পাচারকারীদের পৌনে ২ লাখ কোটি টাকার সম্পদ অবরুদ্ধ

লুটপাট ও পাচারের অভিযোগে আইনি প্রক্রিয়ার আওতায় শেখ হাসিনা পরিবারসহ শীর্ষ দশ শিল্পগোষ্ঠীর প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এসব সম্পদের অধিকাংশ ব্যাংক থেকে ঋণের নামে লুট করা হয়েছে যা আইনি প্রক্রিয়া শেষে ব্যাংকে ফেরত যাবে। পাশাপাশি অনৈতিক প্রক্রিয়ায় যেসব সম্পদ অর্জন করা হয়েছে সেগুলো দিয়ে ‘লুটের টাকা ব্যবস্থাপনা তহবিল’ গঠন করবে সরকার যা ‘জনকল্যাণে’ ব্যবহার করা হবে।

সোমবার (১৯ মে) প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে পাচার করা টাকা ফেরত আনার বিষয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে এসব কথা জানানো হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান এ এফ এম শাহিনূর ইসলাম।

ব্রিফিং শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের পাশাপাশি ১০টি শিল্পগোষ্ঠীর এক লাখ ৩০ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা মূল্যের স্থাবর অর্থ অ্যাটাচমেন্ট আছে। আর দেশের বাইরে ১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলারের (২ হাজার কোটি টাকা) সম্পদ এটাচমেন্ট আছে। 

এছাড়া ৪২ হাজার ৬১৪ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পত্তি দেশের ভিতরে ফ্রিজিং অবস্থায় রয়েছে। এ ছাড়া বিদেশে ২ কোটি ৭ লাখ ডলারের (২৫৩ কোটি টাকা) অস্থাবর সম্পত্তি এটাচমেন্ট আছে।

এই বিষয়টি স্পষ্ট হতে ব্রিফিং শেষে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেককে ফোন দেওয়া হলে তিনি ভোরের আকাশ’কে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন আদালতের মাধ্যমে এক লাখ ৩০ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা মূল্যের স্থাবর অবরুদ্ধ করেছে। এই সম্পত্তি কেউ হস্তান্তর করতে পারবে না। 

এর মধ্যে জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট আছে। আর দেশের বাইরে একইভাবে ১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলারের সম্পদ অবরুদ্ধ করা হয়েছে ওইসব দেশের সরকারের সহযোগিতায়। পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে ৪২ হাজার ৬১৪ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পত্তি অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা নগদ অর্থ ও মালিনাকাধীন শেয়ার। একইভাবে বিদেশে ২ কোটি ৭ লাখ ডলারের অস্থাবর সম্পত্তি অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে।

পাচারে অভিযুক্তদের সম্পদ ও অর্থ উদ্ধারে কোন কোন দেশ সহযোগিতা করছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুর সরকার বর্তমানে আমাদের সহযোগিতা করছে। এসব দেশেই আমাদের অর্থের বেশিরভাগ পাচার হয়েছে।

দেশের সর্বোচ্চ পাচারকারী শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের দিকে ইঙ্গিত করে গভর্নর বলেন, সিঙ্গাপুর সরকারের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। আমরা যদি প্রমাণ করতে পারি (এস আলম গ্রুপের) অর্থ পাচারের বিষয়টি, তাহলে সিঙ্গাপুর সরকার আমাদের আস্বস্ত করেছে নাগরিকত্ব বাতিল করার। আমরা যদি ওই দেশের গণমাধ্যমে তাদের পাচারের বিষয়ে প্রচারণা চালিয়ে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারি এবং পাচারের বিষয়গুলো আইনিভাবে প্রমাণ করতে পারি তাহলে আমরা সফল হবো।

প্রসঙ্গত, এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদের সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব রয়েছে। আগেই তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছিলেন যা তার লুট করা অর্থ উদ্ধারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার গঠিত ১১টি তদন্ত দলের অনুসন্ধানে ১০ শিল্পগোষ্ঠীসহ শেখ হাসিনা পরিবারের বিরুদ্ধে ব্যাংকঋণে অনিয়ম, কর ফাঁকি ও অর্থপাচারসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে। শেখ হাসিনার পরিবারের বাইরে যে ১০ শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে এস আলম গ্রুপ, বেঙ্মিকো গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, জেমকন গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ ও আরামিট গ্রুপ। অর্থ লুট ও পাচারের ঘটনায় ইতোমধ্যে বেশ কিছু মামলা দায়ের করা হয়েছে। 

বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে সরকার একটি বিশেষ অধ্যাদেশ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। সেই সঙ্গে, এই অর্থ উদ্ধারে কোন ধরনের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হবে, তা নির্ধারণের কাজও চলছে। এ প্রক্রিয়ায় সহায়তা দিচ্ছেন বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে গঠিত পাচার করা অর্থ উদ্ধারে অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ দল।

গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আদালতের সিদ্ধান্ত ও প্রয়োজনে আইন সংশোধনের মাধ্যমে ফান্ড (লুটের টাকা ব্যবস্থাপনা তহবিল) গঠন করা হবে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে একটা ফান্ড প্রতিষ্ঠা করা। যেটার অর্থ দিয়ে আমরা ব্যাংকগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে পারব। কারণ ব্যাংকগুলো বিশালভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের টাকা তো লুট করা হয়েছে। এছাড়া বাকি টাকা যেগুলো নন ব্যাংক রিলেটেড, যেগুলো দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা হয়েছে, সেগুলো সরকার আরেকটা ফান্ডে নিয়ে জনহিতকর কাজে ব্যয় করবে। সবই আইনগতভাবে করা হবে। কোনোটাই আইনের বাইরে হবে না।

পাচার হওয়া অর্থ কতদিনে ফেরত আসতে পারে জানতে চাইলে আহসান এইচ মনসুর বলেন, টাকা কীভাবে ফেরত আনতে হয়, সেটার কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল এক্সপেরিয়েন্সটা আমরা জানি। সাধারণত এটি করতে ৪ থেকে ৫ বছর সময় লাগে। কিন্তু এর মধ্যে ইমিডিয়েট কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যায়। বিদেশে তাদের যে সম্পদ আছে, সেটাকে ফ্রিজ করা যায়। সেটা আপেক্ষিকভাবে বছর খানেকের মধ্যে করা সম্ভব। প্রথমে আমাদের দেশে আইনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে, তারপর সঠিক প্রণালীতে বিদেশে অনুরোধ জানাতে হবে। যেটাকে বলা হয় মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্স (এমএলএ)। আমরা এখন এই প্রক্রিয়ায় আছি। আমরা অনুরোধ পাঠাচ্ছি।

‘যারা দেশ থেকে অর্থ পাচার করেছেন, তারা শান্তিতে থাকতে পারবেন না’, পূর্বে গভর্নরের দেওয়া এই বক্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করা হয়, পাচারকারীদের শান্তি বিনষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন কি না? এর জবাবে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, তারা শান্তিতে আছেন, তা বিশ্বাস করি না। তারা বড় বড় আইনজীবী নিয়োগ দিচ্ছেন। আমরা শুনেছি, এস আলম তার আইনজীবীর পেছনে বছরে তিন কোটি ডলার (৩৬৬ কোটি টাকা) ব্যয় করবেন। এটা তাঁর শান্তিতে থাকার লক্ষণ নয়। টাকা ফেরত আনতে পারা ও শান্তিতে থাকা দুটি ভিন্ন বিষয়। আমরা ঘুম নষ্ট করতে পেরেছি। টাকা ফেরত আনতে সময় লাগবে। কারণ, আইনিপ্রক্রিয়া অনুসরণ করে এটা এগোবে।’

গভর্নরের উত্তরে সংযোজন করে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, তারা শান্তিতে যে নেই, এর আরও একটা প্রতিচ্ছবি হলো, মাঝারি আকারের আরও ১২৫টি অনিয়ম তদন্তের আওতায় আসছে, যারা ২০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ লুট করেছেন। আমরা ২০টি বিদেশি আইনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছি। এখন এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কী কাজ হবে, তার কার্যপরিধি ঠিক করা হচ্ছে।

ভোরের আকাশ/জাআ