঋণখেলাপিদের দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ার স্পষ্ট অঙ্গীকার রয়েছে। অথচ সেই নীতিমালা উপেক্ষা করেই যশোর-৪ আসনে বিতর্কিত প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, যা দলীয় নীতি ও জনগণের প্রত্যাশার পরিপন্থী।
নোটিশে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১৮ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ত্রয়োদশ জাতীয় পার্লামেন্ট ইলেকশনে কোনো ঋণখেলাপিকে বিএনপি মনোনয়ন দেবে না। কিন্তু সেই ঘোষণার পরও ৩ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে যশোর-৪ আসনে তালহা শাহরিয়ার আইয়ুবকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যা নোটিশ দাতার ভাষায় জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। এর আগে গত ৮ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে এ বিষয়ে একটি লিখিত দরখাস্ত দলীয় নেতৃত্বের কাছে পাঠানো হলেও কোনো প্রতিক্রিয়া না পাওয়ার অভিযোগও নোটিশে তোলা হয়।
লিগ্যাল নোটিশে বিএনপি নেতৃত্বের কাছে তিন দিনের মধ্যে যশোর-৪ আসনের মনোনয়ন বাতিল করে একজন সৎ, যোগ্য, গ্রহণযোগ্য ও জনআস্থাভাজন প্রার্থী মনোনয়নের দাবি জানানো হয়েছে। অন্যথায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও নোটিশে সতর্ক করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, নানা মাঠ জরিপ এবং সাংগঠনিক নেতাদের মতামতের আলোকে বিএনপি সম্ভাব্য প্রার্থী নির্বাচন করেছে। এটা চূড়ান্ত নয়। প্রয়োজনে এ তালিকায় কিছু পরিবর্তন হতে পারে। তবে কোনো অবস্থাতেই তৃণমূলের কোন্দল মেনে নেওয়া হবে না। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনে যেতে হবে, ধানের শীষকে জয়ী করতে হবে। এ জন্য যা যা করার দরকার দল তাই করবে। অন্যদিকে, কোনো বিভক্তি নয়, ঐক্যের ভিত্তিতে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করার কথা বলছে জামায়াত। দলের নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে ভোটারদের ঘরে ঘরে ছুটছেন দলটির প্রার্থীরা। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে নেমে এসেছে দারুণ প্রাণচাঞ্চল্য।
এ প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মাসুম বলেন, গত ৫৪ বছরেও দেশের মানুষ প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। শাসকদের কারণে জাতি বারবার বিভক্ত হয়েছে এবং অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত ঐক্য রক্ষা করতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা চাই সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আমাদের দেশ আমরা গড়বো। আমরা চাই বিভক্তি নয় ঐক্যের ভিত্তিতে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ হোক। জাতি ৫৪ বছরে বিভিন্ন শাসন দেখেছে, জাতি এখন মুখিয়ে আছে নতুন শাসন ব্যবস্থায় নতুন বাংলাদেশের দিকে। জাতি পুরোনো ব্যবস্থাকে পায়ের নিচে দিয়ে মাড়িয়ে নতুন ব্যবস্থায় নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চায়। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরা কারো সঙ্গে কোনো ধরনের আপস করবো না।
ফ্যাসিবাদের সঙ্গে অনেকেই বিভিন্নভাবে আপস করলেও জামায়াতে ইসলামীর আপসের কোনো ইতিহাস নেই”-উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আমাদের কাছেও বিভিন্নভাবে আপসের প্রস্তাব এসেছে, চাপও এসেছে। তবুও আমরা কারো কাছে মাথানত করিনি। আমাদের নেতারা ফাঁসি বরণ করেছে তবুও কোনো অপশক্তির কাছে, কোনো অন্যায়ের কাছে মাথানত করেনি। আগামীতেও আমরা কোনো অন্যায়ের কাছে মাথানত করবো না।
দলটির আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এখনও পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। যারা ক্ষমতায় ছিল তারা নিজেদের ভাগ্য বদলাতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য অপরিবর্তিত রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা নির্বাচিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপনাদেরকে সহ সকল ফ্যাসিবাদবিরোধী দলকে নিয়ে সরকার গঠন করবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ