নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ
তারিক আল বান্না
প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৫ ১২:৫১ এএম
ছবি: সংগৃহীত
একাত্তরে মহান স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ ৩৬ বছর পর ২০০৭ সালে প্রথম জাতীয় নারী ক্রিকেট দল গঠিত হয়। যেখানে পুরুষ জাতীয় দল প্রথম গঠিত হয় ১৯৭৬-৭৭ সালে। এর আগে ধানমন্ডি মাঠ, আবাহনী মাঠসহ কিছু কিছু স্থানে স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা ব্যক্তিগত চেষ্টায় ব্যাট-বল নিয়ে মাঠে নামলেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নারীদের ক্রিকেট চর্চা শুরু হয় মূলত প্রথম জাতীয় দল গঠনের পর থেকেই।
সামাজিক দায়বদ্ধতা, দীর্ঘ সংগ্রাম আর কঠোর চেষ্টার ফলে বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ মঞ্চে আজ বাংলাদেশের নারীদের পদচারনা। বাংলাদেশ নারী দল বিশ্বকাপে খেলবে, সেটা ছিল অনেকটা স্বপ্নের মতো। সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয় ২০২২ সালে প্রথমবার নিজেদের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। এবার দ্বিতীয়বারের মতো ক্রিকেটের সর্বোচ্চ আসর বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলছে বাংলাদেশ। মঙ্গলবার চলতি নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে স্বাগতিক ভারত সহজেই শ্রীলঙ্কাকে ৫৯ রানে হারিয়ে শুভসূচনা করেছে। গতকাল বুধবার শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড মুখোমুখি হয় লিগপর্বের ম্যাচে।
এদিকে, পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আজ বৃহস্পতিবার বিশ্বকাপ মিশন শুরু করবে বাংলাদেশের মেয়েরা। এই পাকিস্তানের বিপক্ষেই ২০২২ সালে নিজেদের প্রথম ওয়ানডে বিশ^কাপে ৯ রানের জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। তাই আজও জয় পেতে বদ্ধপরিকর বাংলাদেশ। কলম্বোতে বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে তিনটায় মাঠে গড়াবে ওয়ানডে ফরম্যাটের এই ম্যাচটি। আট দলের টুর্নামেন্টে আরও রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ড।
এবারের আসরে থাকছে না কোনো গ্রুপ পর্ব। লিগ পর্বে আট দলের প্রত্যেকেই একে অন্যের মুখোমুখি হবে। এরপর পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষ চারদল নিয়ে হবে সেমিফাইনাল। সেখানে বিজয়ী দুই দল মুখোমুখি হবে ফাইনালে। তিন বছর আগে প্রথমবার নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলেছিল বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বিপক্ষে দুর্দান্ত এক জয় পেয়েছিল তারা। এবারও পাকিস্তানের মেয়েদের হারিয়ে বিশ্বকাপে শুভসূচনা করতে চায় নিগার সুলতানা জ্যোতির দল। যদিও বিশ্বকাপ প্রস্তুতি ঘাটতি আছে টাইগ্রেসদের।
দেশের মানুষকে ভালো কিছু দেয়ার পাশাপাশি নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে গত ২৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে দেশ ছাড়েন বাংলাদেশের মেয়েরা। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ খেলার পর সেখান থেকে ভারতে যাবে বাংলাদেশের মেয়েরা। বাংলাদেশের দ্বিতীয় ম্যাচ ৭ অক্টোবর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। পরবর্তীতে নিউজিল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের বিপক্ষেও গ্রুপ পর্বের ম্যাচ খেলবেন জ্যোতিরা।
নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ এবার সুযোগ পেয়েছে কোয়ালিফায়ার রাউন্ড পেরিয়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে পেছনে ফেলে বিশ্বমঞ্চে জায়গা করে নিয়েছে নিগার সুলতানা জ্যোতির দল। বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্য কোনো আন্তর্জাতিক সিরিজের পরিবর্তে মেয়েদের খেলতে হয় অনূর্ধ্ব-১৫ কিশোর দলের বিপক্ষে। এমন প্রস্তুতির ঘাটতি নিয়েও বিশ্বকাপে ভালো করার ব্যাপারে আশাবাদী অধিনায়ক জ্যোতি।
গণমাধ্যমকে টাইগ্রেস অধিনায়ক বলেন, ‘অবশ্যই আমরা ম্যাচ বাই ম্যাচ পরিকল্পনা করে এগোব। আপাতত প্রথম লক্ষ্য পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ জেতা। এমনিতেই আন্তর্জাতিক ম্যাচ বেশি খেলার সুযোগ পাই না। তবে এত বড় ইভেন্টে সব ভালো দলের বিপক্ষে খেলতে পারলে জয়ও আসবে। সাধ্যমতো চেষ্টা থাকবে ম্যাচ ধরে রেখে খেলার।’
বাংলাদেশের অধিনায়ক বলেছেন, ‘এটা আমাদের দ্বিতীয় ওয়ানডে বিশ্বকাপ। আগে আমরা অনভিজ্ঞ ছিলাম এবং বড় ইভেন্টে জেতার ক্ষেত্রেও অপরিচিত ছিলাম। এরপর দেশে ও দেশের বাইরে প্রচুর ক্রিকেট খেলেছি আমরা। এখন আমরা জানি এসব টুর্নামেন্টে কিভাবে ম্যাচ জিততে হয়। আইসিসির এবারের টুর্নামেন্টটি ১৩তম হলেও বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো অংশ নিচ্ছে। এবারের আসরের পারফরম্যান্স দিয়ে সমর্থকদের আস্থার প্রতিদান দিতে চান জ্যোতি।
উইকেটরক্ষক-ব্যাটার বলেছেন, ‘এই বিশ্বকাপ নিয়ে আমরা মুখিয়ে আছি। আমাদের সবার জন্যই এটা একটা ভালো সুযোগ। আমরা আমাদের দেশে ক্রিকেট প্রচারের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন, যেখানে কিনা নারীদের ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। আমরা বিশ্বাস করি আমাদের পারফরম্যান্সের মাধ্যমে আমাদের সমর্থকদের প্রতিদান দেওয়ার সময় এসেছে।’
এদিকে, প্রথমবার ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন পেসার মারুফা আক্তার। প্রথম বিশ্বকাপটা স্মরণীয় করে রাখতে চান তিনি।
মারুফা বলেন, ‘বাংলাদেশ জাতীয় দলের এটি দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। আমি প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছি। এটা আমার স্বপ্ন ছিল। আমি সব সময় চেষ্টা করব দলের জন্য সেরাটা দিতে।’
বাংলাদেশের প্রধান কোচ সরোয়ার ইমরান শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান ম্যাচকে টার্গেট করছেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো প্রতিটি ম্যাচ ধরে খেলা ও ভালো খেলা। আমাদের দুটি ম্যাচে ভালো সুযোগ আছে, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। এছাড়া অন্যান্য দলের সঙ্গেও আমরা... কাউকে বড় করে দেখছি না। শতভাগ দিয়ে চেষ্টা করব।’
ফাহিমা খাতুন বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, প্রথমে বলতে চাই গত কয়েক মাসে আমরা অনেক ভালো অনুশীলন করেছি। বিসিবি আমাদের যতগুলো সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে আমরা সবগুলো নেয়ার চেষ্টা করেছি। আমি মনে করি দল হিসেবে আমরা খুব ভালো প্রস্তুতি নিয়েছি। সেটা ব্যাটিং-বোলিং দুই দিকেই। আমরা আশানুরূপ রেজাল্ট করতে চাই।’
আট দলের এবারের আসরে মোট ম্যাচের সংখ্যা ৩১টি। আগামী ২ অক্টোবর ভারত ও শ্রীলঙ্কার যৌথ আয়োজনে নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মহারণ শেষ হবে ফাইনালের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ নারী দল এবার বিশ্বকাপে তরুণ-অভিজ্ঞদের মিশ্রণে গড়া। তাতে অধিনায়ক জ্যোতির সঙ্গে আছেন অভিজ্ঞ ক্রিকেটার নাহিদা আক্তার-ফাহিমা খাতুনরা, পাশাপাশি সুযোগ পেয়েছেন কয়েকজন তরুণ মুখও, যারা দলের চমক হয়ে উঠতে পারে।
প্রাইজমানি কত পাবে বাংলাদেশ: এবার গ্রুপ পর্বের ৭ ম্যাচে বাংলাদেশ জিতুক বা হারুক, আর্থিকভাবে ঠিকই লাভবান হবে। শুধুমাত্র টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের জন্যই বাংলাদেশ নারী দল নিশ্চিতভাবে ৩ কোটি ২ লাখ টাকা পাচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি জয়ের জন্য টাইগ্রেসরা আরও ৪১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা করে পাবে। এই অর্থ দেবে আইসিসি।
আইসিসি জানিয়েছে, এবারের আসরের মোট প্রাইজমানি ১৬৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। যা নারী ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আগামী ২ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য ফাইনালে শিরোপাজয়ী দল পাবে ৫৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা। যা ২০২৩ সালের ফিফা নারী বিশ্বকাপজয়ী স্পেনের চেয়েও বেশি। সবক্ষেত্রেই বেড়েছে প্রাইজমানির পরিমাণ। ২০২২ সালের তুলনায় এবারের আসরে প্রাইজমানি বেড়েছে ২৯৭ শতাংশ। এমনকি এই অর্থ ছেলেদের সর্বশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপের (২০২৩) প্রাইজমানির চেয়েও বেশি। আইসিসির আশা, এবারের বিশ্বকাপ নারী ক্রিকেটকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। বাংলাদেশ কতদূর এগোতে পারবে, সেটা দেখার অপেক্ষায় ক্রিকেটভক্তরা।
বাংলাদেশের বাকি ছয় ম্যাচ: আগামী ৭ অক্টোবর গুয়াহাটির বর্ষাপাড়া স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। এর তিনদিন পরই একই ভেন্যুতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে টাইগ্রেসদের। চার নম্বর ম্যাচটা খেলার আগে ফের জ্যোতিদের লম্বা ভ্রমণের ঝক্কি পোহাতে হবে। ১৩ অক্টোবর বিশাখাপট্টনমে দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হবে বাংলার মেয়েরা। ১৬ অক্টোবর একই ভেন্যুতে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ টুর্নামেন্টের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশের পরবর্তী ম্যাচের প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা। ২০ অক্টোবর নাবি মুম্বাইয়ের ডিওয়াই পাতিল স্পোর্টস একাডেমি মাঠে এই ম্যাচটি খেলবে টাইগ্রেসরা। লিগ পর্বে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচটি ২৬ অক্টোবর। একই স্টেডিয়ামে স্বাগতিক ভারতের বিপক্ষে খেলবে জ্যোতির দল। সেমিফাইনালে জায়গা নিশ্চিত না করতে পারলে এই ম্যাচ দিয়েই বিশ্বকাপ শেষ হবে টাইগ্রেসদের।
নারী বিশ্বকাপের বাংলাদেশ দল : নিগার সুলতানা (অধিনায়ক), নাহিদা আক্তার, ফারজানা হক, রুবাইয়া হায়দার, শারমিন আক্তার, সোবহানা মোস্তারি, রিতু মনি, স্বর্ণা আক্তার, ফাহিমা খাতুন, রাবেয়া খান, মারুফা আক্তার, ফারিহা ইসলাম, সানজিদা আক্তার, নিশিতা আক্তার ও সুমাইয়া আক্তার।
ভোরের আকাশ/এসএইচ